পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, এ পর্যন্ত সংলাপে আসা সুপারিশগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সবচেয়ে বেশি সেনা মোতায়েনের পক্ষে এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিপক্ষে সুপারিশ করেছেন।
গত ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের মাঠে মোতায়েনের সুপারিশ করেন।
এরপর ১৬ ও ১৭ আগস্ট সংলাপে অংশ নিয়ে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা বলেন, প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন করতে। তবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিরা সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে মতামত দেন। এছাড়া তারা ইভিএম নিয়ে কোনো আলোচনাও করেননি। তবে সীমনা পুনর্নির্ধারণের না করার জন্য সুপারিশ করেছেন।
গত ২৪ আগস্ট শুরু হয় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ, যা শেষ হয় বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর)। প্রতিটি দলই সংলাপে অংশ নেয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই দলই সেনা মোতায়েনের পক্ষে এবং বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিপক্ষে ও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোটগ্রহণ না করার সুপারিশ করে।
সংলাপে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট-জাতীয় পরিষদের অধীনে ভোটগ্রহণের প্রস্তাব করে।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন, নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে ভোটগ্রহণ চায়।
খেলাফত মজলিশ অন্তর্বতী সরকারের জন্য সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সংলাপের আয়োজন, বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা, ইভিএম বাদের সুপারিশ করে।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ইভিএম ব্যবহার না করার সুপারিশ করলেও সেনা মোতায়েন নিয়ে কোনো প্রস্তাব দেয়নি।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, নির্দলীয় সরকারের পক্ষে এবং সেনা ও ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থায় নেয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখ) এবং বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টও (মোমবাতি) সেনা মোতায়েন ও অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এবং ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে এরা কোনো মতামত দেয়নি।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস অস্থায়ী সরকার গঠন ও সেনা মোতায়েন করে ভোটগ্রহণের সুপারিশ করে।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নির্দলীয় সরকারের অধীনে সেনা মোতায়েন করে ভোটগ্রহণ এবং সব দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সীমানা পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ করে।
ইসলামিক ফ্রন্ট সুপারিশ করে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করার জন্য। একই সঙ্গে দলটি সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন করার পক্ষে।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি সর্বদলীয় সরকার, জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া, বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েনের এবং ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, ভোটার সংখ্যা অনুপাত এবং প্রশাসনিক এরিয়া বিবেচনায় সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের সুপারিশ করে। তবে এ দল দুটি ইভিএম নিয়ে কোনো সুপারিশ করেনি।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) নিরপেক্ষ সরকার, বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা, ইভিএম বাদ দেওয়া এবং ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনী এলাকা পুন:নির্ধারণের সুপারিশ করে এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি (পিডিপি) সেনামোতায়েন, ইভিএম বাদ ও সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যা ও আয়তন বিবেচনায় নেয়ার সুপারিশ করে।
গণফোরাম সর্বদলীয় পর্যবেক্ষক দল গঠন, ইসিকে বিচারিক ক্ষমতা প্রদানের সুপারিশ করে। বাংলাদেশ মুসলিম লীগ চায় নির্বাচনকালীন সরকার, ইভিএম বাদ এবং বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন, ইভিএম বাদের সুপারিশ করেছে।
বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ইভিএমে ভোটগ্রহণের সুপারিশ করে। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ নারীর জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন বরাদ্দকরণ, সেনা নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম চালুর সুপারিশ করে। জাকের পার্টি হ্যাকিং প্রটেকটেড ইভিএমে ভোটগ্রহণের প্রস্তাব করলেও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন ও সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে কোনো প্রস্তাব নেই বলে ইসিকে জানায়।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সীমানা পুনর্নির্ধারণ না করার এবং ইভিএম ব্যবহারের সুপারিশ করে। তবে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে মতামত দেয় দলটি। এদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা, অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকারের অধীনে ভোটগ্রহণের সুপারিশ করে।
জাতীয় পার্টি-দশম সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, জাপা সারাদেশে সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েন, সংসদে ভাঙ্গার সুপারিশের পক্ষে মতামত দেয়। বিকল্পধারা বাংলাদেশ নবম সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে গঠিত সরকারের অধীনে ভোটগ্রহণ এবং সেনা মোতায়েনের সুপারিশ করে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বর্তমান সরকারের অধীনে ভোটগ্রহণ এবং নারীদের জন্য সংসদে ৩৩ শতাংশ আসন রেখে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা চায়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ‘না-ভোট’ চালু ও সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে ভোটগ্রহণ চায়। গণতন্ত্রী পার্টি চায় বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন, আর ইসলামী ঐক্যজোট স্পর্শকাতর এলাকায় সেনা চায়।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন, প্রয়োজনে সেনা, ধর্মীয় দলের নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ, ক্ষেত্র বিশেষে জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা, আয়তন, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও প্রশাসনিক সুবিধা অনুসারে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ ও সীমিত আকারে ইভিএম ব্যবহারের সুপারিশ করে।
বিএনপি সংলাপে এসে দলীয় সরকারের অধীন এবং ইভিএম বা ডিভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন না করার সুপারিশ করে। একই সঙ্গে দলটি সেনা মোতায়েন চায়। অন্যদিকে ২০০৮ সালের আগের সীমানা ভোটগ্রহণ করার সুপারিশ করে।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ চায় নিরপেক্ষ সরকার ও ইভিএম এবং আদমশুমারির পরিবর্তে ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে আসনের সীমানা নির্ধারণ। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল-এমএল চায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার, সেনা না মোতায়েন, ইভিএমে ভোটগ্রহণ।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি চায় সেনা মোতায়েন, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা আর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট চায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার ও সেনা মোতায়েন, ‘না-ভোট’ ।
এদিকে আওয়ামী লীগ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সজ্ঞায় সেনাবাহিনী চায় না। তবে দলটি বর্তমান সীমানায় নির্বাচন এবং এতে ইভিএমে ভোটগ্রহণ চায়।
জাতীয় পার্টি-জেপি চায় সংবিধান অনুযায়ী ভোট, প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন, ইভিএম নয় এবং সংসদীয় আসনের বর্তমান সীমানা বহাল। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) বলেছে-সেনা অপরিহার্য এবং সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন নেই। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে এ দলটি কোনো প্রস্তাব দেয়নি।
এসব সুপারিশ ছাড়াও ‘না-ভোট’ চালু, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, কালো টাকা ও পেশিশক্তি মুক্ত নির্বাচন, দলীয় সুবিধাপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্কতাদের নির্বাচনী দায়িত্ব না দেওয়া, অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল এবং রাজনৈতিক মামলা থেকে নেতাকর্মীদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশগুলোও বেশ জোরেশোরেই তুলেছে অংশীজনরা।
এদিকে প্রধান নির্বাচন কশিমনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা জানিয়েছেন, সংলাপে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, সেগুলোর মধ্যে ইসির এখতিয়ারভুক্তগুলোর ওপর আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আর যেগুলো সরকারের দায়িত্ব, সেগুলো সরকারকেই সুপারিশ করা হবে। এজন্য সংলাপে আসার সুপারিশ একীভূত করে সরকারের কাছে পাঠানো হবে।
আগামী ২৪ অক্টোবর নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে ইসির এবারের সংলাপ শেষ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৭
ইইউডি/জেডএম