ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

স্বাধীনতা দিবসে বিসিএস ক্যাডারদের ভাবনা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
স্বাধীনতা দিবসে বিসিএস ক্যাডারদের ভাবনা

ঢাকা: ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। ২০২৩ সালের এই দিনে স্বাধীনতার ৫১ বছর শেষ হয়ে ৫২ বছরে পদার্পণ করছে বাংলাদেশ।

দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রামের ফসল আমাদের স্বাধীনতা। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতার জন্য ৭ কোটি বাঙালিকে বেছে নিতে হয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথ।  

মহান স্বাধীনতা দিবসে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিভিন্ন জেলায় কর্মরত সহকারী কমিশনার, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী পুলিশ সুপারদের ভাবনা তুলে ধরেছেন ইসমাম হোসাইন

স্বাধীনতা এক আবেগের নাম
আলোক ব্যতীত যেমন পৃথিবী জাগে না, স্রোত ব্যতীত যেমন নদী টেকে না, স্বাধীনতা ব্যতীত তেমনি কোনো জাতি বাঁচতে পারেনা। আমরাও সেই চিরন্তন সত্যের পথ ধরেই ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছি আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তাকে চির সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে আবহমানকাল ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রেরণা যোগাবে এ জাতিকে। যা সংস্কৃতি চেতনার ও বলিষ্ঠ প্রত্যয়ী অনুপ্রেরণা।  

"এই দেশের বাঁশ বাগানে জোছনা দেখতে চাইব, বিভেদ ভুলে আমরা সে পথেই অগ্রসর হব। " স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল একটি শোষণমুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রাষ্ট্র প্রবর্তন। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবাইকে স্বনির্ভর করেছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সেই লক্ষ্য নিয়েই দেশ গঠন করেছিলেন।  

সাবাস বাংলাদেশ, এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়। স্বাধীনতার ইতিহাসের পশ্চাতে রয়েছে- ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ।  

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হায়েনারা এদেশের ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে হামলা চালালো, নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, রচনা করতে থাকলো একের পর এক বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়ল নিজেদের রক্ষার আন্দোলনে, জড়িয়ে পড়লো মহান মুক্তিযুদ্ধে।  

কবির ভাষায়- কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ খামারে, সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।  

মাত্র একজন একটি ভাবনার জন্য প্রাণ দিতে পারে, তবে সেই ভাবনা তার মৃত্যুর পরে হাজার জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু ভুললে চলবে না যে, আমাদের স্বাধীনতা অনেক রক্তের দামে কেনা। শহীদদের এই পবিত্র রক্তের দায় জাতি হিসেবে আমাদের সবারই। সেই দায় শোধ হতে পারে কেবল স্বাধীনতাকে সবার জন্য উপভোগ্য করে তোলার মাধ্যমে। এই প্রত্যয় নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যৎ কালের পথে।  

স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য বেশি প্রয়োজন সংগ্রাম ও শক্তির। আর স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রযুক্তি, কৌশল, ঐক্য ও ন্যায়বোধ। এছাড়াও স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা ও সৎ বিবেচনাকে কাজে লাগানো একান্ত অপরিহার্য। মূলত যথেষ্ট সচেতন ও সংঘবদ্ধ না হলে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যায় না। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে হয় এবং সদা সতর্ক থাকতে হয়। তাই স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করে একে রক্ষা আমাদের জাতীয় কর্তব্য মনে করা উচিত।  

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের এই মৌল চেতনা সবাইকে অনুপ্রাণিত করুক- এটাই মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যাশা। স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে একটি আধুনিক, প্রগতিশীল ও কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার পথযাত্রায়। স্বাধীনতা দিবসই বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঁক বদলকারী ঘটনা। স্বাধীনতা যেকোনো জাতির জন্য একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।  

স্বাধীনতা আমাদের সামনে স্বর্ণ দুয়ার খুলে দেয়। যে দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে আমরা আমাদের যুগসঞ্চিত জঞ্জাল দূর করার পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। স্বাধীনতা দিবস জাতি হিসেবে আমাদের আত্ম মর্যাদার বর্ণিল স্মারক।  

