ঢাকা: প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এবার রাজনৈতিক দলগুলোকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কেবল তাদের ওপর নির্ভর করলে নির্বাচন সুন্দর হবে না। এজন্য দলগুলোকে ঘরে বসে না থেকে মাঠে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
মঙ্গলবার (২১ জুন) ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) যাচাই করার জন্য আমন্ত্রিত ১৩টি দলের সঙ্গে নির্বাচন ভবনে আয়োজিত সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। আমার মনে হয় না সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কেউ ওই কাজটা (কারচুপি) করতে যাবে। অন্য কোনোভাবে সম্ভব কি-না জানি না, তবে আমরা যারা কমিশনের সদস্য আছি, সরকারও চাইবে না আমরা আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করি।
তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে বলেন, নির্বাচনে সর্বাত্মক চেষ্টা লাগবে। আপনারা যদি ঘরে বসে থাকেন…, আপনারা যদি ভোটকেন্দ্রে এসে লক্ষ্য করেন আমরা কোনো ম্যানিপুলেশন করছি কি-না, জালভোট হচ্ছে কি-না, সেইখানে ভোটার সঠিকভাবে ভোট দিতে পারছেন কি না, সেই চেষ্টাগুলো সমভাবে আপনাদেরও করতে হবে। এই চারজন, পাঁচজন লোক আমরা। আপনারা যতই বলেন, আমাদের ওপর যদি আপনারা ডিপেন্ড (নির্ভর) করেন, তাহলে কিন্তু নির্বাচন সুন্দর হবে না। আপনাদের দিক থেকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে। আপনারা ফিল্ডে থাকেন। আমি কয়টা সেন্টারে যাব সিইসি হয়ে? আমি কি লাঠি নিয়ে যেতে পারব ভোটকেন্দ্রে? হ্যাঁ, আমরা পুলিশ, বিজিবি মোতায়েনের চেষ্টা করব। সেই চেষ্টাগুলো আমরা করব। যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, আমরা কিন্তু কোনো সেন্টার থেকে অভিযোগ পাইনি যে অপব্যবহার হয়েছে। যন্ত্রের (ইভিএম) কিন্তু সমস্যা হতে পারে। ব্যালটে যেমন একজন ১০০টা ভোট দিতে পারে, এটা ইভিএমে অসম্ভব। আমার ভোট আপনি দেবেন, আপনার ভোট আমি দেব, এটা একেবারেই অসম্ভব।
সিইসি বলেন, শতভাগ আস্থার কথা বলছেন অনেকে। ব্যক্তিগতভাবে আমি শতভাগ আস্থায় বিশ্বাস করি না। আপনি পারলে বলবেন, উনি বলবেন, আমি সৎ লোক। এই জিনিসিটার দ্বন্দ্ব থাকবেই। তবে নিয়মের মাধ্যমে আমি শতভাগ সৎ থাকব।
তিনি বলেন, আমার চারপাশে যারা আছেন, তাদের ওপর আমার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনারা, রাজনৈতিক দল, সরকার, সরকারি দল; আপনারাই কি শতভাগ অনেস্ট থাকবেন? ভোটকেন্দ্রে কীভাবে ব্যালটে সিল মারা হয় সেই অভিজ্ঞতা আমার নিজের আছে। এটা কিন্তু আপনারাও বন্ধ করতে পারেননি। এক্ষেত্রে যদি ইভিএম ব্যবহার করা যায়, আমি ইভিএম বিশেষজ্ঞ না, কিন্তু এ পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি, এখানে কিন্তু ইতিবাচক দিক অনেক বেশি।
সিইসি বলেন, ইভিএমে আপনাদের আস্থা আসছে না। তাই ব্যাপক পরামর্শ নেওয়ার আয়োজন করেছিলাম। আপনারা কিন্তু আপনাদের বক্তব্য দিচ্ছেন, আপনাদের বক্তব্যকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা জানি ইভিএম নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। তাই আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি।
ইভিএমের দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেন, এই মেশিনে আপনি কেবল নিজের ভোটটিই দিতে পারবেন। গোপন কক্ষে অন্য কেউ চাপ দিয়ে দেবেন সেটার জন্যও আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমি আগেও বলেছি, যে ইভিএম নিয়ে একটাই চ্যালেঞ্জ, যে সন্ত্রাসী অন্য কেউ চাপ দিয়ে দিল কি-না। এজন্যই আমরা সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করেছি। ভবিষ্যতে সবগুলোতে না হলেও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করব।
