ঢাকা: জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) কার্যক্রম ও লোকবল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তর করার ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সম্প্রতি নির্দেশনা দিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তার জবাবে নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিল ইসি কর্মকর্তারা এ কাজে দক্ষ ও পারদর্শী।
ইসির সংস্থাপন শাখার উপ-সচিব মো. এনামুল হকের ৭ জুন স্বাক্ষরিত পত্রটি মঙ্গলবার (০৮ জুন) মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পাঠানো হয়েছে। যার অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবকে দেওয়া হয়েছে।
গত ২৪ মে ইসিকে এনআইডি কার্যক্রম ছেড়ে দিতে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। যার পরিপ্রেক্ষিতে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এই কার্যক্রম ইসির অধীনেই রাখার পক্ষে মতামত দেয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও বিষয়টি নিয়ে পুনরায় আলোচনায় বসার কথা গণমাধ্যমে বলেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পাঠানো পত্রে ইসি তার আটটি যুক্তি তুলে ধরে। এতে উল্লেখ করা হয়—
১. বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ২০০৭-০৮ সালে আদালতের নির্দেশনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দাবির প্রেক্ষিতে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচন কমিশনের এ কার্যক্রমকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রযোজনীয় কনসালট্যান্ট, যন্ত্রপাতি এবং কারিগরি জনবল সরবরাহের জন্য ইউএনডিপি অন্য ৮টি দেশের সহায়তায় পুল ফান্ড সরবরাহ করে। পুল ফান্ডের সহায়তায় ৮.১০ কোটি ভোটারের ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন প্রকল্পের (পিইআরপি) আওতায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশের জন্য একটি কম্পিউটারাইজড ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়।
সংগৃহীত তথ্যভাণ্ডার বারবার ব্যবহার করার লক্ষ্যে একটি ডাটা সেন্টার এবং দ্বৈত ভোটার চিহ্নিত করার লক্ষ্যে একটি এএফআইএস সিস্টেম সেন্টারের সাথে যুক্ত করা হয়। ভোটার তালিকা প্রণয়নকালে ভোটারদের কাছ থেকে সামান্য কিছু বাড়তি তথ্য সংগ্রহ করে ভোটারদের একটি পরিচয়পত্র সরবরাহ করা হয়, যা পরবর্তীকালে জাতীয় পরিচয়পত্রে রূপ নিয়েছে। ভোটার তালিকার জন্য নাগরিকদের সংগৃহীত তথ্য দ্বারা একই জনবল, অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যবহার করে ভোটার তালিকার তথ্য থেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত করা হয়।
পরবর্তীতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই আইনে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ভোটার ডাটাবেইজের তথ্য-উপাত্তকেই ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২. ভোটার তালিকার ডাটাবেইজের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য নির্বাচন কমিশন কনস্ট্রাকশন অফ সার্ভার স্টেশনস ফর দি ইলেকটোরাল ডাটাবেজ (সিএসএসইডি) প্রকল্পের মাধ্যমে ইউএনডিপি ও সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে উপজেলা, জেলা, আঞ্চলিক পর্যায়ে ভৌত অবকাঠামোসহ ইলেকটোরাল ডাটা সার্ভার স্থাপন করে। সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী এসব ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে।
৩. সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ সকল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মধ্য থেকে তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজার নিয়োগসহ বিভিন্ন সমন্বয় কমিটি ও বিশেষ কমিটির তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে ভোটারযোগ্য ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে নিয়োগকৃত ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও টিম লিডারের মাধ্যমে বায়োমেট্রিকস ডাটা সংগ্রহ করে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। উপজেলা/থানা পর্যায়ে এই ডাটা সংগ্রহ ও রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোটার তালিকা করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিবছর তথ্য সংগ্রহ করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থাকে এ ধরনের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়নি। ফলে অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থার পক্ষে সব মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করে এ ধরনের মহা কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা সম্ভব হবে মর্মে প্রতীয়মান হয় না। ভোটার তালিকা বিধিমালা, ২০১২ মোতাবেক উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার রেজিস্ট্রেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
