ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

স্বচ্ছ রোদের প্রভাতলোকে শুভ্রতার উৎকৃষ্ট নিশ্বাস

নাঈমুল রাজ্জাক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০২৩
স্বচ্ছ রোদের প্রভাতলোকে শুভ্রতার উৎকৃষ্ট নিশ্বাস

বাংলার প্রকৃতিতে এখন বিরাজ করছে সুমঙ্গলা হেমন্ত। হেমন্তের যৌবন খুবই অল্প সময়ের।

হেমন্ত তার রূপমাধুরীতে রাঙিয়ে দেয় প্রকৃতির প্রতিটি প্রহর। হেমন্তে প্রকৃতি থাকে শুভ্র-সতেজ। মেঘাছন্ন আকাশ ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে পরিপাটি। ষড়ঋতুর এ দেশে হেমন্ত হলো শুভ্রতার প্রতীক, স্বচ্ছ রোদের প্রভাতলোকে। হেমন্ত হলো কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের সমন্বয়ে গঠিত। হেমন্তের আসল চেহারা ফুটে ওঠে শরতের পরে। এ সময় স্নিগ্ধতা বিমোহিত থাকে মন। প্রকৃতির বুকে, শুভ্রতার উৎকৃষ্ট নিশ্বাসেও জেগে ওঠে প্রণয়ের রেখা, বেজে ওঠে হৃদয়ের সুর আলোকিত স্বস্তির ভেতরে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ নিয়ে বলেছিলেন তার কবিতায়, 'এই শরৎ-আলোর কমল-বনে/ বাহির হয়ে বিহার করে,/ যে ছিল মোর মনে মনে। তারি সোনার কাঁকন বাজে,/ আজি প্রভাত কিরণমাঝে, হাওয়ায় কাঁপে আঁচলখানি,/ ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে। '

হেমন্তেও রয়েছে উদাসীন প্রকৃতির স্নিগ্ধ মধুর কাব্যিক উপমা। যা বিমোহিত করে মনকে। প্রকৃতির বুকেও থাকে শুভ্র- সতেজতা। যা সৌন্দর্যে অনন্য। তেমনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্ত নিয়েও বলেছিলেন তার কবিতায়।

‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।
ক্ষীণ নদীরেখা
নাহি করে গান আজি, নাহি লেখে লেখা
বালুকার তটে। দূরে দূরে পল্লী যত
মুদ্রিতনয়নে রৌদ্র পোহাইতে রত
নিদ্রায় অলস ক্লান্ত। ‘

হেমন্তের প্রতিটি প্রহরেই যে শিরা উপশিরায় প্রবাহিত মুগ্ধতার পদধ্বনি। ধানক্ষেতে নেমে আসা বালিহাঁসের ঝাঁক, শেষ বিকেলে পশ্চিম আকাশ রাঙিয়ে দেওয়া সাত রঙের রংধনু। সন্ধ্যার প্রফুল্লতা মানুষের ভেতর জগৎ, প্রকৃতিকে করে তোলে লাস্যময়ী।

হেমন্তের নামান্তরই যেন নবান্ন। একটা সময় ছিল, যখন নবান্নের উৎসবে গ্রামবাংলার লোকেরা মেতে উঠতো। ধনী-গরিব সবাই মিলে অগ্রহায়ণের প্রথম বৃহস্পতিবার পালন করতো নবান্নের উৎসব। এতে ধনী-গরিব সবার মধ্যে তৈরি হতো সম্প্রীতির এক সুদৃঢ় বন্ধন। অসংখ্য স্বপ্নচারীর ইন্দ্রের অনুগত বিন্যাসের মতো, রূপালি রাতও প্রাণ খোলা উৎসবে মেতে উঠে যেমন আলোকিত স্বস্তির ভেতর। মৃদু ছায়াও সৃষ্টি হয় বৈচিত্র্যের সুর।