তিনি বলেন, আস্থা একবার ভেঙে গেলে ফিরিয়ে আনতে সময় লাগে। সেই সময়টা আমরা নিচ্ছি। আমাদের কমিশন কোনো পক্ষপাত করবে না। আমরা যেন অবাধ ও সুষ্ঠু একটা নির্বাচন উপহার দিতে পারি সেই চেষ্টা থাকবে।
ইভিএম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সাবেক এনআইডি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন বলেন, আগেরটা ভারতের আদলে তৈরি ইভিএম ছিল। মূলত ওটি ছিল কাউন্টিং মেশিন। এক্ষেত্রে রাজশাহী ও চট্টগ্রামে সমস্যা হয়েছিল। ওটার কারিগরি দায়িত্ব ছিল বুয়েটের, আর অন্য অংশটুকুর দায়িত্ব ছিল বিএমটিএফের। পরে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদর নেতৃত্বাধীন কমিশন নতুন কিছু চাইলেন। এরপর অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে প্রধান করে একটি টিম করে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী, যা যা প্রয়োজনীয় সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বর্তমান ইভিএম মেশিনে। সে সময় আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল যেন হিউম্যান ইন্টারফেয়ারেন্স না করা যায়।
তিনি বলেন, বর্তমান ইভিএমে ব্যক্তি শনাক্ত না হলে ব্যালট ইউনিট ওপেন হবে না। এতে কেউ কারো ভোট দিতে পারবে না। এখন গোপন কক্ষের মধ্যে তাকেই যেতে হবে। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন, অন্য কেউ টিপলে। সেটার জন্য ইসি বা ইভিএম দায়ী নয়, সেটা আমাদের দায়িত্ব না। এটা যারা পরিচালনা করবে, তাদের দায়িত্ব।
এছাড়া বর্তমান ইভিএম একজনের ভোট সম্পন্ন না হলে দ্বিতীয় ভোটারকে অ্যালাউ করবে না। দ্বিতীয়বার ভোট দেওয়ারও সুযোগ নেই। সকাল ৮টার আগের ইভিএম মেশিন চালু হবে না, যতই বাড়ি মারেন, ভাঙেন, যাই করেন।
অন্যদিকে ব্যালট পেপার ভাঁজা করা, সিল মারা ইত্যাদির কারণে ভোট বাতিল হয়; এ নিয়ে ভোট গণনার সময় ঝামেলা হয়। ইভিএমে সে সমস্যা হয় না। আবার মৃত ব্যক্তিকে ভোট দেওয়াবেন, সেটা সম্ভব নয়। ব্যালটে সেটা করা যায়।
ইভিএম নিয়ে দ্বিতীয় বৈঠকে ১৩টি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইসি। এরমধ্যে পাঁচটি দল অংশ নেয়নি। যে দলগুলো বৈঠকে অংশ নেয়নি সেগুলো হলো- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল)।
আর যেসব রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিয়েছে, সেগুলো হলো- ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।
গত ১৯ জুন ইসি ১৩টি দলকে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেদিন গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি অংশ নেয়নি। জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) অন্যদলগুলো অংশ নিলেও তারা কেউ কারিগরি বিশেষজ্ঞ আনেনি।
প্রধান বিরোধী দল জাপা সেদিন বৈঠকে অংশ নিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি জানিয়েছে।
এর আগে ইভিএম নিয়ে ইতোমধ্যে দেশ সেরা প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করে মতামত নিয়েছে ইসি। তারা ইভিএম দেখার পর বলেছেন, এই মেশিন নির্ভরযোগ্য।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় আকারে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় ইসি। তবে তার আগে সবার মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।
আগামী ২৮ জুন যে দলগুলোকে ইসিতে আসার আমন্ত্রণ পেয়েছে, সেগুলো হলো- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট।
ইসির হাতে বর্তমানে ১ লাখ ৫৪ হাজার ইভিএম রয়েছে, যা দিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ আসনে ভোট নেওয়া যাবে। ৩০০ আসনে এই ভোটযন্ত্র ব্যবহার করতে হলে আরও তিন লাখের মতো মেশিনের প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৮ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০২২
ইইউডি/এমএমজেড