ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

প্রার্থী মান্নানের ‘লঘু পাপে গুরুদণ্ড’

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২
প্রার্থী মান্নানের ‘লঘু পাপে গুরুদণ্ড’

ঢাকা: সূর্য তখন ডুবছে। আকাশটাও মেঘলা।

মাঘের শেষ বিকেলে হু হু করে বইছে বাতাস। টং দোকান থেকে চা খেয়ে ফের ঢুকব নির্বাচন ভবনে। হঠাৎ নজর পড়লো একটি লোকের ওপর। লিকলিকে একটি বকুল গাছের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন হেলান দিয়ে। উদাস দৃষ্টি তার দূরের কোনো খানে। ছলছল চোখ থেকে এ বুঝি গড়িয়ে পড়বে অশ্রু।  

কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, নাম তার আব্দুল মান্নান। একটি মামলা থেকে রেহাই পেতে ঘুরছেন কর্মকর্তাদের দফতর থেকে দফতরে। দেখা করেছেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের সঙ্গেও (সাবেক এ জজ এখন সাবেক নির্বাচন কমিশনারও)। আশার কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এভাবে। দৃশ্যটি ১৩ ফেব্রুয়ারির, যার পরের দিন বিদায় নিয়েছেন কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

আব্দুল মান্নান আর কেউ নন। একটি সংসদীয় আসনের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন শখের বসে। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টিকে গরিবের ঘোড়া রোগ বললে হয়তো ভুল হবে না। তেমনি বলা যায় আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খোঁজ নিতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন। তবে সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাওয়া কোনোভাবেই তার অনধিকার চর্চা নয়।  

একাদশ জাতীয় সংসদের বগুড়া-১ আসনটি শূন্য হলে ২০২০ সালের ২৯ মার্চ উপ-নির্বাচন দিয়েছিলেন নূরুল হুদা কমিশন। আর এ নির্বাচনেই স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হতে হলে এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন সূচক স্বাক্ষর মনোনয়নত্রের সঙ্গে দাখিল করতে হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তা দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে সেখান থেকে স্বাক্ষর ও সমর্থন যাচাই করেন। এতে ১০টি স্বাক্ষর ভুয়া বলে অভিহিত করে মনোনয়নপত্র বাতিল করেন।  

সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে নির্বাচন কমিশন ওই বছরের ৫ মার্চ শুনানিতে ডাকেন আব্দুল মান্নানকে। শুনানিতে ছয় সমর্থনকারীকেও নিয়ে আসেন। কিন্তু তারা স্বাক্ষর ও সমর্থন করেন বলে নিজেদের প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আবেদনটি না মঞ্জুর করেন নির্বাচন কমিশন। একইসঙ্গে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে প্রার্থী আব্দুল মান্নান মিয়া ও সমর্থক বগুড়ার মো. সোহেল রানা ও মো. সুলতান, নোয়াখালীর মো. রুবেল হোসেন, কক্সবাজারের মো. মাহবুবুর রহমান হৃদয়, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর মো. লাভলু মিয়া ও ময়মনসিংহের ফুলপুরের মো. নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন। ওইদিন শের-ই-বাংলা নগর থানা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে ৬ মার্চ আদালতে সোপর্দ করে।  

পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মোরেশদ আলমী বাদী হয়ে মামলা করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪১৭, ৪১৯, ১৯৩ ও ১০৯ ধারায় মামলা দেওয়া হয়। এতে তাদের সর্বোচ্চ সাত বছরের সাজা হতে পারে।  

আব্দুল মান্নান ও তার কথিত সহযোগীদের পরিচয় জেনে একটু অবাকই হয়তো হবেন। মনে হবে কত রাখব বোয়াল বেরিয়ে যায় আইনের ফাঁক গলে কিংবা দৃষ্টির অগচোরে। আর চুনোপুঁটিকে ধরে দেখানো হয় আস্ফালন।  

এ মামলার আসামিদের চুনোপুঁটি বললেও হয়তো ভুল হবে। কেননা, তারা সবাই রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ক্যান্টিনের কর্মচারী। আব্দুল মান্নানের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি বাবুর্চি আর অন্যরা সহযোগী। যদিও বাবুর্চি পরিচয় দিলে সব বাবুর্চির সম্মান যাবে, তাই নিজেকে ক্যান্টিন বয় উল্লেখ করেছেন এর আগে।  

নিতান্তই হেয়ালীর বসেই প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন তিনি। এতে ছিল না কোনো নির্বাচনী কোনো গেম কিংবা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য। ছিল নেহাত বোকামি।  

মান্নান বলেন, ‘বগুড়া-৪ আসন থেকে হিরো আলম প্রার্থী হয়েছিল। আমি তো কিছুটা পড়ালেখা করেছি। তাই মনে করলাম খারাই। কিন্তু বোকামি কইরে ধরা খাইলাম। তিন মাস হাজত খাইটে জামিন নিছি। কয়দিন পরপর আদালতে ঘুইরতেছি। এখন কমিশনের কাছে ক্ষমা চাইতে আইছি। ’ 

অনেকের কাছে অনুনয়ন করে সুযোগ পেয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের সঙ্গে সাক্ষাতের। তিনি জানিয়েছেন, মামলার চার্জশিট হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার নেই তাদের। বাদী আর রিটার্নিং কর্মকর্তা যদি তার পক্ষে আদালতে কোনো সাক্ষ্য দেয়, তবে সাজা কিছুটা কম হতে পারে। কিন্তু সাজা হবেই।  

আব্দুল মান্নান বলেন, ‘এক শতাংশ সমর্থক ও তাদের স্বাক্ষর আমি নিজে নিছি। আর কিছু ছেলেকেও দায়িত্ব দিছিলাম। তারা হয়তো সবারটা নেয়নি। আর এজন্য ফেঁসে গেছি। আমরা গরিব, অসহায় মানুষ। আমার দুই ছুটো ভাইও এ মামলার আসামি। জেলে গেলে পরিবার চইলবে ক্যামনে, মামলাই চালাইতে পাইরতেছি না। ’

ততক্ষণে মান্নানের গাল বেয়ে নিচে পড়লো চোখের জল। তার অসহায়ত্ব দেখে কেমন বিষাদ ভর করলো মনে। কিন্তু কিছু কী করার আছে। আইন তো তার গতিতেই চলবে। হয়তো আব্দুল মান্নানও একদিন সাজা খেটে বেরিয়ে আসবেন। এ পুরনো ব্যবস্থার বেড়াজালে চেষ্টা করবেন একটু ঘুরে দাঁড়াতে।  

পুরো বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে কথা হয় জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তারা বলেন, স্বাক্ষর জাল করা একটি অপরাধ। মান্নান যা করেছে, সেটা অপরাধ বলেই ইসির শুনানিতে প্রমাণিতও হয়েছে। কিন্তু তার যে সামাজিক অবস্থা, মনোভাব সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে কমিশন তার প্রতি সদয় হলেও পারতেন।

আরও পড়ুন...
** বগুড়া-১ আসনের ভোটে প্রার্থী হতে এসে আটক ক্যান্টিনবয়

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২
ইইউডি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।