সোমবার (২৩ অক্টোবর) প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে নারী নেত্রীরা এমন সুপারিশ করেন। এ সময় ইসির নির্বাচন কমিশনাররা এবং সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপ থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের (সবার জন্য সমান সুযোগ) যে কথা বলা হয়, তা কেবল রাজনৈতিক দলের জন্য। তাই সবার জন্য সুযোগ তৈরি করা বলতে তা নারী-পুরুষ সবার জন্য করতে হবে। বাংলাদেশে নারীদের জন্য ‘সমান সুযোগ’ নেই। কেন না, তারা নিরাপত্তা, চলাফেরা, রাজনৈতিক দলগুলো থেকে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকার পায় না। নারীরা উত্তরাধিকার না হওয়ার কারণে স্বাধীনভাবে নির্বাচনও করতে পারে না। তাই নির্বাচন কমিশনের কাছে নারী ও দরিদ্র মানুষের প্রশ্নে ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছি।
তিনি বলেন, নির্বচন কমিশনে ৪০টি দলের নিবন্ধন আছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে- প্রত্যেক দলের সকল পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য ২০২০ সালের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রয়েছে। কয়েকটি দল ইসির সংলাপে এসে দাবি করেছে-এই বিধান তুলে দেওয়ার জন্য, যা বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী। সুতরাং আমরা যে সকল দলের গঠনতন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের মূল চেতনা বিরোধী, সকল নাগরিকদের সমান অধিকার বিরোধী, সে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।
প্রিপ ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক অ্যারোমা দত্ত বলেন, এবার দেখা যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের ভোটার এসেছে। তাদের মধ্যে নারী অংশীদারিত্বের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। কারণ নতুন প্রজন্ম একটা বড় ফ্যাক্টর। নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময় যেন ভালো করে নির্বাচন কমিশন নারীদের সাপোর্ট দেয়, যেন কোনো রকম সহিংসতা না ঘটে।
মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজের পরিবেশ দেওয়ার বিষয়েও নির্বাচন কমিশনের কাছে তারা সুপারিশ করেছেন বলে জানান তিনি।
এছাড়া সংসদে এক-তৃতীয়াংশ নারী আসন বরাদ্দ ও এতে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা, ভোটে নারীদের বেশি করে মনোনয়ন, ‘না ভোট’ রাখার বিধান এবং মসজিদে নারীদের ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করার বিষয়টি প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশও করেন তারা।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রে জেনারেল সেক্রেটারি পারভীন সুলতানা ঝুমা বলেন, ৫২ শতাংশ নারী ভোটারের অংশগ্রহণের একটি নির্বাচিত সংসদ আসবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সেই নারীদের যেন চাপ প্রয়োগ করা না হয়। তাদের যেন সম্মানের সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা হয়, সে সুপারিশ করার কথাও বলেন তিনি।
সংলাপে ২২ নারীনেত্রীকে অংশ নিতে নির্বাচন কমিশন আমন্ত্রণ জানালেও ১৩ জন অংশ নিয়েছেন। ৪০ শতাংশের বেশি প্রতিনিধি কেন অংশ নেননি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে উপস্থিত নারী নেত্রীরা সমস্বরে বলেন, অনুপস্থিতরা নিশ্চয় কোনো সমস্যার কারণে অংশ নিতে পারেননি। এখানে আমাদের ইউনিটির কোনো সমস্যা নেই। আমরাই তাদের প্রতিনিধিত্ব করছি।
সংলাপে উপস্থিত অন্য নারী নেত্রীরা হলেন- বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু ও রেখা চৌধুরী, ডিজ্যাবল্ড রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড রিসার্স এসোসিয়েশনের (ডিআরআরএ) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব উইমেন ফর সেলফ এমপাওয়ারমেন্টের (বাউশী) এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মাহবুবা বেগম, ফর ইউ ফর এভারের (ফাইফে) প্রেসিডেন্ট রেহানা সিদ্দিকী, নারী উদ্যোগ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মাসহুদা খাতুন শেফালী, নারী নেত্রী ফাতেমা আক্তার, নাসরিন বেগম, রীনা সেন গুপ্ত ও মনসুরা আক্তার।
গত ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এবং ১৬ ও ১৭ আগস্ট গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে বসেছিল ইসি। এরপর গত ২৪ আগস্ট থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৪০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ শুরু করে নির্বাচন কমিশন। রোববার (২২ অক্টোবর) নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সঙ্গেও সংলাপ করেছে সংস্থাটি।
সংলাপে আসা সুপারিশগুলোর মধ্যে ভোটার তালিকা নিরীক্ষা, ভোটার দিবস উদযাপন, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণের সুপারিশ,রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন ও পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধন না দেওয়া বা বাতিল করা, সারাদেশে সেনা মোতায়েন, সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, বিচারিক ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন না করা, না-ভোটের প্রর্বতন, প্রবাসে ভোটাধিকার প্রয়োগ, জাতীয় পরিষদ গঠন, র্বতমান সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন, নবম সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে অন্তর্বতী সরকার গঠন, দশম সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার গঠন, নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও নির্বাচনকালীন সময়ে ইসির অধীনে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ, ইভিএম ব্যবহার না করা, অষ্টম সংসদ নির্বাচনের সীমানায় একাদশ সংসদ নির্বাচন, সংসদীয় আসনের সীমানা একাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে পুনর্নির্ধারণ না করা, দলের নির্বাহী কমিটিতে বাধ্যতামূলকভাবে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিধান তুলে নেওয়া ইত্যাদি অন্যতম।
আগামী ২৪ অক্টোবর সংলাপ হবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৭
ইইউডি/আরআই