ঢাকা: ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে (ইউপি) চলমান সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের নেতারা। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে নির্বাচন সম্পর্কে দেশের মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে বলেও মনে করছেন তারা।
ইউপির দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৪০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ভোট গ্রহণের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটেছে এবং এতে ৭ জন নিহতসহ আহত হয়েছেন শতাধিক। এদিন নরসিংদীর রায়পুরায় তিন জন, কুমিল্লার মেঘনায় দুইজন, চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে একজন এবং কক্সবাজারে একজন নিহত হয়েছেন। শুক্রবার (১২ নভেম্বর) সকালে রাজবাড়ীর বাণীবহতে একজন সাবেক চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে নরসিংদী, মাগুরা, রাঙামাটি, ফরিদপুর, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছেন কয়েক শ’ মানুষ।
অতীতে ইউপি নির্বাচনে হতাহতের ঘটনা ঘটলেও এবারের মতো এতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি বলে ১৪ দল নেতারা জানান। সারা দেশে চার হাজারের বেশি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ চার থেকে পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপ পার হতেই এতো রক্তপাতের ঘটনা মারাত্মক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরবর্তী ধাপগুলো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
এবারের নির্বাচনে অধিকাংশ ইউপিতেই আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর বিরোধীতা করে অনেক স্থানে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন। নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তারে এই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের গ্রুপগুলো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।
ইউপি নির্বাচনে এই সংঘর্ষ সহিংসতা ঠেকাতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে বলে ১৪ দল নেতাদের অভিযোগ। এক্ষেত্রে ইসি এবং প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা ও নিস্ক্রিয়তা রয়েছে বলেও জানান তারা। তাছাড়া নিজ দলের সহিংসতা ঠেকাতে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা রয়েছে বলেও মনে করেন নেতারা। চলমান এই সহিংসতা ও রক্তপাতের ঘটনা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর এবং আগামীতে সার্বিক নির্বাচন সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা বাড়িয়ে দেবে বলে জানান ১৪ দলের নেতারা ।
তবে এসব ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ,তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বিশাল এলাকা নিয়ে নির্বাচন হচ্ছে। ইউপি নির্বাচনে সব সময় আপনারা দেখে আসছেন, একটা গোষ্ঠী-গোষ্ঠীর নির্বাচন, আধিপত্যের নির্বাচন, এখানে সব সময় একটু ঝগড়াঝাটি হয়েই থাকে। যেটা হয়েছে, বেশ কয়েকটি এলাকায় আমরা হতাহতের ঘটনা দেখেছি। পুলিশ যথাযথভাবে চিহ্নিত করেছে, দোষীদের ইতোমধ্যে গ্রেফতার করছে। যারা এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ইউপি নির্বাচনের এই সহিংসতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ১৪ দলের অন্যমত শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বাংলানিউজকে বলেন, ইউপিতে এমন সহিংসতা আগে কখনও দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ যদি দলের ওপরই নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারে, দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অন্যান্য গোষ্ঠীকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। এতে সার্বিক নির্বাচন সম্পর্কে মানুষের যে নেতিবাচক মনোভাব আছে সেটা আরও বাড়বে।
১৪ দলের আরেক শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বাংলানিউজকে বলেন, ইউপি নির্বাচনে এই সহিংসতা ঠেকাতে ইসি ও প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। অনেক জায়গায় সহিংসতা হয়েছে, কিন্তু প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে নিস্ক্রিয়তা প্রকাশ পেয়েছে। ইসি ও প্রশাসনের সমন্বয়হীনতাও দেখছি। একটি পুরোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগও নিজেদের মধ্যেকার এই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ হয়েছে। এটা রাজনীতির জন্য ভালো না। গণতান্ত্রিক রাজনীতি, নির্বাচনে খারাপ প্রভাব পড়বে। নির্বাচনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ক্ষমতায় থেকে প্রভাব খাটানোর প্রবণতা এতোটাই বেড়েছে যে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মারমুখী হয়ে উঠেছে। স্বার্থের জন্য নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের নেতাকর্মীদেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। দলের নিচের তলার প্রত্যেকেই মনে করছে তৃণমূলের ক্ষমতা ধরতে পারলে উপরের ক্ষমতার কাছে যেতে পারব। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় এই প্রবণতা আরও বেশি বেড়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক তুলে দেওয়া উচিত।
চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি দলের মনোনয়ন পেলেই জিতে যেতে পারব, অথবা যেভাবেই হোক আমাকে জিততে হবে এই মনোভাব তৈরি হয়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। এর ফলে নিজেদের মধ্যেই এই সহিংসতা দেখা দিয়েছে। সরকার ও আওয়ামী লীগও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাছাড়া নির্বাচনে সব দলের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতে রাজনীতি, নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ সময় ১৯৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২১
এসকে/এমএমজেড