৪. বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৯ নং অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের উপর অর্পিত দ্বায়িত্বসমূহ সূচারু ও নির্ভুলভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার অনুদানে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রস্তুতের জন্য মাঠ পর্যায়ের সকল অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এএফআইএস মেচিং সিস্টেম সহ ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হয়।
জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য নির্বাচন কমিশন কোন অবকাঠামো, প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেনি। এসকল অবকাঠামো, প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে।
মাঠ পর্যায়ের অফিসসহ কেন্দ্রীয় ডাটাবেইজ সমূহের জনবল, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সংশোধন, ভোটার এলাকা পরিবর্তন, মৃত ভোটার কর্তন, ইভিএম এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণ কাজের জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো।
এগুলো ছাড়া নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল ভোটার তালিকা, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন, ইলেকটোরাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেস কাজ করছে। এসব যন্ত্রপাতি নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ডাটা প্রসেসিং, ম্যাচিং এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কাগজে ছাপানো লেমিনেটেড পরিচয়পত্র তৈরি করে নির্বাচন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে।
পরবর্তীতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০ এর আলোকে স্থায়ী ও স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহয়তায় আইডিইএ প্রকল্পের মাধ্যমে চিপসসহ প্লাস্টিক স্মার্ট কার্ড তৈরি করে বিতরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ভোটার তালিকার তথ্য ব্যবহার করে বিদেশি একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান স্মার্ট কার্ডগুলো ছাপিয়ে সরবরাহ করেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র কয়েকটি প্রিন্টার ব্যবহার করে স্মার্ট কার্ড ছাপানো হচ্ছে।
বর্তমান পর্যায়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব অন্য কোন মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানের নিকট অর্পণ করা হলে নতুন করে মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অবকাঠামো, প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি সংগ্রহের প্রয়োজন হবে, যা ব্যয় ও সময় সাপেক্ষ।
৫. জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা কোনো জনবল নির্বাচন কমিশনে নাই। ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য কারিগরি জনবল ডাটা প্রসেসিং করে, অন্য দিকে নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সার্বিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটিশনে নিয়োজিত কর্মকর্তারা স্মার্টকার্ড প্রিন্টিংয়ের কাজ করছেন। এসব কর্মকর্তা ২০০৮ সাল থেকে এ কাজের সঙ্গে জড়িত। এই দীর্ঘ ১২ বছর সময়কালে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ ও পারদর্শী করে তোলা হয়েছে। তারা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা।
জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত আলাদা কোনো জনবল না থাকায় এ সকল কার্যক্রম অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছে ন্যস্ত করা হলে মাঠ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিশাল একটি জনবলের প্রয়োজন হবে, যা ব্যয় সাপেক্ষ। একই সঙ্গে তারা দক্ষ এবং পারদর্শী হয়ে না উঠলে জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হবে।
৬. নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে চুক্তির অধীনে প্রায় ১৪৮টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছে ন্যস্ত করা হলে সেবাদান বিঘ্নিত হওয়াসহ আইনানুগ জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
৭. জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন থেকে আলাদা করার লক্ষ্যে ২০০৯-২০১০ সালেও একটি উদ্যোগ নেওয়া করা হয়েছিল। এ লক্ষ্যে একটি সংস্থা কাজ শুরু করলেও উপরে বর্ণিত কারণ সমূহের জন্য তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ফলে তা নির্বাচন কমিশনের নিকট রয়ে যায়। পরবর্তীতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০ এর মাধ্যমে এর কার্যক্রম বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিকট ন্যস্ত করা হয়েছে।
৮. উপরোক্ত বিষয়গুলো জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবস্থাপনায় যে কোনো পরিবর্তন আনার জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। এ বিষয় বিবেচনায় আনা হলে জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্যক্রম ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রাখা সমীচীন হবে মর্মে কমিশন মনে করে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পাঠানো পত্র দেখতে ক্লিক করুন:
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০২১
ইইউডি/এমজেএফ