ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

হাতিয়ায় ভোটকেন্দ্রে ভরসা টর্চ লাইট, চিন্তা দস্যু নিয়েও

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৮
হাতিয়ায় ভোটকেন্দ্রে ভরসা টর্চ লাইট, চিন্তা দস্যু নিয়েও

হাতিয়া থেকে ফিরে: মেঘনার মোহনায় বঙ্গোপসাগরে বেশ কিছু দ্বীপ নিয়ে গঠিত নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা। ২ হাজার ১০০ বর্গ কিলোমিটারের এই উপজেলা নিয়ে নোয়াখালী-৬ সংসদীয় আসন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সারাদেশের মতো এখন সরব হাতিয়াও। মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা। চায়ের দোকান থেকে ঘাটের আড্ডা, সব জায়গায় আলোচনা হচ্ছে ভোটের হিসাব-নিকাশ নিয়ে। 

প্রার্থীদের পাশাপাশি ব্যস্ত সময় পার করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। হাতিয়া উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ে দিনভর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যস্ততা।

ব্যালট বাক্স আনা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি চলছে অন্যান্য কার্যক্রমও।

তবে এই নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তাও রয়েছে কিছুক্ষেত্রে। উদ্বেগ, ভয়-ভীতি রয়েছে ভোটারদের মধ্যেও। যদিও পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোনো ভয়-ভীতি বা শঙ্কার কারণ নেই। সুষ্ঠু ভোট করতেই বদ্ধপরিকর প্রশাসন।

হাতিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্র জানায়, এই উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫৪ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ২৫ হাজার ৯ জন এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৪৫ জন। মোট ভোট কেন্দ্র ৭৭টি।  

ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের প্রধান চিন্তা বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে। আর ভোটারদের উদ্বেগ-শঙ্কা জলদস্যুদের নিয়ে। এখানকার বাসিন্দাদের ভাষ্যে, সূর্য ডুবলে হাতিয়া দ্বীপের বেশির ভাগজুড়েই অন্ধকার নেমে আসে। দ্বীপের ৭ লাখ বাসিন্দার মধ্যে বিদ্যুৎ আছে ৩০ হাজারের ঘরে। জেনারেটরের মাধ্যমে পাওয়া এই বিদ্যুৎ থাকে আবার দিনে ছয় ঘণ্টার মতো।

আর ৭৭টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৬টি ভোটকেন্দ্র বিদ্যুতের আওতায় আছে। বাকিগুলোতে ভরসা টর্চ লাইট। অর্থাৎ এই সিংহভাগ কেন্দ্রেই ভোট নিতে হবে টর্চ লাইটের আলোয়, যেজন্য কেন্দ্রগুলোকে অতি গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে।

কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাতিয়ায় জেনারেটরের বিদ্যুৎ আছে শুধু চর কৈলাশের হাতিয়া শহর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, ওছখালী কেএস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, বেজুগালিয়া বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লক্ষীদিয়া রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও প্রকৌশলী ফজলুল আজিম মহিলা ডিগ্রি কলেজ ভোটকেন্দ্রে।

যেসব কেন্দ্রে টর্চ লাইটে কার্যক্রম চলে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পশ্চিমা চরকৈলাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম লক্ষীদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নলচিরা ভূঞার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চৌমুহনী তবারকিয়া  ইসলামি আলিম মাদ্রাসা, দক্ষিণ বিরবিরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিরবিরি সেন্টার বাজার, দক্ষিপূর্ব ম্যাকপার্শ্বান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুখচর মোজাহারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হরনী বাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেডক্রিসেন্ট সাইক্লোন শেল্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বন্দরটিলা বাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, লামছি তোফালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শূন্যেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এছাড়া কিছু কিছু ভোটকেন্দ্র রয়েছে মূল হাতিয়া দ্বীপ থেকেও অনেক দূর। সেখানে যেমন বিদ্যুৎ নেই, তেমনি পৌঁছাতে হয় ট্রলার অথবা স্পিড বোটে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নিঝুমদ্বীপ বিদ্যানিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলীবাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বয়ারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বয়ারচর হাতিয়া বাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বয়ারচর দিদার বাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বয়ারচর আদর্শগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এ প্রসঙ্গে হাতিয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, হাতিয়া উপজেলায় ৭৭টির মধ্যে ৬টি বাদে সবগুলোই অতি গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্র। কারণ ৭১টি ভোট কেন্দ্রে কোনো বিদ্যুৎ নেই, এগুলোতে টর্চ লাইটই ভরসা। এ কারণে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে ওসব কেন্দ্রগুলো ঘিরে। ’

