ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ আনতে সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আলোচনায়

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০২৪
‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ আনতে সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আলোচনায়

ঢাকা: অন্তর্বর্তী সরকারের নানা সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি নির্বাচনের সুপারিশ উঠে আসছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে ফের কি তবে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থায় যেতে হবে, নাকি সংসদীয় পদ্ধতির মধ্যে থেকেই পাশাপাশি হবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই পদ্ধতিতেই হতে পারে। আসল কথা হলো প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।

গত অক্টোবরে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন হওয়ার পর তারা বিভিন্ন মহলের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সুপারিশ নিচ্ছে। এরই মধ্যে গণমাধ্যম, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, নাগরিক সমাজ, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, শিক্ষার্থী সমাজ ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে৷ এছাড়া বিভিন্ন দল ও জনগণের কাছেও সুপারিশ আহ্বান করেছে ওই কমিশন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মহল থেকে সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার সুপারিশ এসেছে।

কেন এই আলোচনা

বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সর্বময়। আর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেবল সরকারের আদেশগুলো সই করে কার্যকর করার মধ্যেই সীমিত। এতে রাষ্ট্রের শীর্ষ দুই পদের ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি কাজ করছে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের শাসন উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। তাই ওই দুই পদের ক্ষমতায় ভারসাম্য আনাই এই আলোচনার উদ্দেশ্য।

নতুন প্রস্তাবকারীরা বলছেন, এখন যেভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয় সে প্রক্রিয়া নিয়ে নানা আলোচনা আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, দলের প্রতি বেশি অনুগতরা রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য মনোনীত হচ্ছেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে কেউ কেউ বলেছেন, রাষ্ট্রপতি কে হবেন এটা এখন প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাতে ক্ষমতার ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে গেছে।

কী প্রস্তাব আসছে

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সূত্র বলছে, সরাসরি নির্বাচনের এই আলোচনায় রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে একেবারে নির্দলীয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে৷ তবেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আসবে।

বর্তমানে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, এতে জাতীয় সংসদ সদস্যরা ভোট দেন, তারাই প্রার্থী মনোনয়ন করেন৷ এতে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ট দলের প্রার্থীই নির্বাচিত হন। ফলে সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান একই দলের ব্যক্তি হন। তাই জাতীয় সংসদ ও সব স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন হতে পারে। কিংবা সরাসরি পদটিতে সাধারণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে এ নির্বাচন হতে পারে। এতে বিরোধী দলের প্রার্থীও পদটিতে আসীন হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

অন্যদিকে নির্দলীয় ব্যক্তিকে যদি রাষ্ট্রপতি করা যায় সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে, তবে পাঁচ বছর পরপর তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। যার অধীনে সংসদ নির্বাচনে যেতে কারও কোনো অসুবিধা থাকবে না বলেও সুপারিশে ওঠে আসছে।

বিশিষ্টজনরা যা বলছেন

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-(জানিপপ)’ চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বিভিন্ন পদ্ধতির হতে পারে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সরাসরিও হতে পারে। তবে সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতে হলে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় যেতে হবে। কেননা, সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতিতে শাসন ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে৷ এক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আবার মিলেমিশেও হতে পারে। অর্থাৎ সংসদীয় ব্যবস্থায় থেকেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সরাসরি হতে পারে। সেজন্য সংবিধান সংশোধন না করে আইনে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। তবে যেভাবেই হোক সেখানে জনমতের প্রতিফলন হতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ও ঢাকা ইন্টারন্যাশল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারি বলেন, ব্রিটেনে সংসদীয় পদ্ধতি। সেখানে রাজতন্ত্র নিয়মতান্ত্রিক। নির্বাচন হয় না। তবে সেখানে সংসদ যে আইন করে রাজা তা স্বাক্ষর করে থাকেন। কিন্তু কিছু প্রথা সবাই মানেন, যা রাজা বা রানী থেকে আসে। সেই আলোকেই আমাদের শাসন ব্যবস্থা। তবে আমাদের এখানে সরাসরি নির্বাচনের কথা এই জন্য আসছে যে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ-ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রপতি পদটা আলঙ্কারিক করে রাখা হয়েছে। এসব দেশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এতো বেশি যে, রাষ্ট্রপতিকে সেই সম্মানটা করা হয় না।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সরাসরি করার আলোচনাটা গুরুত্ব পেলে রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতিতে যেতে হবে। আবার সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও সরাসরি নির্বাচন করা যেতে পারে। তবে আমাদের মতো গরিব দেশে বারবার একটা নির্বাচন না করে বরং রাষ্ট্রপতিকে কিছু ক্ষমতা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি পদের ক্ষমতার কিছুটা ভারসাম্য করা যেতে পারে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন দলভিত্তিক নয়, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন সরাসরি আসবে কি-না, সে প্রস্তাব জোরালোভাবে এসেছে। আমাদের যে অনেকগুলো অসঙ্গতি আছে, তা আমরা চিহ্নিত করেছি। যেমন দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, উচ্চকক্ষ কীভাবে নির্বাচিত হবে—আমরা এগুলো সততার সঙ্গে নোট নিয়েছি। সবকিছু পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে সুপারিশ করবো।

দেশের শাসন ব্যবস্থা

স্বাধীনতার পর সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচন হলেও ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বলবৎ থাকে৷ সে সময় গণঅভ্যুত্থানে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন হলে ১৯৯১ সালে ফের সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয়। এতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদ একচ্ছত্র ক্ষমতা পায়। সংসদে ফ্লোর ক্রসিংয়ে (দলের বিপক্ষে ভোট) গেলে পদ হারানোর বিধান থাকায় প্রধানমন্ত্রী মূলত আইনগতভাবে এক নায়কে পরিণত হন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেবল সরকারি সিদ্ধান্তে সই করার মধ্যে সীমিত হয়ে যায়। তাই সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সরাসরি নির্বাচনকে সামনে আনছে সচেতন মহল। সংস্কার উদ্যোগ একটি সুযোগ এনে দিয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের জন্য অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অতীতে যত অন্যায়, বৈষ্যম করা হয়েছে, তা দূর করার। এমন একটা দেশ গড়তে চাই যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে। যেই চেতনা থেকে আন্দোলন হয়েছে সেই চেতনার ভিত্তিতেই আমরা পরিচালিত হতে চাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২৪
ইইউডি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।