আগামী পাঁচ বছরের জন্য জাতীয় সংসদে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন দেশবাসী। এবার মোট ১ হাজার ৮৬১ জন প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন।
৬৪ জেলায় জাতীয় সংসদের ২৯৯টি আসনের ৪০ হাজার ১৮৩ কেন্দ্রে বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলবে। সকাল ৮টায় শুরু হওয়া ভোটগ্রহণ বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে। তবে ভোটকেন্দ্রের চৌহদ্দিতে যারা থাকবেন তাদের ভোট এরপরও নেওয়া হবে।
তবে গাইবান্ধা-৩ আসন একজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় সেখানে ভোট স্থগি করেছে ইসি। ওই আসনে আগামী ২৭ জানুয়ারি ভোটের পুনরায় তফসিল দেওয়া হয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদে ২৯৯ আসনের ভোটের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গঠন হবে। যে দল বা জোট ১৫১ আসন পাবে, তারাই সরকার গঠন করবে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে এরই মধ্যে দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। মহানগর এলাকার ভোটাররা ইসির ওয়েবসাইট এবং ১০৫ নম্বরে মেসেজ করে ভোটার নম্বর ও কেন্দ্রের নাম জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে নির্বাচন সংস্থাটি।
এবার খালেদা জিয়াকে ছাড়া প্রথমবারের মতো গণফোরাম সভাপতি ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি। শুধু তাই নয়, এই নির্বাচনে অনিবন্ধিত দলের নেতারাও নিবন্ধিত দলের প্রতীকে নির্বাচনে লড়ছেন।
২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে কমপক্ষে তিন বছর কোনো নিবন্ধিত দলের যে কোনো কমিটিতে থাকার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ থেকে বাদ দেওয়ায় দলছুট এবং নিবন্ধিনহীনরাও একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়।
সে সুযোগ নিয়ে বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর ২২ নেতা, মাহমুদুর রহমান মান্না ও গোলাম মাওলা রনিসহ কয়েকজন। এবার দলীয় বা জোটের প্রার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৭৩৩ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ১২৮ জন।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার যুগ্ম সচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান জানান, আওয়ামী লীগ ও শরিকদের মিলিয়ে নৌকা মার্কায় ২৭২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর বিপরীতে ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপি ও শরিকদের প্রার্থী রয়েছেন ২৮২ জন। আর সবচেয়ে বেশি প্রার্থী রয়েছে হাতপাখা প্রতীকের ইসলামী আন্দোলনের। এই দলটি ২৯৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা এরই মধ্যে সব ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাওয়ার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালনে কারও শিথিলতার কারণে সহিংসতা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
গত ৮ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন সিইসি। প্রথমে ২৩ ডিসেম্বর ভোটের দিন নির্ধারণ করা হয়।
পরবর্তীতে বিভিন্ন দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১২ নভেম্বর এ নির্বাচনের পুনরায় তফসিল ঘোষণা করা হয়। তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল ২৮ নভেম্বর, বাছাইয়ের সময় ২ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহার ৯ ডিসেম্বর এবং ভোটগ্রহণ ৩০ ডিসেম্বর।
সংসদ নির্বাচনে ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোট কেন্দ্রের ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি ভোটকক্ষে ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫জন এবং নারী ভোটার রয়েছেন ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২জন। তরুণ ভোটার রয়েছেন ১ কোটি ২৩ লাখের মতো।
ভোটের মাঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৮ লাখ সদস্য:
ভোটের দিন পুলিশ, অঙ্গীভূত আনসার, ব্যাটালিয়ন আনসার, গ্রাম পুলিশ নিয়ে কেন্দ্র প্রতি গড়ে ১৫ জন করে মোট ৬ লাখ ২ হাজারের মতো বাহিনীর সদস্য থাকছেন। এছাড়া সশ্রস্ত্র বাহিনীর প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের মতো সদস্য মোতায়েন রয়েছে। বিজিবি সদস্য রয়েছেন ৪০ হাজারের মতো।
এছাড়া র্যাব, পুলিশ ও কোস্ট গার্ডের ভ্রাম্যমাণ টিম এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রায় ৫০ হাজারের মতো সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন।
ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা ভোটগ্রহণের আগে দুইদিন ও পরে দুইদিন মোট পাঁচদিনের জন্য মাঠে থাকবে। গ্রাম পুলিশ ভোটের আগে পরে চারদিন, অঙ্গীভূত আনসার ছয়দিন, র্যাব ও আর্মড পুলিশ ২৬ ডিসেম্বর থেকে এবং বিজিবি ১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোতায়েন থাকবে। আর সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের গত ২৪ ডিসেম্বর মোতায়েন করা হয়। তারা মাঠে থাকবেন ২ জানুয়ারি পর্যন্ত।
নির্বাচনে নিয়োগ করা হয়েছে ৪ হাজার ২১ জন ম্যাজিস্ট্রেট। এর মধ্যে নির্বাচন তদন্ত কমিটিতে ২৪৪জন এবং নির্বাচনী অপরাধে বিচারকাজ পরিচালনায় ৬৪০ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছেন।