জাকির হোসেন বলেন, ‘জানি না কতোক্ষণ টর্চ ও সোলার দিয়ে ব্যাকআপ দিতে পারবো। রাত ১টার পর কিন্তু পুরো হাতিয়া মানেই অন্ধকার। মোবাইল চার্জ দিতেও এখানে পাঁচ টাকা লাগে। এখানকার জীবনযাত্রা বাংলাদেশের অন্য জেলার চেয়ে ভিন্ন। সুতরাং এখানে ভোট মানেই চ্যালেঞ্জ। সব দলের সহায়তা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভোট করা কঠিন। নিঝুম দ্বীপ ও মৌলভীরচরে যাতায়াতের পথ হচ্ছে নদী। সড়কগুলোর বেশির ভাগই ভাঙাচোরা। ফলে ভোট শেষে ব্যালট বাক্সগুলো উপজেলা কার্যালয়ে নিয়ে আসাটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। ’

এদিকে উপকূলে জলদস্যুদের উৎপাতের কারণে নির্বাচন ঘিরে ভোটারদের উদ্বেগও বাড়ছে। যদিও আগের চেয়ে দস্যুদের ত্রাস অনেকখানিই কমে গেছে। ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর হাতিয়ার বয়ার চরের চতলার ঘাটে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চিহ্নিত জলদস্যু সাইফুল ইসলাম (বাহিনী প্রধান, ৩৫) ও তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সফিক (২৪) নিহত হন। এদের প্রভাব ছিল হাতিয়াজুড়ে। এখন সুখ চরের আলাউদ্দিন ও তার দুই ভাই নাজিম ও সালাউদ্দিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এলাকা। চরকিংয়ের বাবুল ফকির, পিনাবাজারের রিয়াজ, ভৌরব বাজারের আবু তাহের, কাইয়ুম ও মুরাদও ভয়ের কারণ।

হাতিয়ার ভোটাররা বলছেন, জলদস্যুদের কোনো দল নেই, কিন্তু এরা প্রয়োজনে যে কোনো দল ও ব্যক্তির হয়ে মাঠে নামে। রাজনৈতিক স্বার্থে এদের ব্যবহার করা হয়।

নাম প্রকাশ না করা স্বর্থে হাতিয়ার এক স্কুল শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেক জলদস্যু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। অনেকের আবার কাজের ধরন পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন ‘ভাইয়ের’ আশ্রয়ে অনেকে আছে। এসব জলদস্যুদের ভয়ে আছি আমরা। এদের কারণে ভোট দিতে পারি না। অনেক সময় জলদস্যু ভোটের বাক্স নিয়ে পালায়। ’

অবশ্য নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ করতে তিনটি তালিকা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে একটি সন্ত্রাসী, একটি জলদস্যু ও একটি রাজনৈতিক ব্যক্তির তালিকা।

হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান সিকদার বাংলানিউজকে বলেন, ‘হাতিয়ায় এখন কোনো জলদস্যু নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুবই ভালো। আশা করছি শান্তিপূর্ণ একটা ভোট উপহার দিতে পারবো। ’

গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আয়েশা ফেরদাউস এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এর আগের নবম সংসদ নির্বাচনে বড় দুই দলের প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী ফজলুল আজিম। তারও আগে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন মোহাম্মদ আলী।  

এবারের নির্বাচনে প্রধান দুই দলের প্রার্থীই হাতিয়াকে সন্ত্রাসী ও জলসদস্যু মুক্ত করার পাশাপাশি বৈদ্যুতিক সুবিধার আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী আয়েশা ফেরদাউস বলেন, ‘জলদস্যুদের কোনো দল নেই। আমরা অনেকটা নির্মূল করতে পেরেছি। আমি পুনরায় নির্বাচিত হলে হাতিয়াকে শতভাগ সন্ত্রাসমুক্ত করার পাশাপাশি শতভাগ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা করবো। ’

বিএনপির প্রার্থী ফজলুল আজিম বলেন, ‘আমিই হাতিয়া থেকে জলদস্যু মুক্ত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। এখন আবারও হাতিয়া সন্ত্রাসীতে ভরে গেছে। বর্তমানে মানুষের নিরাপত্তা নেই। আমি নির্বাচিত হলে একটা জলদস্যুও থাকবে না। আর বিদ্যুৎ আনার জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় একটি প্রকল্প শুরু করেছিলাম। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সেই প্রকল্পের খবর নেই। জনগণ আমাকে নির্বাচিত করলে শতভাগ বিদ্যুতের ব্যবস্থা করবো। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৮
এমআইএস/এইচএ/

** ভাঙন আর বিদ্যুৎ সমস্যা থেকে মুক্তি চান হাতিয়ার ভোটাররা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।