ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

সবুজ ক্যাম্পাসে বর্ণিল প্রজাপতির রঙিন ঝাপটা

রাহাত চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২২
সবুজ ক্যাম্পাসে বর্ণিল প্রজাপতির রঙিন ঝাপটা

‘প্রজাপতি প্রজাপতি ‘কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গীন পাখা... নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা’বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হয়তো প্রজাপতির বর্ণিল রঙিন গড়নে মুগ্ধ হয়ে এই গানটি রচনা করেছিলেন। প্রকৃতির একটি অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি এ প্রজাপতি।

রঙে আর বৈচিত্র্যে প্রজাপতির তুলনা প্রজাপতি নিজেই। নান্দনিকতার পাশাপাশি উদ্ভিদের পরাগায়নসহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহনের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে প্রজাপতি।

কিন্তু দিনে দিনে কমছে রঙিন ডানার এই পতঙ্গের পরিমাণ। তাই প্রজাপতি সংরক্ষণে গণসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হয়েছিল প্রজাপতি মেলার। ‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’ এই স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কীটতত্ত্ব শাখার আয়োজনে ১২তম বারের মতো এই মেলার আয়োজন করা হয়।  


প্রজাপতির বাহারি রঙিন আকৃতি যে কারও মনকে উৎফুল্ল করে তুলে। তাইতো শহরের যান্ত্রিকতা, কোলাহল থেকে থেকে একটুখানি হাফ ছেড়ে বাঁচতে পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু নিয়ে অনেকেই ছুটে এসেছেন  প্রকৃতির কোলে রং ছড়ানো এই পতঙ্গটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। মেলা উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিশু, কিশোর, তরুণ-তরুণী, বয়োবৃদ্ধসহ হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত এ ক্যাম্পাসে।

সকাল থেকেই কুয়াশার চাদরে মোড়ানো শীতের নিস্তব্ধতাকে উপেক্ষা করে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। নগর জীবনের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেতে একটুখানি প্রশান্তির আশায় ঢাকার মিরপুর থেকে প্রজাপতি মেলা উপভোগ করতে এসেছেন শিহাব উদ্দিন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে। মেলায় এসে মেয়েরা ভীষণ আনন্দিত। প্রজাপতির হাটে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি দেখতে তারা ছোটাছুটি করছে এদিক-সেদিক। তিনি মেয়েদের বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।


শিহাব উদ্দিন জানান, ইট-পাথরের শহুরে জীবনে প্রজাপতি দেখা পাওয়া দুর্লভ।  তাইতো ফেসবুকে যখন প্রজাপতি মেলার কথা জানতে পারেন মেয়েদের নিয়ে ছুটে এসেছেন প্রজাপতি মেলা উপভোগ করতে।  



মেলার আয়োজনকে ঘিরে শিশু-কিশোরদের পাহাড় সমান আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। হরেক রকমের প্রজাপতির ওড়াউড়ি শিশু-কিশোরদের মনে সৃষ্টি করে গভীর আলোড়ন। বিচিত্র ও মনোমুগ্ধকর এসব প্রজাপতির পাখা যেন রঙ ছড়াচ্ছে শিশু-কিশোরদের মনে। সাভার থেকে বাবার সঙ্গে মেলা দেখতে এসেছেন ছোট রাফসান। বিচিত্র রকমের প্রজাপতি দেখে সে খুবই খুশি। এছাড়াও ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পেরে এবং পাপেট শো দেখে খুবই উচ্ছ্বাসিত দেখা যায় তাকে।  

দিনব্যাপী এ মেলার আয়োজন শুরু হয় সকাল ১০টায়।  বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করেন জাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হক।  

এ সময় আমন্ত্রিত অতিথিরা বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি প্রকৃতিতে উন্মুক্ত করেন। প্রকৃতি ও প্রজাপতি সংরক্ষণে অবদানের জন্য এবছর ‘তরুপল্লব’ সংগঠনকে ‘বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড-২০২২’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী দীপ্ত বিশ্বাসকে ‘বাটারফ্লাই ইয়াং ইনথুয়াসিয়াস্ট অ্যাওয়ার্ড-২০২২’ দেওয়া হয়।

এছাড়া মেলায় দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্যে ছিল শিশু-কিশোরদের জন্য প্রজাপতি বিষয়ক ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা। শিশু কিশোররা তাদের রঙিন তুলিতে ফুটিয়ে তোলে প্রজাপতির বিভিন্ন অবয়ব। ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন বয়সী প্রায় ১শ শিশু অংশগ্রহণ করে।  

এর আগে, অনুষ্ঠিত হয় কুইজ প্রতিযোগিতা। এতে প্রজাপতি বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নে অংশগ্রহণ করে শিশু-কিশোররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি চত্বরে আয়োজন করা হয় প্রজাপতির আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এতে প্রজাপতির নির্বাচিত বেশ কয়েকটি ছবি স্থান পায়।  
দর্শনার্থীরা এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির, রঙের প্রজাপতি সম্পর্কে জানার সুযোগ পান। তেমনি একজন শেখ নোমান। পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে।  


তিনি বলেন, প্রজাপতির এ আলোকচিত্রগুলোর মাধ্যমে নতুন নতুন বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। প্রকৃতিতে যে এতো বিচিত্র রকমের প্রজাপতি রয়েছে তা এর আগে জানা ছিল না। এছাড়াও প্রজাপতি বিষয়ক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা, জীবন্ত প্রজাপতির হাট দর্শন, প্রজাপতির আদলে তৈরি ঘুড়ি উড়ানো, প্রজাপতি ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বারোয়ারি বিতর্ক, প্রজাপতি চেনা প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি বিষয়ক ডকুমেন্টারি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

প্রজাপতির একেকটি ডানা যেন দক্ষ শিল্পীর তুলির পরশে আঁকা জীবন্ত ছবি। প্রজাপতি শুধু প্রকৃতির সুন্দরের প্রতীকই নয়, উদ্ভিদের পরাগায়ন এবং পরিবেশের মানদণ্ড সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই আয়োজন থেকে তাই পরিবেশে প্রজাপতি টিকে থাকার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।  

মেলার আহ্বায়ক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ১১০ প্রজাতির প্রজাতি দেখা মিলতো। কিন্তু ক্যাম্পাসে নগরায়নের ফলে প্রজাপতি তার আবাসস্থল হারাচ্ছে। ফলে দিন দিন কমছে প্রজাপতির পরিমাণ।

গত বছর ৬০ প্রজাতির প্রজাপতি দেখা গেলেও এবছর তা আরও কমে ৫২ তে নেমে এসেছে। প্রজাপতি প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিবেশে পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রজাপতি। তাই প্রকৃতিতে প্রজাপতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবছর সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রজাপতি মেলার আয়োজন।

২০১০ সাল থেকে প্রজাপতির সংরক্ষণ ও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রজাপতির গুরুত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে ধারাবাহিকভাবে এ মেলার আয়োজন করা হচ্ছে।

বাংলাদশ সময়: ২১২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০২২
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।