ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

শাক কেটে বিক্রি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন চরের নারীরা

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩
শাক কেটে বিক্রি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন চরের নারীরা শাক কাটছেন এক নারী। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: বাজার থেকে যে, মাছ-মাংস কেটে নিয়ে আসা যায়, সেই কথা কমবেশি সবাই জানেন। মাংস কিনলে কেটে নেওয়ার জন্য কোনো টাকা দেওয়া লাগে না।

তবে মাছ কেটে নিলে কিন্তু টাকা দেওয়াই লাগে। বাড়িতে লোক না থাকা বা কর্মজীবী গৃহিণীরা সময় বাঁচাতে সাধারাণত বাজার থেকেই মাছ কেটে নিয়ে আসেন।

কিন্তু শাক? শাক কী কেটে নিয়ে আসা যায়? কেউ কী শাক কেনার পর কেটে দেয়? না দেয় না। তবে ব্যতিক্রম হলেও এমন ঘটনা ঘটেছে- পদ্মাপাড়ের সবুজ শহর রাজশাহীতে। আজব মনে হলেও বিষয়টি গুজব নয় মোটেও।

রাজশাহী মহানগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড়েই বিক্রি করা হচ্ছে এই শাক। এখানে গেলে একেবারে ধুয়ে বেছে কেটে-কুটে রাখা শাকই কেনা যাচ্ছে।

সবার প্রিয় সুস্বাদু খেসারির শাক, বুটের শাক, হারিয়ে যাওয়া কাঁটাখোঁড়া ও বথুয়ার শাক মিলছে এখানেই। এসব শাকের চাহিদাও অনেক। তাই রাজশাহীর পদ্মার চর থেকে রকমারি শাক নিয়ে এসে শুধু এখানেই বিক্রি করছেন নারীরা।

রাজশাহী মহানগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল থেকে পশ্চিমে সোজা প্রায় চার কিলোমিটার পথ গেলেই পড়বে এই সিঅ্যান্ডবির মোড়। এখানেই রয়েছে রাজশাহী মহানগর পুলিশের সদর দপ্তর। তার পাশে রয়েছে জাতির জনকের ম্যুরাল। বলা হচ্ছে- এটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ম্যুরাল। আর তার পাশেই সারিবদ্ধভাবে বসে রোজ বিকেল থেকে শাক বিক্রি করছেন পদ্মার চরের নারীরা।

শাক কমবেশি সবারই খুব প্রিয়। প্রতিদিন পাতে একটু শাক যেন চাই-ই চাই। কিন্তু এই নগর জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে শাক কিনে কেটে-বেছে খাওয়ায় অলসতা রয়েছে অধিকাংশ মানুষেরই।

অনেকে শাক কাটা-বাছাকে যেন একরকম আপদই মনে করেন। আর এ কারণে পছন্দের হওয়া সত্ত্বেও অনেকের পাতে ওঠে না খেসারি, বথুয়া ও কাঁটাখোঁড়া শাক। তবে এবার রাজশাহী মহাগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ে পছন্দের শাক কেটে-ধুয়ে বিক্রি করছেন নারীরা। ব্যাপক চাহিদা থাকায় শাক বিক্রি করে স্বাবলম্বীও হচ্ছেন এই নারীরা।

মহাগরীর সিঅ্যান্ডবির মোড় ছাড়াও পদ্মাপাড়, পদ্মা গার্ডেন, বাইপাস মোড়সহ বেশকিছু স্থানে নারীদের সারিবদ্ধ হয়ে শাক কেটে বিক্রি করতে দেখা যায় এখন। তবে সিঅ্যান্ডবি মোড়েই শাক বিক্রি হয় বেশি। তারা পদ্মার জেগে ওঠা চরসহ গ্রাম থেকে শাক সংগ্রহ করে শহরে এনে বিক্রি করেন। অনেকে আবার কিনেও আনেন।

