ঢাকা: জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাত থেকে সরে গেলে ২০০৬ সালের মতো সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্নের মুখেও পড়তে পারে।
বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন বুধবার (২১ আগস্ট) প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছে। সম্প্রতি এনআইডি ইসি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় এমন শঙ্কার কথা জানান ইসি কর্মকর্তার।
বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. রাশেদুল ইসলাম ও মহাসচিব মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান স্বাক্ষরিত লিখিত বক্তব্যে ১১টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
১. এনআইডি চলে গেলে ২০০৬ সালের মতো সাংবিধানিক সংকটও সৃষ্টি হতে পারে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে তৈরি অন্য সব ডাটাবেইজের তুলনায় ভোটার তালিকা ডাটাবেইজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিরংকুশ আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। যার ব্যত্যয় বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে।
২. ভোটার তালিকা ডাটাবেইজ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেইজের দ্বৈত ব্যবস্থাপনা থাকলে ইভিএম এ ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্য মন্ত্রণালয়/বিভাগের নিয়ন্ত্রাধীন জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে ভোটার শনাক্ত করলে নির্বাচন আইনসিদ্ধ/বিধিসম্মত হবে না। এছাড়া ডাটাবেইজের দ্বৈত ব্যবস্থাপনার কারণে ইভিএমে রক্ষিত ভোটার তথ্যও অন্য মন্ত্রণালয়/বিভাগের এনআইডির তথ্যে গরমিল পরিলক্ষিত হলে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় ভোটার শনাক্তকরণ, প্রার্থী ব্যবস্থাপনা, ভোটার ব্যবস্থাপনা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বিঘ্নিত হবে।
৩. জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এ জাতীয় পরিচয় নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ভোটার ডাটাবেইজের তথ্য-উপাত্তকেই ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভোটার তালিকা প্রণয়ন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উভয় প্রকার কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় দ্বৈততা পরিহারসহ বিপুল অর্থ, শ্রম ও সময়ের সাশ্রয় হচ্ছে।
৪. ২০০৭-২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ছবিসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা কার্যক্রম নিরপেক্ষতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে। উক্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এনআইডি উইং এর আলাদা অবকাঠামো এবং জনবল নেই। এক্ষত্রে, উক্ত কার্যক্রম অন্য কোনো সংস্থা কর্তৃক পরিচালনা করে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছাতে সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। অনুরুপ অবকাঠামো তৈরি এবং পৃথক ডাটাবেইজ ব্যবস্থাপনার ফলে তথ্যের অভিন্নতা ক্ষুণ্ন হবে এবং আলাদা করে বিপুল অর্থ ও শ্রমের প্রয়োজন হবে যা বিদ্যমান বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যয় সংকোচন নীতি পরিপন্থি।
৫. ভোটার তালিকা ডাটাবেইজের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ একাধিক হলে অপারেশনাল কার্যক্রমে চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা দেখা দেবে। এছাড়া স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জনগণ যে সকল ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য প্রদান করেছেন সেসকল গোপনীয় তথ্য অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর সংবিধান, আইন ও বিধি পরিপন্থী হবে।
৬. সংবিধান আইন ও বিধি দ্বারা ভোটার তালিকা প্রস্তুত, তত্ত্বাবধায়ন ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয় পত্রের ডাটাবেইজে দ্বৈত ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হলে কোন ব্যক্তির এনআইডি এর তথ্যের যে কোন ধরনের সংশোধন/সংযোজন/বিয়োজন সরাসরি ভোটার ডাটাবেইজে প্রভাব ফেলবে, যার দায়ভার সরাসরি নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তাবে। যদিও সংবিধান ও আইনের দ্বারা অর্পিত ক্ষমতাবলে এ কাজের দ্বায়ভার একমাত্র নির্বাচন কমিশনের।
৭. অন্যদিকে জাতীয় পরিচয়পত্র নির্বাচন কমিশন হতে অন্য মন্ত্রণালয়/বিভাগে ন্যস্ত করা হলে শুধু ভোটার হওয়ার জন্য জনগণের আগ্রহ ও উদ্দীপনায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হবে যা ভবিষ্যতে নির্বাচন ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
৮. ভোটার তালিকার নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিধি অনুযায়ী প্রতিবছর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা ও বিপুল সংখ্যক মৃত মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে কর্তন করা হয়। মৃত মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে কর্তন করা না হলে এই ভোটার তালিকা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারাবে এবং এই ভোটার তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
৯. ভোটার তালিকা ডাটাবেইজ প্রস্তুতকালে ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নির্মাণে আন্তর্জাতিক সংস্থা UNDP ও সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সাথে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে। সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী এসকল ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সম্পদ। এক্ষেত্রে ডাটাবেইজের নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের বাইরে হস্তান্তর করা হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে।
১০. বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের অধীনে তিল তিল করে গড়ে তোলা একটি ডাটাবেইজ আকস্মিকভাবে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে ন্যস্ত করা হলে অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের আদলে জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, সেন্ট লুসিয়া ও সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রানাডা দ্বীপপুঞ্জ সহ অনেক দেশে নির্বাচন কমিশন পরিচয়পত্র কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
১১. ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারনে সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ হয়ে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা আকস্মিক হুমকির মুখে পড়ে। এ পরিস্থিতি হতে উত্তরণের জন্য মাননীয় নির্বাচন কমিশনের সদয় নির্দেশনায় গত ১৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখে এনআইডি সেবার অনলাইন সার্ভিস চালু করা হয়। এতে করে জনসাধারণ ঘরে বসে জরুরি সেবা গ্রহণের সুযোগ পায়। পরবর্তীতে এনআইডির গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার এনআইডি সেবাকে জরুরি সেবা ঘোষণা করে। সে সময় ভোটার তালিকা ডাটা বেইজের সহায়তায় প্রস্তুতকৃত এনআইডির মাধ্যমে সরকার ২৫ লক্ষ পরিবারকে শতভাগ স্বচ্ছতার সাথে ২৫০০ টাকা করে অনুদান প্রদান করতে সক্ষম হয়। তাছাড়া করোনা টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে অনলাইন নিবন্ধনে নির্বাচন কমিশন অসামান্য অবদান রাখে।
১৬৪টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান E-KYC এর মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করে সেবা প্রদান করছে। এতে করে ভুয়া পেনশন গ্রহণকারী চিহ্নিত করে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় রোধ করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিক দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতিসহ আর্থিক খাতে শৃংখলা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেইজ অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। তাছাড়া এই ভোটার তালিকার ডাটাবেইজের ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হয়েছে, যার সুফল জনসাধারণসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ ভোগ করছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০২২
ইইউডি