ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

এনআইডি

ভিনদেশির অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে ৩ ক্যাটাগরিতে আবেদন নিষ্পত্তি হবে

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪
ভিনদেশির অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে ৩ ক্যাটাগরিতে আবেদন নিষ্পত্তি হবে

ঢাকা: জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) কার্যক্রমে ভিনদেশির অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে তিনটি ক্যাটাগরিতে নাগরিকদের আবেদন ভাগ করে নিয়ে নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে চট্টগ্রামবাসী এনআইডি পেতে বিশেষ কমিটির বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাচ্ছে।

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। এতে যেকোনো নাগরিক আবেদন করলেই সেই কমিটির অনুমোদন ছাড়া ভোটার হওয়া বা এনআইডি সংগ্রহ করা যেত না। আর সব আবেদনকারীই ভিনদেশি হিসেবে মূল্যায়নের মধ্যে পড়তেন। ফলে দেশের নাগরিক হয়েও তাদের রোহিঙ্গা বা অন্য দেশি না হওয়ার নানা প্রমাণ দাখিল করতে হতো। এতে বিড়ম্বনার কোনো শেষ ছিল না।

ইসির নতুন সচিব শফিউল আজিম দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি নজরে এলে দেশের অন্যান্য স্থানের মতোই চট্টগ্রামের অধিবাসীদের এনআইডি সেবা সহজীকরণের উদ্যোগ নেন। কেউ আবেদন করলেই যেন রোহিঙ্গা সন্দেহ না করা হয়, সেই নির্দেশনা দেন। এছাড়া কীভাবে ওই অঞ্চলের সেবা সহজ করা যায়, সেজন্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে সুপারিশ পাঠানোর জন্যও বলেন। সম্প্রতি মাঠ থেকে ১৬ ধরণের সুপারিশ এলে তিন ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রামের নাগরিকদের এনআইডি সেবা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

ইসির উপ-সচিব মো. মাহবুব আলম শাহ ইতিমধ্যে ওই নির্দেশনা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে এবং মাঠ কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন। নির্দেশনায় কেউ আবেদন করলে প্রথমে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ফেলার কথা বলা হয়েছে। দুটি ক্যাটাগরির কোনোটিতেই না চিহ্নিত করা না গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদন বিশেষ কমিটির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।

যাদের এসএসসি/সমমান বা তদূর্ধ্ব সনদ আছে তারাই ‘এ’ ক্যাটাগরিতে পড়বেন। এক্ষেত্রে আবেদনের সঙ্গে তাদের এসএসসি/সমমান বা তদুর্ধ্ব অনলাইন সনদ, ভেরিফাইয়েবল কিউআর কোডযুক্ত অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ, ভেরিফাইয়েবল কিউআর কোডযুক্ত অনলাইন নাগরিকত্ব সনদ ও বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে।

এছাড়া আবেদনকারী সরকারি চাকরিজীবীর সন্তান হলে সরকারি চাকরির প্রমাণ স্বরূপ অফিস প্রধান কর্তৃক সত্যায়িত সার্ভিস বইয়ের কপি, নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র প্রদান করতে হবে।

অন্যদিকে এসএসসি/সমমান বা তদুর্ধ্ব সনদ না থাকলে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী ‘বি’ ক্যাটাগরিতে পড়বেন। এক্ষেত্রে তাকে ভেরিফাইয়েবল কিউআর কোডযুক্ত অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ, ভেরিফাইয়েবল কিউআর কোডযুক্ত অনলাইন নাগরিকত্ব সনদ, বাবা-মায়ের ‘এএফআইএস’ যাচাই, স্থায়ী বাসিন্দা সনদ (জেলা প্রশাসন/পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে রাজা কর্তৃক প্রদত্ত), ভূমিহীন সনদ, অনলাইন ভেরিফায়েবল ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানের রশিদ/পর্চা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), পাসপোর্ট (যদি থাকে) ও ড্রাইভিং লাইসেন্স (যদি থাকে) জমা দিতে হবে। তবে বাবা-মায়ের মধ্যে একজন বেঁচে থাকলে এবং তিনি ভোটার হয়ে থাকলে তার ‘এএফআইএস’ যাচাই এবং অন্যজনের অনলাইন মৃত্যু সনদ দাখিল করতে হবে। আর বাবা-মা কেউ বেঁচে না থাকলে উভয়ের অনলাইন মৃত্যু সনদ দাখিল করতে হবে।