অন্যদিকে নির্বাচনী আচরণ বিধি প্রতিপালন ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে নিয়োজিত করা হচ্ছে ৩ হাজার ১৩৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এর মধ্যে প্রতি আসনে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি টিমের সঙ্গে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে।
প্রতি আসনে সশস্ত্র বাহিনীর চারটি টিম মোতায়েন থাকবেন। এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রায় ১ হাজার ১০০ ম্যাজিস্ট্রেট তাদের সঙ্গেই থাকবে। পরিস্থিতির অবনতি হলে তারা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনায় কাজ করবে। অবশিষ্ট ২ হাজাই ২০০ মতো ম্যাজিস্ট্রেট আচরণ বিধি প্রতিপালনের বিষয়টি খেয়াল রাখবেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরেছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা নির্বাচন পরিচালনার জন্য এবং ৪০০ কোটি টাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের বাজেট শাখার কর্মকর্তারা বাংলানিউজকে জানান, বরাদ্দের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি ছাড়িয়ে যাবে। কেননা এবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে ব্যয় দশম সংসদ নির্বাচনের তুলনায় বেড়ে যাবে। গত নির্বাচনে বিভিন্ন বাহিনীর ছয় লাখের মতো ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছিল। এবার তা ৮ লাখে পৌঁছেছে।
প্রিজাইডিং অফিসার ৪০ হাজার ১৮৩ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২জন এবং পোলিং অফিসার ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪জন।
যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা:
ইতোমধ্যে যন্ত্রচালিত যান, হেলিকপ্টারসহ বিভিন্ন যানের চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে ইসি। এক্ষেত্রে শনিবার (২৯ ডিসেম্বর) মধ্যরাত (রাত ১২টা) থেকে ভোটের দিন দিবাগত মধ্যরাত (রাত ১২টা)পর্যন্ত বেবি টেক্সি/অটোরিকশা/ইজিবাইক, ট্যাক্সি ক্যাব, মাইক্রোবাস, জিপ, পিক-আপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পোসহ স্থানীয় যন্ত্রচালিত যানবাহন ও নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
আর শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) দিবাগত মধ্যরাত (রাত ১২টা) থেকে ১ জানুয়ারি দিবাগত মধ্যরাত (রাত ১২টা) পর্যন্ত মোট চারদিন দেশজুড়ে মোটরসাইকেল চালানোয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
তবে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অনুমতি সাপেক্ষে সীমিত আকারে কিছু যান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে দূতাবাসরা কর্মরত দেশি-বিদেশি, বিমানযাত্রী ও তাদের আত্মীয় স্বজনের এয়ারপোর্টে চলাচলের যানবাহন প্রভৃতি নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক:
এবারে নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পাঁচ হাজারের ওপরে সাংবাদিক মাঠে থাকছেন বলে জানিয়েছেন ইসির নির্বাচন জনসংযোগ শাখার পরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান।
এছাড়া দেশি ৮১টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০ পর্যবেক্ষক ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন। আর ফেম্বোসা, এএইএ, ওআইসি ও কমনওয়েলথ থেকে আমন্ত্রিত ও অন্যান্য বিদেশি পর্যবেক্ষক ৩৮ জন, কূটনৈতিক/বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা ৬৪জন এবং বাংলাদেশস্থ দূতাবাস/হাইকমিশন বা বিদেশি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন পর্যবেক্ষণ করবেন।
ইভিএমের মাধ্যমে ৬ আসন:
প্রথমবারের মতো ৬টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) সম্পূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ করছে নির্বাচন কমিশন। প্রায় ৩ হাজার ৩০০ সেনা সদস্য ইভিএম পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছেন। ইভিএমের আসনগুলো হচ্ছে ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, রংপুর-৩, খুলনা-২, সাতক্ষীরা-২ ও চট্টগ্রাম-৯।
ওয়েবসাইট ও মেসেজে ভোটার নম্বর:
এবার মহানগরের ভোটারদের জন্য মোবাইলে মেসেজ দিয়ে ভোটার নম্বর ও ভোট কেন্দ্র জানার ব্যবস্থা করেছে ইসি। এক্ষেত্রে যে কোনো মোবাইল অপারেটর থেকে এসএমএস অপশনে এ গিয়ে PC লিখে একটা স্পেস দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর লিখে ১০৫ নম্বরে পাঠাতে হবে।
এক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর এর স্থানে স্মার্টকার্ডের ১০ ডিজিট বা ১৭ সংখ্যার এনআইডি) নম্বর লিখতে হবে। কারো এনআইডিতে ১৩ ডিজিট থাকলে এসএমএস করার সময় ওই এনআইডি নম্বরের আগে তার জন্ম সাল যোগ করে ১৭ ডিজিট লিখতে হবে।
যেমন- PC xxxxxxxxxx/xxxxxxxxxxxxxxxxx লিখে সেন্ড করতে হবে 105 নম্বরে।
এছাড়া কমিশনের (http://www.ecs.gov.bd) ওয়েবসাইট থেকেও ভোটকেন্দ্রের তথ্য জানুন লিংকে ক্লিক করেও পাওয়া যাবে কার কেন্দ্র কোথায় এবং ভোটার নম্বর কত। আবার ১০৫ নম্বরে কল করেও জানা যাবে কার ভোটার নম্বর ও কেন্দ্র কোনটা।
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৮
ইইউডি/এমএ