আমাদের দেশে যত প্রকারের সাপ রয়েছে তার মধ্যে ৯৫ শতাংশ সাপ নির্বিষ। অর্থাৎ, বিষ নেই।
‘সাপ মানেই বিষাক্ত, তাদের দেখামাত্রই মেরে ফলতেই হবে’- সাধারণ জনগণের এই ভুল বা ভ্রান্ত ধারণাটি শুদ্ধ বা সঠিক ধারণায় রূপান্তরিত করতে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছেন বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ।
সাপ ধরে উপস্থিত মানুষের মধ্যে সেই সাপটি সম্পর্কে নানা ধারণা দিয়ে তারপর পুনরায় সাপটিকে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেন তিনি। সাপ সম্পর্কে মানুষের মারাত্মক ভয়-ভীতি দূর করতে কখনো কখনো নিজেকেও সাপের কামড় বা ছোবল সহ্য করতে হয়েছে তাকে। শেষাবধি উপস্থিত জনগণকে তিনি বোঝাতে পেরেছেন- ‘ভাইরা, দেখলেন তো! এই সাপের ছোবল বা কামড় খেয়েও মরিনি আমি। আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি। সুতরাং, সাপকে কখনো মারবেন না। সাপ আমাদের প্রকৃতির বড় উপকারী প্রাণী। তাদের বাঁচতে সাহায্য করুন। ’
ঘটনাচক্রের শেষাংশে এমন কথাগুলো বলে উপস্থিত জনগণের মধ্যে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ’ পৌঁছে দেন তিনি। এই ম্যাসেজটি সংক্রমিত হয়ে ২০ জন থেকে বর্ধিত হয়ে ৪০ জনে কিংবা তারও ক্রমবর্ধিষ্ণু হয়ে দারুণ চাঞ্চল্যে পৌঁছে থাকে এক প্রান্তর থেকে অপর প্রান্তরে। এ ঘটনা প্রসঙ্গে আদনান আজাদ আসিফ বাংলানিউজকে বলেন, আমি গবেষণা কাজের জন্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে রয়েছি। রোববার (১৪ জুলাই) আমাকে সকাল ৬টার সময় আমাকে আমার এক স্টাফ এসে বলে, গাছে সাপ দেখা যাচ্ছে। গাছে সাপ! বিষয়টি শুনেই বিছানা থেকে উঠে আমার বিছানার পাশে রাখা ‘স্নেইক হুক’ (সাপ ধরার শিক) নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলের দিকে যাই। ধারণা করি- গাছের সাপ মানেই ভালো প্রজাতির সাপ হবে।
তিনি আরো বলেন, আম গাছে থাকা সেই সাপটির আমি তখন শুধু পেটের অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখি লোকজন জড়ো হয়ে বাঁশ-লাঠি নিয়ে সাপটিকে মেরে ফেলার জন্য একদম প্রস্তুত। আমি তাদের বলি- এ সাপটিকে কিছুতেই মারা যাবে না। পরে সেই সাপটি তখন এক গাছ থেকে অন্য গাছে চলাফেলা করতে শুরু করে। এভাবে তিন-চার ঘণ্টা কাটে। দুপুরের দিকে সাপটি গাছ থেকে নিচে নামার চেষ্টা করলেই তাকে কৌশলে ধরে ফেলি। সাপটি ধরার খবর শুনে সেই মানুষগুলো আবারো জড়ো হতে থাকে। উপস্থিত প্রায় অর্ধশত মানুষের সামনে সাপ সম্পর্কে মানুষদের সচেতন করার চেষ্টা করি।
সাপটির কামড় সম্পর্কে আদনান বলেন, সাপটিকে প্রকৃতিতে নিয়ে ছাড়তে গেলেই সে উল্টে এসে কামড় বাসায় আমার আঙুলে। আমি সঙ্গে সাঙ্গে হাত ঝাড়া দেই। সাপটি মাটিতে পড়ে যায়। তারপর লোক ধেয়ে আসে সাপটিকে মেরে ফেলার জন্য। তখন আমি সাপটিকে আড়াল করে রাখি তাকে বাঁচাবার জন্য। সে আবারও আমাকে কামড় বসায় এবং চলে যায়। তারপর উপস্থিত লোকজনকে বোঝাতে সক্ষম হই যে, ভয় পেয়ে সাপ আমাকে কাটলেও আমি দিব্বি বেঁচে আসি। সুতরাং, সাপ মারবেন না।
বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ বলেন, এ বিরল প্রজাতির সাপটির বাংলা নাম ‘জলপাইরঙা দাঁড়াশ’। এর ইংরেজি নাম Indo-chinese Rat Snake বৈজ্ঞানিক নাম Ptyas korros। এরা নির্বিষ ও খুবই দ্রুতগতির সাপ। গাছেই থাকতে পছন্দ করে। প্রজনন মৌসুমে ৪-১২টি ডিম দেয়। পাখি, গিরগিটি, ইঁদুর, ব্যাঙ খায়। সিলেটের বনাঞ্চল, বান্দরবান ও সুন্দরবনে কদাচিৎ দেখা যায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যপ্রাণি বিভাগের অধ্যাপক এবং বন্যপ্রাণী বিশারদ ও লেখক ড. মনিরুল এইচ খান বাংলানিউজকে বলেন, সব ধরনের সাপের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড ভীতি রয়েছে। অথচ শতকরা ৯৫ শতাংশ সাপের কিন্তু কোনো প্রকার বিষ নেই। জনসাধারণের এই ভ্রান্ত-ভীতি দূর করতে পারলেই আমাদের প্রকৃতিতে সাপ বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থায় সুশৃংখলা ফিরে আসবে।
‘সব সাপই কিন্তু আমাদের প্রকৃতির উপকার করে। বিষধর গোখরা বা কেউটে সাপ কিন্তু মানুষের বসতবাড়ির আশপাশেই থাকে। এদের প্রধান খাবার ইঁদুর। তাই তারা আমাদের বসতভিটার কাছাকাছি থাকে। তারা প্রচণ্ড ভয় বা আঘাত না পেলে কিন্তু কখনো ছোবল দেয় না। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৯
বিবিবি/এএ