যেসব বাসিন্দা ভোটার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ক্যাটাগরি ‘এ’ এবং ক্যাটাগরি ‘বি’ এর আওতায় পড়বে না, তাদের ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম বিশেষ কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে।

ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কেউ ভোটার হতে এলে দেশের নাগরিকদের জন্য শর্ত পূরণে কেউ ব্যর্থ হলে সংশ্লিদের আবেদন পাঠানো হবে বিশেষ কমিটিতে। সেখানে প্রমাণ হলেই কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ভোটার তালিকায় যুক্ত হবেন এবং এনআইডি পাবেন।

নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, উপজেলা বিশেষ কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সদস্য সচিব হবেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। এছাড়া অফিসার ইন-চার্জ/পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত/অপারেশন)/সেকেন্ড, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি (কর্মকর্তার নিচে নয়), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি (কর্মকর্তার নিচে নয়), হেড ম্যান/কারবারি (পার্বত্য জেলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য), সংশ্লিষ্ট পৌরসভার মেয়র/মেয়র কর্তৃক মনোনিত একজন কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অথবা প্যানেল চেয়ারম্যান সদস্য হিসেবে থাকবেন।

আবার সিটি কর্পোরেশন/মেট্রোপলিটন থানা নির্বাচন অফিসের ক্ষেত্রে গঠিত বিশেষ কমিটি আহ্বায়ক করা হয়েছে সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসারকে, আর সদস্য সচিব হচ্ছে থানা নির্বাচন অফিসার৷ অন্যদের মধ্যে অফিসার-ইন-চার্জ/পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত/অপারেশন)/সেকেন্ড অফিসার, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি (কর্মকর্তার নিচে নয়), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি (কর্মকর্তার নিচে নয়) ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে সদস্য করা হয়েছে।

বিশেষ কমিটির কার্যপরিধি:
১। বিশেষ তথ্য ফরমে প্রদত্ত সকল জাতীয় পরিচয়পত্রের এনআইডি নম্বরসমূহ অনলাইনে যাচাই করতে। যাচাইয়ের সময় নিম্নলিখিত বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ খেয়াল রাখতে হবে-
(ক) ভাই/বোনের জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লিখিত পিতা/মাতার নামের সাথে আবেদনকারীর উল্লিখিত পিতা/মাতার নামের মিল থাকতে হবে।
(খ) চাচা/ফুফুর ডাটাবেজে তাদের পিতার নাম ও ঠিকানার সাথে আবেদনকারীর বিশেষ তথ্য ফরমে প্রদত্ত পিতামহের নাম ও ঠিকানার মিল থাকতে হবে।
(গ) প্রয়োজনে নিকট আত্মীয়ের মোবাইল নম্বরে কথা বলে তাদের পরিচিতি/তথ্য সম্পর্কিত বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।

২। ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ অনুযায়ী ভোটার হতে ইচ্ছুক উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশের কোথাও ‘সচরাচর নিবাসী’ হতে হবে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্রে উল্লিখিত জেলাসমূহের যদি কেউ সচরাচর নিবাসী দাবি করে, তবে সেই দাবির যথার্থতা পুঙ্খানুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করতে হবে। শুধু একটি নিবাসের ঠিকানাই এ জন্য যথেষ্ট হবে না। নিবাসের প্রমাণস্বরূপ তাকে এ সংক্রান্ত প্রণীত অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ ফরম অনুযায়ী চাহিত সব তথ্য প্রদান করতে হবে।