এক আশ্চর্য সময় এসেছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। সৃষ্টি হয়েছিল নক্ষত্রপুঞ্জের মতো অসংখ্য অবিস্মরণীয় ঘটনা কাহিনীর। পুরো জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার জন্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। রক্তস্নাত দোআঁশ মাটি ভিত্তি করে আবির্ভাব ঘটেছিল নতুন করে এ জাতির।

এদিন সমগ্র দেশবাসীর বহুকাল লালিত মুক্তি ও সংগ্রামের অঙ্গীকারে ভাস্বর এবং আত্মপরিচয়ের গৌরবে উজ্জ্বল, ত্যাগে ও বেদনায় মহীয়ান। প্রতিবছর গৌরবময় এই দিনটি পালন করতে গিয়ে আমাদের কর্তব্য হয়ে ওঠে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সাধ আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি, জাতীয় জীবনে আমাদের অর্জন কতটুকু আর বিশ্বসভায় আমাদের অবস্থান কোথায়! সেসব মিলিয়ে দেখা এবং এদিক থেকে এ দিনটি আমাদের আত্মসমালোচনার দিন, হিসেব মেলাবার দিন, আত্মজিজ্ঞাসার দিন।  

এ দিনটি বাঙালির জীবনে বয়ে আনে আনন্দ-বেদনা, অম্ল-মধুর অনুভূতি। একদিকে হারানোর কষ্ট, অন্যদিকে প্রাপ্তির আনন্দ। শেষ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়ে যেন স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দটা হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে মুখ্য বিষয়।  

আমাদের জন্য স্বাধীনতা দিবসের মূল তাৎপর্য হলো- এটি আমাদের ত্যাগ ও মুক্তি সংগ্রামের গৌরবময় একটি দিন। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, তা এ দেশের মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে যুগে যুগে প্রেরণা জোগাবে।  

সর্বোপরি কবির ভাষায়- জননীর নাভিমূল ছিন্ন করা রক্তজ কিশোর তুমি স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও। তুমি বেঁচে থাকো আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে, প্রেমে, বল- পেন্সিলের যথেচ্ছ অক্ষরে, শব্দে, যৌবনে, কবিতায়।

শামসুল আলম, 
সহকারী পুলিশ সুপার,
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।

***

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের 
'পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায় তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা। ' স্বাধীনতা তার কথা রেখেছিলো। এই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদী বিধৌত পললভূমিতে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য সেদিনই উদিত হয়েছিলো, যেদিন বাংলার স্বাধীনতার মহাকবি রেসকোর্স ময়দানে বলিষ্ঠ তর্জনী উঁচিয়ে তাঁর অমর কবিতা শোনালেন। অগ্নিঝরা মার্চের ৭ তারিখে রাজনীতির কবি স্বাধীনতার উপর আমাদের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন।  

সেই কবি আর কেউ নন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর স্বাধীনতার ডাককে অগ্রাহ্য করার মত দুঃসাহস বাঙালি করেনি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যার যা আছে তাই নিয়ে দুঃসাহসী বঙ্গসন্তানরা ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর আক্রমণকে রুখে দিতে।  

বাঙালি বীরের জাতি, যুদ্ধে পশ্চাতপদতার ভীরুতা দেখায়নি কখনো। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ট্যাংকবহর নিয়ে ঢাকার রাস্তায় নামলো 'অপারেশন সার্চলাইট'-এর ফরমান নিয়ে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বীর পুলিশ সদস্যরাই সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্নেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বুলেটটি শত্রুর দিকে ছুটে যায় এই দেশপ্রেমিক অকুতোভয় বীর পুলিশ সদস্যদের সাধারণ রাইফেল থেকে। এই সদর্প আক্রমণ বিশ্বের বুকে জানান দেয়, বাঙালির সবচেয়ে বড় অস্ত্র সুগভীর দেশপ্রেম। সাধারণ থ্রি নট থ্রি আর মার্ক ফোর রাইফেল দিয়ে রাজারবাগে পাকিস্তানি হায়েনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বীর পুলিশ সদস্যরা। এই ইতিহাস দারুণ গর্বের। শিরদাঁড়া সোজা করে শির সমুন্নত রাখার অহংকার এনে দেয়।

