খুলনা: আর মাত্র ২দিন পরই খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। সমর্থন পেতে শেষ মুহূর্তে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
কেসিসি নির্বাচনের মেয়র পদে ৫ জন প্রার্থী হয়েছেন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের তালুকদার আব্দুল খালেক (নৌকা), জাপার শফিকুল ইসলাম মধু (লাঙল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. আব্দুল আউয়াল (হাতপাখা), স্বতন্ত্রপ্রার্থী এসএম শফিকুর রহমান মুশফিক (দেয়াল ঘড়ি) ও জাকের পার্টির এস এম সাব্বির হোসেন (গোলাপ ফুল) প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
ভোটের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ও জয় নিশ্চিত করার হিসাব-নিকাশ করছেন প্রার্থীরা। দলীয় নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়া ও নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়া নিশ্চিত করার ওপর জোর দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা বিরামহীন প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত। পথসভা, কর্মীসভাসহ নানা উপায়ে ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যস্ত তারা। ভোটারদের দেওয়া হচ্ছে নানা প্রতিশ্রুতি। ব্যবহার হচ্ছে ব্যতিক্রমী প্রচার কৌশল। নাগরিক সমস্যা সমাধানে প্রার্থীরা দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি আর উন্নয়ন পরিকল্পনা।
এবার সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির কোনো প্রার্থী না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের বিজয় অনেকটা সুনিশ্চিত জেনেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা প্রচার প্রচারণায় থেমে নেই।
কেউ কেউ ধারণা করেছিল বিএনপি না থাকায় ইসলামী আন্দোলন খুলনায় শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে উঠবে। শেষ পর্যন্ত সেটি আর মাঠে লক্ষ্য করা যায়নি। খুলনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট প্রায় ৭০ হাজার। আর এ ভোটের প্রায় শতভাগই যাবে নৌকায়। ইসলামী আন্দোলনের পীরের দলের মুরিদ ও সমর্থকের চেয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট বেশি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ ভোটাররা বলছেন, কেসিসির গত পাঁচটি নির্বাচনের তিনটিতেই জয়ী হয় বিএনপি। এবার তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় মেয়র পদে অনেকটা একতরফা নির্বাচন হবে। ভোটের আগে সব সমীকরণে এগিয়ে সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, খুলনা সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রথম নির্বাচন হয়। এবার কেসিসির ষষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কেসিসিতে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কেসিসির জননির্বাচিত মেয়র ছিলেন শেখ তৈয়বুর রহমান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক নির্বাচনে মেয়র পদে জয়লাভ করেছিলেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেককে পরাজিত করে খুলনার মেয়র হয়েছিলেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনি। সর্বশেষ ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক ধানের শীষ প্রতীকের বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন।
২০১৮ সালের মে মাসে কেসিসি নির্বাচন হয়েছিল দলীয় প্রতীকে। তখন মেয়র পদে প্রার্থী ছিলেন পাঁচজন, তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে প্রায় ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন। কেসিসি’র মোট ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ঘোষিত ২৮৬টি কেন্দ্রের (তিনটি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা স্থগিত ছিল) ফলাফলে নৌকা প্রতীকের তালুকদার আবদুল খালেক পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৬ হাজার ৯০২ ভোট। আর ধানের শীষ প্রতীকের নজরুল ইসলাম মঞ্জু পেয়েছিলেন ১ লাখ ৯ হাজার ২৫১ ভোট। মোট ভোটার ছিল ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন।
