ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

কপোতাক্ষে সবচেয়ে বড় প্রকল্পে ধীর গতি

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৩
কপোতাক্ষে সবচেয়ে বড় প্রকল্পে ধীর গতি

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মরছে কপোতাক্ষ। দিনে দিনে পরিবর্তনের প্রভাবকগুলো আরো দৃশ্যমান হচ্ছে।

এরসঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি ঘেরা এ নদীর মৃত্যুঘণ্টা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। কপোতাক্ষের বড় অংশ মরে গিয়ে লাখো মানুষের সংকট বাড়িয়েছে। বছরের প্রায় ছ’মাস জলাবদ্ধতায় ডুবছে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট। প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন সংকট। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়, সংকট কাটে না। কপোতাক্ষ-তীর ঘুরে এইসব বিষয়ে আদি-অন্ত খোঁজ নিয়ে ‘কপোতাক্ষে বাঁচামরা’ শিরোনামে বাংলানিউজের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ চতুর্থ পর্ব।     

কপোতাক্ষ তীরের জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে এসে: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে এযাবতকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে ধীরগতিতে। বাস্তবায়ন সংস্থার গাফিলতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে কপোতাক্ষ-তীর এলাকাবাসীর মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

চার বছর মেয়াদি কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের দুই বছর অতিবাহিত হলেও বরাদ্দকৃত ২৬২ কোটি টাকার মধ্যে পাওয়া গেছে মাত্র ২৮ কোটি টাকা। বাকি ২৩৪ কোটি টাকা আগামী দুই বছরে ছাড় হবে কিনা, কিংবা টাকা পাওয়া গেলেও কাজ শেষ হবে কিনা, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
 
সূত্র বলছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে কপোতাক্ষ নদের বিষয়টির সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রকল্পটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এক বছর পর ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। অনুমোদিত প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয় ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (১ম পর্যায়)’।

প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। ৪ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটির ব্যয় বরাদ্দ ছিল ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। দু’ভাগে প্রকল্পটি ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট, সংক্ষেপে টিআরএম) বাস্তবায়ন এবং অপরটি কপোতাক্ষ নদ খনন। চার বছর মেয়াদি প্রকল্পের দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু অর্থ ছাড়ে দেখা দিয়েছে গড়িমসি।

যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১১-১২ অর্থ বছরে ২৮ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার টাকার বিপরীতে অর্থ ছাড় দেয় ১৩ কোটি এবং ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ১১৪ কোটি ৬৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকার বিপরীতে ১৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ২ বছরে মোট ১শ ৪৩ কোটি ৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা চাহিদার বিপরীতে ২ কিস্তিতে মাত্র ২৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

প্রাপ্ত এ টাকার মধ্যে এ পর্যন্ত ১৩ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এই অর্থে জোয়ারাধার বাস্তবায়নের জন্য পাখিমারা বিলে ৭৫ শতাংশ পেরিফেরিয়াল বাঁধ ও ২৫ শতাংশ আউটলেট পাইপ স্থাপনসহ কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

জানা গেছে, প্রকল্পের চলমান ডিজাইন অনুযায়ী কপোতাক্ষ খননের কাজ শুরু করার আগে পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করার কথা। এজন্য ওই বিলে প্রস্তাবিত বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

এসব কাজের মধ্যে রয়েছে বিলের চারপাশে ১০ দশমিক ২০ কিলোমিটার পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ, পেরিফেরিয়াল বাঁধে ২২টি আউটলেট পাইপ নির্মাণ, ড্রেজার দ্বারা ১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সংযোগ চ্যানেল খনন, চ্যানেল খননের জন্য ৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ, সংযোগ খালের ১ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ, সংযোগ খালের ওপর একটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ এবং যৌক্তিক মূল্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান। এসব কাজের মধ্যে অবকাঠামোগত কিছু কাজ সম্পন্ন হলেও জোয়ারাধার বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা।

সূত্র বলছে, পাখিমারা বিলে ২০১১-১২ অর্থ বছরের মধ্যে জোয়ারাধার কার্যক্রম বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে তা সম্পন্ন হচ্ছে না। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও জোয়ারাধার কার্যক্রম চালু করা হয়নি। এমনকি দ্বিতীয় বছরের ছাড়কৃত একটি টাকাও খরচ করা হয়নি। প্রকল্পের প্রথম বছরে জোয়ারাধার চালুর জন্য ব্যয় বরাদ্দ ছিল ২৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে ১৩ কোট টাকা ছাড় করা হয়। এ টাকার মধ্য থেকে পাখিমারা বিলে পেরিফেরিয়াল বাঁধের ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। যদিও বাঁধের উচ্চতা ও বাঁধ কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে জনগণের আপত্তি রয়েছে।

এরইমধ্যে প্রকল্পের আরো একটি বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও এখনো জোয়ারাধার বাস্তবায়নের জন্য অসমাপ্ত রয়েছে অনেক কাজ। প্রকল্পের দ্বিতীয় বছরের কাজের জন্য বরাদ্দ ছিল ১১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫ কোটি টাকা ছাড় হয়েছে। কিন্তু  ছাড়কৃত টাকা থেকে চলতি বছর প্রকল্পের কোনো টাকা এখনো ব্যয় করা হয়নি। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গড়িমসি ও সমন্বয়হীনতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছর কপোতাক্ষ অববাহিকার পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার চালু না হলে বর্ধিত হারে পলি জমে কপোতাক্ষ নদ মরে যাবে। পরবর্তী বছর পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কপোতাক্ষ নদের বাঁচা-মরার সঙ্গে এ জনপদের প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবন জীবিকা প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত।

গবেষণা সূত্র বলছে, বিগত এক দশক ধরে জলাবদ্ধতার কারণে কপোতাক্ষসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ বসবাসের  জন্য অন্যত্র চলে যাচ্ছে। কপোতাক্ষের পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে এ এলাকা নিঃসন্দেহে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। তখন ব্যাপকভাবে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া মানুষের আর কোনো উপায় থাকবে না। এ কারণে অবিলম্বে প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি এলাকাবাসীর।

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোর ডিভিশনের কর্মকর্তাদের দাবি, টিআরএমভুক্ত জমির মালিকদের বিঘাপ্রতি ১৩ হাজার টাকারও বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি বছর পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে আগামী বছর কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। আর তাই দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ০০১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।