দীর্ঘ ৯ মাস দুর্বার আক্রমণ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। ত্রিশ লাখ বীর শহীদের রক্তে রঞ্জিত এই মাটি আজো তাঁদের কথা বলে। এই বাংলার বাতাসে কান পাতলে আজও শোনা যায় সেই মা-বোনদের করুণ আর্তচিৎকার।  

এই স্বাধীনতার লাল সূর্যকে আনতে গিয়ে বাংলা মায়ের যে অগণিত তরুণ অরুণকে অস্তমিত হতে হয়েছে, তারই ইতিহাস বীরপ্রসূ এই বঙ্গভূমি লিপিবদ্ধ করে রেখেছে তার গহীন হৃদয়ের পরতে পরতে। রক্তের নদী পেরিয়ে আনা এই স্বাধীনতাই, বিশ্বের বুকে আমাদের স্পর্ধিত পরিচিতি। স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমির বিজয় কেতনকে যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সমুন্নত রেখে গেলো, তাদের বিজয়গাঁথা চিরদিন গাইবে পদ্মা-যমুনা-গৌরি-মেঘনার স্রোতধারা।  

বাংলার আকাশে যেই তারাগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, তারা আজও আমাদের পথনির্দেশ করে সেই দিনগুলোতে, যখন এই সবুজ-শ্যামলিমা ঢাকা পড়েছিল ক্রোধের অনলে। ছাইচাপা আগুনের মত বুকের গহীনে জ্বলা ধিকিধিকি অগ্নিস্ফুলিঙ্গই হলো আমাদের সুগভীর দেশপ্রেম। যেই দেশপ্রেম সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এক সুতোতে গেঁথে সদর্প আক্রমণ করতে বাধ্য করেছিলো শত্রুর বিরুদ্ধে। বীর মুক্তি সন্তানরা ছিনিয়ে আনলো বিজয় নিশান, কারণ মুক্তি ছাড়া তাঁদের জীবনের দাম তুচ্ছ ছিলো তাঁদের কাছে। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ মুক্তি সংগ্রামের তূর্যনিনাদ বাজিয়েই যাবে আবহমান কাল ধরে।

'স্বাধীনতা তুমি বাগানের ঘর, কোকিলের গান, বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা, যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা'! স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা যে কঠিন, এ কথা সবার জানা। দেশমাতৃকার গৌরবগাঁথা সমুজ্জ্বল রাখতে সবাইকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব সুদক্ষভাবে করতে পারাটাই আসল দেশপ্রেম।  

'এই বাংলার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বটাকে কাঁপিয়ে দিলো কার সে কণ্ঠস্বর, মুজিবর, সে যে মুজিবর'-
জাতির জনকের সেই স্বপ্নের 'সোনার বাংলা' বিনির্মাণে আমাদের সবাইকে কাজ করে যেতে হবে। মৃত্যুকে পায়ে দলে যারা বিজয় ছিনিয়ে এনে, বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের পরিচয় খচিত করে দিয়েছে উজ্জ্বলভাবে, সে সম্মান রাখার দায়িত্ব আমার আপনার সকলের। মহান স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হোক, এই প্রত্যাশা রইলো। জয় বাংলা।

ডা. জয়া রায় চৌধুরী, 
সহকারী পুলিশ সুপার, 
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।

***
স্বাধীনতা একটি স্বপ্ন
স্বাধীনতা বাংলা অক্ষরে লিখিত কোনো সাধারণ শব্দ না, স্বাধীনতা আমার মায়ের মুখের ভাষা ফিরিয়ে দেওয়া, কৃষকের মুখে হাসি এনে দেওয়া, আমার কলমে ভাষা ফিরিয়ে দেওয়া। স্বাধীনতা আমার কাছে সেই মায়ের অনুভব, যে মা নিজের বুকের ধন বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্য। যে আশায় মা তার সেরা সম্পদ বিসর্জন দিয়েছিলেন তারই উত্তরসূরি আমরা। জাতির পিতার আহ্বানে ২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা।  

এই সশস্ত্র প্রতিরোধটিই বাঙ্গালীদের কাছে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরুর বার্তা পৌছে দেয়। পরবর্তীতে পুলিশের এই সদস্যরা ৯ মাসব্যাপী দেশজুড়ে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১২৬২ জন শহীদ পুলিশ সদস্যের তালিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।