হেমন্ত তার সৌন্দর্য ও শুভ্রতায় অনন্য। তার সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে দেয়, শুভ্রতায় মন জুড়িয়ে দেয়। সুশোভিত করে তোলে দেহ-মন সারাক্ষণ। প্রকৃতির রূপলাবণ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সৌন্দর্যবোধ, চেতনা থাকলেই হেমন্তের প্রকৃতির সৌন্দর্য চোখে পড়বে। তবে বেশিরভাগ সময়ই আকাশজুড়ে ভেসে বেড়ায় তুলার মতো শুভ্র মেঘগুলো।

হেমন্তের আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় যেন কোনো চিত্রশিল্পীর রংতুলির আঁচড়ে সযত্নে আঁকা সুনিপুণ এক চিত্রকর্ম। সে এক কাব্যিক অনুভূতি, যা কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনকে ভাবুক করে তোলে। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততায় জানালার গ্রিলের ফাঁকে এক টুকরা গাঢ় নীল আকাশ আর শুভ্র মেঘের ছোটাছুটি। মানুষের নাগরিক চোখকে স্বস্তি দেয়, দেয় সতেজতা, প্রাণচাঞ্চল্য।

ঋতুরাজ বসন্তের যেমন রয়েছে রঙের বা বর্ণের ঐশ্বর্য আর রূপের রাজকীয় অহঙ্কার; হেমন্তের তেমন সৌম্য, নির্মল সৌন্দর্য আর শান্ত ভাবমূর্তি।

হেমন্তের সকালে শিউলির সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে উৎসবের আমেজ। হেমন্তে শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজঅশোক ইত্যাদি নাম না জানা আরও নানা জাতের ফুল ফোটে। যদিও নগরজীবনে হরহামেশা এসব ফুল দেখা যায় না। একঘেয়ে জীবনে পরিপাটি করে বাঁধা খোঁপা অথবা বিনুনি কিংবা খোলা ফুলে শিউলির মালা কিংবা রাধাচূড়া ফুলের উপস্থিতি সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেবে বই কমবে না, মনটাও হবে সতেজ। হেমন্তের প্রকৃতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো মৃদুমন্দ বাতাসে সবুজ ধানের কচি পাতাগুলো একসঙ্গে দুলতে থাকে। এর সৌন্দর্য ব্যাখ্যাতীত।

বলা যায়, হেমন্ত আসে মানুষের মনের আঙিনায়। গ্রামীণ জীবনেই এর উপস্থিতি বেশি টের পাওয়া যায়। কারণ, গ্রামে প্রতিটি ঋতুই আপন আপন রূপবৈচিত্র্যে অধিষ্ঠিত। পর্যায়ক্রমে প্রকৃতিতে ঋতু পরিবর্তন । তাই প্রকৃতি জীবন্ত।
 
হেমন্ত বাংলার সাহিত্যে এর উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়। মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস, মহাকবি কালিদাস থেকে শুরু করে আধুনিক লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় হেমন্ত বন্দনা দেখা যায়।

সাহিত্য-সংস্কৃতি তো আছেই। হেমন্তের প্রকৃতির এ সৌন্দর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেও সজ্জিত হতে পারেন ।

দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস প্রতি বছরই নিয়ে আসে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বৈচিত্র্যময় পোশাক। তাই চাইলেই কেউ রাঙাতে পারেন হেমন্তের রঙে। প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত। নাগরিক কোলাহল আর দৈনন্দিন ছকে বাঁধা জীবনের কর্মব্যস্ততার মাঝে ছুটির দিনে কিংবা অবসরে প্রিয়জনদের নিয়ে হারিয়ে যেতে পারেন নীল আকাশের মাঝে, যা নাগরিক জীবনে কর্মব্যস্ততা থেকে একটু হলেও স্বস্তি দেবে। ঝলমলে প্রাণবন্ত আকাশ যে কারও মন মুহূর্তেই ভালো করতে পারে। মেঘের রাজ্যে টুকরো টুকরো নীলকে হারিয়ে যেতে দেখবার জন্য এ হেমন্ত কাল সেরা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০২৩
আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।