ঢাকা: বিদেশি কূটনীতিকদের অযাচিত নাক গলানোকে প্রশ্রয় না দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সতর্ক থাকতে বলেছে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ। এক্ষেত্রে দলটি মনে করে ইসি কোনো সালিশের প্রতিষ্ঠান নয়।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ইসি সালিশের প্রতিষ্ঠান নয়। আপনাদের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হোক- এটা আমরা চাই না। কোনো সালিশ বা রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াবেন না। কূটনীতিকদের কাজে আমরা হতবাক হয়েছি। বাংলাদেশে কূটনীতিকরা অযাচিত পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোরও ব্যর্থতা। রাজনৈতিক দলও এখানে দূতাবাসগুলোতে ধরনা দেয়। ছোট খাট বিষয় নিয়ে কূটনীতিকদের সালিশকারীর ভূমিকায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন, এটা ঠিক নয়।
তিনি আরও বলেন, এখানে কেউ কেউ নির্বাচনী সংলাপ বর্জন করছে। পৃথিবীর সব জায়গায় সংকট আছে। ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এটা সংশোধন হচ্ছে। সুতরাং আমেরিকা থেকে জাপান পর্যন্ত এই অভিযোগ চলছে। এটা নতুন কিছু না। কিন্তু একটা জিনিস সবাই অনুসরণ করে, কোনো অবস্থাতেই সাংবিধানিক পন্থা ছাড়া যথা সময়ে নির্বাচনটা যাতে বানচাল না হয়। ইসিকে অতটুকু বলিষ্ট অবস্থান থাকতে হবে যে, যথা সময়ে নির্বাচন করব। এখানে কোনো ছাড় দেব না।
সাবেক এ তথ্যমন্ত্রী বলেন, জাসদ কোনো রকম সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বানচাল হয়ে যাক, চেষ্টা করব এটা যাতে না হয়। কারণ যারা ভোটের আগে সরকার পরিবর্তনের প্রস্তাব দিচ্ছেন, তারা বাস্তবে সাংবিধানিক ধারা বানচালের প্রস্তাব দিচ্ছেন। তারা কার্যত অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিচ্ছেন। যারা এসব প্রস্তাব দিচ্ছেন, তাদের যে রাজনৈতিক পার্টনার আমরা দেখছি, জঙ্গিবাদী, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী চক্র। সুতরাং অস্বাভাবিক সরকারের আড়ালে কার্যত সাম্প্রদায়িক তালেবান সরকার আনার একটা পাঁয়তারা চলছে। এটা দেশের জন্য খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। সে জন্য জাসদ মনে করে ভোটের আগে অস্বাভাবিক যে সাম্প্রদায়িক তালেবান সরকারের যে পাঁয়তারা আছে, ইসির আচার-আচরণে যেন তারা প্রশ্রয় না পায়। এজন্য সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, একটা কথা বলা হয় যে, সমতল জায়গা লাগবে। এর মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের নির্বাচনে আনার সুযোগ চাচ্ছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে গণতন্ত্রের নীতি নৈতিকতা, আইনের বাইরে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে না। সুতরাং গণতন্ত্রের বাউন্ডারি আছে। এর মাঝে কোনো অপরাধী থাকবে না এবং কোনো সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী চক্র থাকবে না। এই জায়গাটায় সবার সতর্ক থাকতে হবে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বিষয় নিয়ে হাসানুল হক ইনু বলেন, এটা নিয়ে বিবেচনা করা দরকার। কেননা, সংবিধান বলছে যে আমি এতো বছর হলে যোগ্যতা থাকলে নমিনেশন পেতে পারি। সুতরাং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে কীভাবে বিধানটা ঢুকল, এটা আমাদেরই ভুল হয়েছে। এটা আপনারা বিবেচনা করবেন। কেউ যদি শর্ত পূর্ণ করেন, তিনি যেন প্রার্থী হতে পারেন। নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য কীভাবে এবং কী করবেন, সেটা একটু ভেবে দেখবেন।
সংলাপে দলের সাধারণ শিরীন আখতার এমপি লিখিত প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। এতে উল্লেখ করা হয়-
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ মনে করে, জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো সাংবিধানিক, আইনগত ও প্রশাসনিক ঘাটতি বা দুর্বলতা থাকলে তা দূর করার জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশসহ অন্যান্য নির্বাচনী আইনে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন বা চাহিদা থাকলে নির্বাচন কমিশনের উচিৎ তা সুনির্দিষ্টভাবে আইনসভায় অর্থাৎ জাতীয় সংসদের কাছে উত্থাপন করা। কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিও এমন প্রয়োজনবোধ করলে তা আইনসভায় অর্থাৎ জাতীয় সংসদের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপন করতে পারেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইভিএম পদ্ধতি সংযোজনকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানায়। ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণে বাস্তবে কিছু সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। কিছু প্রশ্ন ও বিতর্কও তৈরি হয়েছে। জাসদ ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে চিহ্নিত সমস্যাসমূহ সমাধান করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। একই সঙ্গে ইভিএম পদ্ধতিতে কারিগরীভাবে ত্রুটিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য কাজ করার পাশাপাশি ব্যালট পদ্ধতিতেও ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
ভোটার তালিকা প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ মনে করে, বর্তমানে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, সংযোজন, বিয়োজন, সংশোধনের সমগ্র প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। জাসদ এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছে। জাসদ একই সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ও সংশোধনের জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়াটিকে সহজ এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছে। জাসদ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র একই তথ্যপঞ্জিতে সমন্বিত করা এবং হালনাগাদকৃত তথ্য সবসময় ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রাখার দাবি জানাচ্ছে।
জাসদ প্রবাসী ভোটারদের ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গণপ্রতিনিধত্ব আদেশের কঠোর প্রয়োগ করে ধর্মভিত্তিক ও ধর্মীয় পরিচয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল এবং এ ধরনের দলকে নিবন্ধন না দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। গণপ্রতিনিধত্ব আদেশ অনুযায়ী কঠোরতা প্রয়োগ করে একই নাম বা কাছাকাছি নামে কোন রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন না দেওয়ার দাবিও জানাচ্ছে।
এছাড়া নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। নির্বাচনী ব্যয়সীমা যৌক্তিকীকরণ এবং আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে অবৈধ অর্থের ব্যবহার বন্ধের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা মতো নির্বাহী বিভাগকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যাস্ত, নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন ও অসদাচারণের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, নির্বাচনকালে জনপ্রশাসনের কাজে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিচারিক ম্যাজিষ্ট্রেটদের অধীনে ব্যবহার করার দাবি করে জাসদ।
সংলাপে জাসদের নেতারা ছাড়াও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০২২
ইইউডি/এমএমজেড