প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদার সভাপতিত্বে সোমবার (৩১ জুলাই) ইসির সভাকক্ষে বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া সংলাপ শেষ হয় ৪টার দিকে। এতে ৩৫ জনের মত বিশিষ্টজন অংশ নেন।
সংলাপ থেকে বেরিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন, না ভোটের পুনঃপ্রবর্তন, নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করা। এরমধ্যে না ভোট পুনঃপ্রবর্তন ও সেনা মোতায়েনের বিষয়ে প্রায় সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন।
তিনি বলেন, ইসিকে জনগণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। দৃঢ় স্বাধীন ভূমিকা দিয়ে তাদের মানুষের কাছে দৃশ্যমান করতে হবে এবং তাদেরও তা প্রমাণ করতে হবে। নির্বাচনী আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে অনেক দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। প্রশাসন কীভাবে নিরপেক্ষ থাকবে এবং তাদের নিরপেক্ষ রাখতে ইসি কীভাবে ভূমিকা রাখবে, তা দেখতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় জানান, তফসিল ঘোষণার আগে ইসির করার কিছু নেই- এমন বক্তব্যকে আমরা অনেকে গ্রহণ করিনি। এখন থেকে ইসির অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। ধর্মকে নির্বাচনী প্রচারে কোনোভাবেই নেওয়া যাবে না। না ভোট চালুর বিষয়ে ব্যাপক ঐকমত্য রয়েছে। সেনাবাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে রাখতে হবে। এ দু’টো বিষয়ে ভিন্নমতও এসেছে আলোচনায়।
তিনি জানান, নির্বাচনী ব্যয়কে নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি রাখতে হবে। প্রয়োজনে আলাদা আইন করতে হবে।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- ইসির বন্ধু রাজনৈতিক দল নয়, ইসির বন্ধু হল জনগণ, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও আইন-আদালত। নির্বাচনকালীন-নির্বাচনোত্তর সহিংসতা রোধের ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে আলোচনায়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন হচ্ছে সুপার পলিটিক্যাল ইভেন্ট। এ নির্বাচনের মাধ্যমে দলগুলো ফল ঘরে তোলে। কিন্তু এখনকার সংকট দূর করে নির্বাচনী কৌশলে আসতে হবে। সংলাপে না ভোট ও সেনা মোতায়েনের বিষয়ে অনেকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। সেনাবাহিনী যদি রাস্তা বানাতে পারে, তবে কেন ভোটের সময় থাকতে পারবে না। নির্বাচনকে ঘিরে ভোটার, প্রার্থী, প্রস্তাবক-সমর্থক, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ভয়ে থাকে। ভয়মুক্ত নির্বাচন করতেই সেনা মোতায়েনের বিষয়টা গুরুত্ব পেয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সংলাপে যে তিনটি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে এগুলো হলো- সেনা মোতায়েন, না ভোট পুনঃপ্রবর্তন ও নির্বাচনের সময় ৩০০ সংসদীয় আসন ভেঙে দেওয়া। আমি বলেছি- ইসিকে সক্রিয় হতে হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। অভিযোগ আমলে নিয়ে তার প্রতিকার করতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে ৩০০ সংসদীয় আসন ভেঙে দিতে হবে। কেননা, ৩০০ আসনে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থেকে প্রভাবমুক্ত নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন এককভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। এজন্য সরকার-প্রশাসনের সহযোগিতা দরকার। এজন্য ইসির মতো দলগুলোকে সংলাপে বসতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দীন খান বলেন, সব দলকে ভোটে আনতে হবে এবং তাই সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে আইনে ঘাটতি থাকলে তার ব্যবস্থা নেবেন। নাগরিক প্রতিনিধিরা সঙ্গে থাকবেন। আগামীতে ১ কোটি প্রবাসী নাগরিককে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরির করার কথাও বলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়র অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান, ইসিকে তার ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে হবে, বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। কমিশনকে সক্রিয় হতে হবে। সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে হবে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট ও ভোটারের মনে যে ভয়ভীতি রয়েছে তা দূর করতে হবে- এই বিষয়গুলো কোনো দ্বিমত ছিল না।
তিনি বলেন, সাবেক আমলাদের অনেকে সেনাবাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় না রাখার জন্যও বলেছেন। তবে বেশিরভাগ এর পক্ষে ছিলেন।
আসিফ নজরুল আরও বলেন, সহায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা উঠলেও অনেকে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়েছেন। সেনাবাহিনী মোতায়েন, প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো, ভয়ভীতি-শঙ্কা দূর করতে ইসি আসলে কোনো পদক্ষেপ নেয় কিনা সবার দেখার বিষয় হয়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, কেউ কেউ বলেছেন এ নিয়ে ইসির কথা বলা উচিত নয়। আমাদেরও কথা বলা উচিত নয় বলে কেউ কেউ বলেছেন। ইসি চেষ্টা করেছে সবার বক্তব্য শোনার। সবচেয়ে বড় কথা হল- এখন ইসি কী পদক্ষেপ নেয় তা দেখার বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, আগের ইসি তাদের কাজকর্মে ইমেজ সঙ্কটে পড়েছিল। আমরা চাই বর্তমান ইসি ভাবমূর্তি সংকট কাটিয়ে ওঠে যেন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে সে ব্যবস্থা নেবে। তারা যেন রাজনৈতিক দলের কাছে মাথা নত না করে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সঠিক দায়িত্ব পালন করে এটাই সবার চাওয়া।
আসিফ নজরুল জানান, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা যায় কিনা বিবেচনা করার জন্য বলা হয়েছে। যেহেতু ডিসিরা রিটার্নিং অফিসার থাকেন, সেজন্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা সুবিধা পেয়েছে এবং বিএনপি সরকারের আমলে যারা সুবিধা পেয়ছে, তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।
ঢাবির আরেক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ভোটের সময় সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারলেই জনগণ সন্তুষ্ট থাকবে। এক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে। ভোটে সেনা মোতায়েন করার কথা এলেও তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার কথা ওঠেনি। ইসি সঠিকভাবে কাজ করলে কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের পছন্দ করবে না। তবে জনগণকে তারা পাশে পাবে।
প্রবাসী নাগরিকদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করার বিষয়টি আলোচনায় ওঠে এসেছে বলেও জানান তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত অলিউর রহমান বলেন, আলোচনায় মূল ফোকাসটা দেওয়া হয়েছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে। আমরা যেন সবার অংশগ্রহণে ভোট দেখতে পাই। অনেকে বলেছেন তত্ত্বাধায়ক সরকার আনা হোক। কিন্তু এটা আনা সম্ভব না, এটা ডেড ইস্যু। সহায়ক সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
সাবেক এ কূটনীতিক বলেন, সেনাবাহিনী নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে- তবে তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া ঠিক হবে না। সেনাবাহিনীকে ভোটে আনার দরকার নেই। পার্লামেন্টে ভেঙে দেওয়ার কথা তুলেছে-আমরা বলেছি ভেঙে দেওয়া যাবে না। কেননা, এতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৭
ইইউডি/এইচএ/