২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি ৯ কোটি (৯০ মিলিয়ন) নাগরিকের স্মার্টকার্ড সরবরাহে অবার্থারের সঙ্গে ৭৯৬ কোটি ২৬ লাখ টাকার চুক্তি করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শর্ত অনুসারে ১৮ মাসের মধ্যে সবগুলো স্মার্টকার্ড তৈরি করে দেওয়ার কথা থাকলেও গত ৩০ মাসেও পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
ইসি’র অভিযোগ, চুক্তির পর থেকেই কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেনি কোম্পানিটি। বরং বারবার নানা অজুহাতে সময় নিয়েছে। ফলে ঝুলে গেছে পুরো প্রক্রিয়াটি। তাই এবার ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ।
সূত্র জানায়, অবার্থারকে মোট ২৫ বার তাগাদা দিয়েও যখন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন হার্ডলাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। অবশেষে কার্ড সরবরাহ করতে না পারার কিছু কারণ ব্যাখ্যা করে ওই ফরাসি প্রতিষ্ঠান। যা যুক্তিযুক্ত মনে না হওয়ায় আবারো জবাব দিতে বলে ইসি। কিন্তু এখনো তারা কোনো জবাব দেয়নি।
এদিকে চুক্তির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল সার্ভারের (ফায়ার ওয়াল) পাসওয়ার্ড ইত্যাদি দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে নির্বাচন কমিশন অবার্থারের সে দাবি মানতে নারাজ। তাই নির্ধারিত সময়ে কার্ড সরবরাহ করতে না পারায় ক্ষতিপূরণসহ বিষয়টি মীমাংসার জন্য চিঠি দিয়েছে ইসি। সেটিও প্রায় দুই মাস আগের ঘটনা।
চুক্তি অনুসারে, ব্ল্যাংক কার্ড তৈরি করে তাতে নাগরিকের তথ্য ইনপুট দিয়ে ইসি’র কাছে হস্তান্তর করার কথা। অবার্থার প্রথমে কিছু কার্ড ফ্রান্সে ও কিছু কার্ড চীনের সেনজেন প্রদেশে স্থাপিত তাদের কারখানা থেকে তৈরি করে দেয়। সেগুলোর ভেতরে সাব কন্ট্রাক্টে নাগরিকদের তথ্য ইনপুটের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি। এ প্রতিষ্ঠানের কাছে ইসি’র এনআইডি সার্ভারের পাসওয়ার্ড রয়েছে। ওই পাসওয়ার্ড দিয়ে তারা সার্ভারের একটি অংশে প্রবেশ করে তথ্য নিয়ে তা স্মার্টকার্ডে কাস্টমাইজেশন করতে পারে।
এ পর্যন্ত ১৩ শতাংশ কার্ড কাস্টমাইজেশন করেছে প্রতিষ্ঠানটি, যেখানে অবার্থার কার্ড তৈরি করে দিয়েছে ৬০ মিলিয়ন বা ৬ কোটির মতো। ওই ১৩ শতাংশ কার্ডই বর্তমানে বিতরণ করছে ইসি।
অবার্থার কোনো সাড়া না দেওয়ায় বর্তমানে টাইগার আইটিকে দিয়ে কার্ড কাস্টমাইজেশন প্রক্রিয়াও আপাতত বন্ধ রেখেছে ইসি। কেননা, সার্ভারের একটি অংশের পাসওয়ার্ড এখনো টাইগার আইটি’র কাছে রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ফরাসি কোম্পানিটি চুক্তির শর্ত অনুসারে ক্ষতিপূরণ, পাসওয়ার্ডসহ সবকিছু বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত এ অবস্থায়ই থাকবে স্মার্টকার্ড উৎপাদন।
ইসি’র এনআইডি শাখার মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘অবার্থার যা ইচ্ছা তাই করেছে। চুক্তির শর্ত তারা মানেনি। ২৫ বার তাগাদা দিলেও সাড়া দেয়নি। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না। আমরা তাদের সঙ্গে বসার জন্য চিঠি দিয়েছি। এখনো জবাব দেয়নি’।
‘স্মার্টকার্ডের জন্য আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর অ্যানহেন্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিস (আইডিইএ) প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি। ওই টাকা জনগণের টাকা। কাজেই আমরা এখন হার্ডলাইনে আছি। চুক্তি অনুসারে সবকিছু বুঝিয়ে না দিলে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা হবে’।
তিনি বলেন, ‘গত ৫ দিন ধরে কাস্টমাইজেশনের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে, যেন কেউ কোনো ঘটনা না ঘটাতে পারে। কেননা, সার্ভারের একটি অংশের পাসওয়ার্ড টাইগার আইটি’র কাছে রয়েছে’।
‘স্মার্টকার্ড প্রকল্প বন্ধ হবে না। এটি জনগণকে দেওয়া হবে। আর অবার্থারের কাছ থেকে সবকিছু বুঝে নেওয়ার পর দেশি প্রতিষ্ঠান দিয়েই এ কার্যক্রম চালাবো’- যোগ করেন সাইদুল ইসলাম।
আরও পড়ুন ** স্মার্টকার্ড প্রকল্পের অর্থ ফেরত যাওয়ার শঙ্কা
২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় আইডিইএ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল। সে সময় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১৭০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তার চুক্তি করেছিল নির্বাচন কমিশন। চুক্তি অনুসারে ৯ কোটি ভোটারের স্মার্টকার্ড সরবরাহ করার কথা ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে করা হয়েছে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ কার্যক্রম শেষ না করতে পারলে চুক্তি অনুসারে একটি বিরাট অংকের টাকা ফেরত যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তখন সরকারের তহবিল থেকেই স্মার্টকার্ড সরবরাহ করতে হবে।
এ টি এম শামসুল হুদা সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আমরা খুব ভালো একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। কিন্তু এ টাকাটা ফেরত গেলে খুবই কষ্টকর হবে। কেননা, টাকা ফেরত গেলে সরকারের তহবিল থেকে তা ব্যয় করতে হবে। যা সরকার অন্য কোনো জনকল্যাণে কাজে লাগাতে পারবে। কাজেই এটি রাষ্ট্রের ক্ষতি’।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৫ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৭
ইইউডি/এএসআর