মেয়র পদে আরও তিন প্রার্থী ছিলেন। এরা হচ্ছেন হাতপাখা প্রতীকের মুজ্জাম্মিল হক, ভোট পেয়েছিলেন ১৪ হাজার ৩৬৩টি; জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান (লাঙ্গল), ভোট পেয়েছিলেন ১০৭২ এবং কাস্তে প্রতীকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র মিজানুর রহমান, ভোট পেয়েছিলেন ৫৩৪টি। এরা জামানত হারিয়েছিলেন। এবারও এস এম শফিকুর রহমান নির্বাচন করছেন। তবে দলীয় প্রতীকে নয়। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও এবার প্রার্থী দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন এসব প্রার্থীদের তেমন ভোট বাড়েনি। এছাড়া বিএনপি জামায়াতের ভোট টানতেও ব্যর্থ হবেন তারা। যে কারণে সব সমীকরণেই খালেক এগিয়ে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে ৭১ বছর বয়সী তালুকদার আবদুল খালেকের রাজনৈতিক জীবনও বর্ণময়। একই সঙ্গে তিনি খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সংসদ সদস্য ছিলেন বেশ কয়েকবার। হয়েছেন প্রতিমন্ত্রীও। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ছিলেন। খুলনা-বাগেরহাট মিলিয়ে দাপটের সঙ্গেই রাজনীতির অঙ্গনে রাজত্ব করছেন তিনি।
খুলনা শহরে বাস হলেও তিনি সংসদ সদস্য হন আদি নিবাস বাগেরহাটের রামপাল-মোংলা আসন থেকে। ১৯৯১ সালে প্রথম নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৯৬ সালেও বাগেরহাট-৩ আসনে সংসদ সদস্য হন তিনি। এরপর ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বভারও পান তালুকদার আব্দুল খালেক। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে আবারও বাগেরহাট-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
২০০৩ সালে ২৫ ডিসেম্বর এ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমামের মৃত্যুর পর ২০০৪ সালে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন খালেক। তার আগে একই শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
২০০৮ সালে কেসিসি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতে প্রথম মেয়র হন তালুকদার আব্দুল খালেকে। ফলে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে নিজের আসনটি স্ত্রীকে ছেড়ে দেন তিনি। ২০১৩ সালে মেয়রের মেয়াদ পূর্ণের পর নিজের দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলীয় সমর্থন নিয়ে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন তালুকদার আব্দুল খালেক। কিন্তু হেরে যান বিএনপি নেতা মনিরুজ্জামান মনির কাছে। এরপর ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাটের আসনটিতে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তালুকদার আব্দুল খালেক।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালের খুলনা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনে তাকে আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে ৬৫ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। ওই সময় তার ছেড়ে দেওয়া রামপাল-মোংলা আসনে তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নির্বাচিত হয়ে বর্তমানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
কেসিসি নির্বাচন নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বলছে, বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তাই রাজনৈতিক দলভিত্তিক এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলেও সার্বিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়বে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) খুলনা জেলা সম্পাদক অ্যাডভোকে কুদরত ই খুদা বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপি বর্জন করায় কেসিসি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়ার চিন্তা করার সুযোগ নেই। কেসিসিতে এবার উৎসব মূখর নির্বাচন নেই। মাঠে কোন উত্তাপ নেই। কে মেয়র হবেন তা ভোটের আগেই নগরবাসী হিসাব করে রেখেছেন।
উল্লেখ্য, সিটি কর্পোরেশনে ৩১টি ওয়ার্ড রয়েছে। এছাড়াও সংরক্ষিত ওয়ার্ড রয়েছে ১০টি। ১৩ ও ২৪নং ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দু’জন বিজয়ী হয়েছেন। ২৯টি ওয়ার্ডে শুধু কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৭৫ জন।
এবারের সিটি নির্বাচনে ৩১ টি ওয়ার্ডে ২৮৯টি ভোটকেন্দ্রে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এর মধ্যে নারী ভোটার ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৬ জন ও পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৩ জন।
আগামী ১২ জুন দ্বিতীয় ধাপে খুলনা সিটি করপোরেশনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হবে। সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে ২৮৯টি কেন্দ্র ও ১ হাজার ৭৩২টি ভোটকক্ষের সামনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৯ ঘণ্টা, জুন ৯, ২০২৩
এমআরএম/জেএইচ