৩। যদি বর্ণিত জেলাসমূহে এই সমস্ত ব্যক্তি নিজস্ব সম্পত্তির সূত্রে তালিকাভূক্তির দাবি করে তবে তাদের সম্পত্তির মালিকানা ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য সংশ্লিষ্ট দালিলাদি তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রদান করতে হবে।

৪। যারা বাংলাদেশি কোনো নাগরিকের সাথে বৈবাহিক সূত্রে ভোটার তালিকাভুক্তির দাবি করবেন তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত নাগরিক সনদপত্রসহ দলিলাদি তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রদান করতে হবে এবং অন্য কোনো সূত্রে কেউ ভোটার হওয়ার উপযুক্ত দাবি করলে তাদেরকে এ সম্পর্কিত প্রমাণ তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রদান করতে হবে।

৫। তথ্য সংগ্রহকারীগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফরম-২ এর সাথে এ কার্যক্রমের আওতায় অতিরিক্ত তথ্য ফরম মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় দালিলিক কাগজপত্রসহ প্রতিটি কেস উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসারের নিকট জমা দিবেন। উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার আবেদন/কেসসমূহের সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করে সকল কাগজপত্র বিশেষ কমিটির নিকট উপস্থাপন করতে হবে।

৬। বিশেষ কমিটি প্রতিটি ফরম পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে যাচাই বাছাইয়ের আগে সিদ্ধান্ত দেবেন। বাছাইকৃত কেসগুলোয় বিশেষ কমিটির ইতিবাচক সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসারকে অবহিত করার পর তিনি ওই সমস্ত নাগরিকদের ভোটার তালিকাভুক্ত করার জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণের আগে নিবন্ধন কেন্দ্রে তাদের আগমনের জন্য নোটিশ জারি করতে হবে। যাদের কেস গ্রহণ করা হবে না, কি কারণে গ্রহণ করা হলো না, তা নোট শিটে লিপিবদ্ধ করে বিশেষ কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর করতে হবে। এছাড়া নিষ্পত্তির বিষয়টি প্রতিটি বিশেষ তথ্য ফরম (ফরম-২ এর অতিরিক্ত তথ্য)-এর ১৬ নম্বর ক্রমিকে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্ত উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার লিপিবদ্ধ করতে হবে।

৭। বিশেষ কমিটি যাদের আবেদন বাতিল করবে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর উক্ত বিষয়ে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্তের অনুলিপি নিয়ে সংশোধনকারী কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন কতে পারবেন।

৮। রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার বিষয়ে যদি কেউ তাদের সহযোগিতা অথবা মিথ্যা তথ্য প্রদান অথবা মিথ্যা/জাল কাগজপত্র সরবরাহ করেন অথবা সংশ্লিষ্ট কারো গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০ এবং প্রচলিত অন্যান্য আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হবে।

জানা গেছে, রোহিঙ্গারা সমতলে ছড়িয়ে পড়ায় ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশন চট্টগ্রাম অঞ্চলের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার সব উপজেলাকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করে ইসি। ৩২টি উপজেলা/থানার ভোটারযোগ্য ব্যক্তিদের নিবন্ধনের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ‘বিশেষ কমিটি’ গঠন করা হয়। ওই কমিটির যাচাই-বাছাই এবং সুপারিশ প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়।

কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষ কমিটির মাধ্যমে ভোটার হতে গেলে ভাই-বোন, বাবা-মা, দাদা-দাদি, মামা, ফুফু, খালা ইত্যাদির তথ্য; বাড়ির জমির দলিলসহ বিভিন্ন ধরণের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়। এতে রোহিঙ্গা বা ভিনদেশিদের কারণে দেশের নাগরিকদেরও সেবা প্রাপ্তি কঠিন হয়ে যায়। তাই এখন থেকে সব আবেদন আর আগের মতো বিশেষ কমিটিতে যাবে না। এতে সমতলের মতোই অধিকাংশ আবেদন নিষ্পত্তি হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪ সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪
ইইউডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।