তাদেরই একজন শেফালি বেগম। তিনি জানান, খেসারি, বুট, কাঁটাখোঁড়া ও বথুয়ার শাকের চাহিদা অনেক। কিন্তু কাটা-বাছার কারণে অনেকেই এসব শাক কিনতে চান না। প্রথম দিকে তিনি শুধু শাক তুলে এনে বিক্রি করছিলেন। কিন্তু ক্রেতারা আসেন, দেখেন আর দরদাম করে চলে যান। তেমন কেউই শাক কিনতে চান না। এরপর স্থানীয় কয়েকজনের পরামর্শে তিনি শাক এনে তা বেছে-ধুয়ে কেটে-কুটে বিক্রি শুরু করেন। আর নতুন এই পদ্ধতিই বাজিমাত হয়ে যায়। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে মানুষ বিষয়টি জানতে পারেন। কাটা শাক পেয়ে অনেকেই আগ্রহ করে কিনতে শুরু করেন। এরপর তার দেখাদেখি অন্যরাও এই পথ অনুসরণ করেন। শাক কেটেও বিক্রি করায় চাহিদাও বেড়েছে।

অপর শাক বিক্রেতা রেজিনা। তিনি বলেন, গত দুই মাস থেকে এখানে নিয়মিত শাক বিক্রি করছেন তারা। এখন তার মতো আরও ৬/৭ জন নারী শাক কেটে বিক্রি করছেন। কেউ পদ্মার চর থেকে শাক তুলে আনেন। আবার কেউ জমির মালিকের থেকে কিনেও নিয়ে আসেন। খেসারির ও বুটের শাক বেছে-ধুয়ে কেটে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন। আর কেটে না নিলে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। এছাড়া বথুয়ার শাকের দাম কম। কেটে নিলে ৬০ টাকা এবং গোটা নিলে ৪০ টাকা কেজিতে বথুয়ার শাক বিক্রি করেন। এই শাক বিক্রি করে প্রতিদিন তাদের গড়ে ৩০০-৪০০ টাকা লাভ হয়। প্রতিদিনের শাক প্রতিদিনই বিক্রি হয়ে যায় কোনদিন বেঁচে গেলে তা বাজারে বিক্রি করে দেন বলেও জানান- এই নারী শাক বিক্রেতা।

বেবী খাতুন নামের আরেক শাক বিক্রেতা বলেন, প্রতিদিন বিকেল হলেই তারা এখনে বসেন। থাকেন রাত ৮/৯ পর্যন্ত। তাই বিকেলে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে রান্নার জন্য তৈরি করা এসব শাক কেনার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন অনেকেই। দরদাম করে কিনছেনও। তারা এসব শাক পরিবারের সবার পছন্দের। কিন্তু না কেটে এই শাক বাসায় নিয়ে গেলে পচে নষ্ট হবে। খাওয়া হবে না। তাই প্রায়ই এখান থেকে শাক কেটে নিয়ে যান।

কথা হয় এখানে শাক কিনতে আসা এনজিও কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামের সঙ্গে।  

তিনি বলেন, শাক রান্নার চেয়ে কাটা-বাছাই বেশি কষ্টকর। আর যারা চাকরি সুবাদে তার মত পরিবার ছেড়ে একা থাকেন তাদের জন্য আরও কষ্টকর। মন চাইলেও শাক কিনতে পারেন না। আর বাড়ির বুয়ারাও শাক কেটে রান্না করেও দিতে চান না। এ কারণে শাক আর পাতে ওঠে না। পছন্দের শাক বাজারে গিয়ে দেখতেই হয়, কেনা হয়ে ওঠে না। তবে এখানে অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে টাটকা শাক কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। তাই তার মত আধা কেজি ও এক কেজি করে খেসারি ও বুটের শাক কিনছেন অনেকেই। এগুলো বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কেবল তেল, মসলা দিয়ে রান্না করলেই হয়ে যাবে। এটা অনেক সুবিধার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে রাজশাহীর সিঅ্যান্ডবির মোড় এলাকার ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব রহিস উদ্দিন বাবু বলেন, এই শাকগুলো সব শ্রেণীর মানুষেরই অনেক প্রিয় অত্যন্ত পছন্দের। কিন্তু সব জায়গায় পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না সব সময়ও। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে চরসহ গ্রাম থেকে তরতাজা শাক এনে বিক্রি করেন এই নারীরা। আর এই শাকের স্বাদের কোনো তুলনা হয় না। যারা রাজশাহী শহরে বসবাস করেন চাইলে তারা এখান থেকে শাক ধুয়ে-বেছে একাবারে কেটে-কুটে বিভিন্ন রকমের শাক নিয়ে যেতে পারেন বাড়িতে। রান্নার উপযোগী এমন শাক পেলে আর যাই হোক- অন্তত বাড়ির গৃহিণীর মুখে হাসি ফুটবেই। আর অল্প টাকায় একটা চমকও দেওয়া যাবে গৃহিণীদের।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।