স্বাধীনতার গল্প শুনতে শুনতে কখন যে পুলিশের মাঝে নিজের ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি, নিজেও বুঝতে পারিনি। পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে নিজে পুলিশ বাহিনীর গৌরবের ইতিহাস অনুভব করতে পারি।

স্বাধীনতার এই ৫২তম বর্ষে পদার্পন করে হয়তো আমাদের অনেক আশা পূরণ হয়েছে, অনেক আশা পূরণ হয়নি। কেবল পতাকা দেখি, কেবল উৎসব দেখি চারিদিকে। শুধু পালনের জন্য এই স্বাধীনতা আমাকে ব্যথিত করে। যখন পত্রিকার পাতায় মুক্তিযোদ্ধার কান্না; দারিদ্রক্লিষ্ট ছবি দেখি, কৃষকের চোখে হতাশ দেখি, সেই অবস্থা আমাকে ব্যথিত করে। বিচারের বাণী যখন নিভৃতে কাঁদে, বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করি।  

আশা রাখি, উন্নয়নের মহাসড়কের এই উৎসব একদিন পূর্ণতা পাবে। চারিদিকের হতাশা শেষে বসন্ত আসবে। আমরা প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করে যেতে পারি, দেশ একদিন এগিয়ে যাবেই। জাতির পিতা সবুজ মাঠে পায়ে শিশির মাখিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন একদিন পূর্ণতা পাবে। এখন প্রচুর মেধাবী ছেলে সিভিল সার্ভিসে আসছে, এই স্রোত একদিন দেশকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেবে। তখন আমরা পৃথিবীর বুকে আরো গর্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারবো। আমাদের তরুণদের উপরেই নির্ভর করছে আমাদের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ।  

মানস কির্ত্তনীয়া নয়ন, 
সহকারী পুলিশ সুপার,
পুলিশ হেডকোয়ার্টার, ঢাকা।

***

অদম্য অগ্রযাত্রায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ
২৬ মার্চ। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ গড়ার প্রত্যয়ে দখলদার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আজকের এ দিনে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো বাংলার দামাল জনতা। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে সৃষ্টি হয় লাল সবুজের বাংলাদেশ।  

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ- যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। ৯ মাস যুদ্ধকালীন যে দেশটির সবকিছু পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিলো, আজ সেই দেশটিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবার পথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। ৫২ বছরের পথপরিক্রমায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ আজ সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়।

একটা সময় যে দেশটির অর্থনীতি ছিলো অনেকাংশেই কৃষি নির্ভর, সেখান থেকে ক্রমশ বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে আমাদের অর্থনীতি। ১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৪ ডলার। আর বর্তমানে সেটি ২৭০০ ডলারের বেশি। অতি দারিদ্র্যের হার এখন অনেকটাই নিম্নমুখী, বেড়েছে প্রবাসী আয়।  

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২০ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ দশমিক ৬ বছর। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু যথাক্রমে ৬৭ দশমিক ৭ বছর ও ৬৭ দশমিক ৩ বছর। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতের সুফল মিলছে গড় আয়ুতে। ১৯৭২-৭৩ সালে বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার। আর ২০২২-২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকায়।  

বেড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এক হাজার ৫৬৬ গুণ। খাদ্য উৎপাদনে এসেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, পূর্বের তুলনায় নবজাতক ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমেছে। প্রায় এক কোটির অধিক প্রবাসী বাইরে থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। তাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রবাসীদের আয়ের হিসাবে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে। নারীর ক্ষমতায়নে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য।

সারা দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাম-ইউনিয়ন-উপজেলা-জেলাসহ সব ক্ষেত্রে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে সাধারণ জনগণ। এখন গ্রামের সাধারণ কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য দ্রুত সময়ে ও কম খরচে শহরে আনতে পারছে। সারাদেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে ঘর।  

দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেবার অভিপ্রায়ে দেশের ৪,৫৬২টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। বর্তমানে দেশের সবকটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। বিদ্যুৎখাতে এখন আর আগের মতো ভোগান্তি নেই, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ওষুধ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের।

অদম্য অগ্রযাত্রায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে সমস্ত বাঁধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, এটাই হোক এবারের স্বাধীনতা দিবসের দৃপ্ত অঙ্গীকার।

শিবু দাশ সুমিত, 
সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট,
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নড়াইল।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।