ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

লাশ কাটতে এখন ভয় লাগে না

নাজমুল হাসান, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৫
লাশ কাটতে এখন ভয় লাগে না ছবি: আনন্দ / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে – ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ। ’

জীবনানন্দের ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতার চরণগুলো নীরবে, নিভৃতে একাকী আউড়ানো শুরু করলে কখনো-সখনো কাঁটা দেয় গায়ে।

ঘিরে ধরে অজানা ভয়। মানুষের মৃত্যু, মৃত্যু ভাবনার চমৎকার বিন্যাস এ কবিতা।
লাশকাটা ঘর....! কেমন সেটি? কৌতূহল নিবৃতে মনে সাহস নিয়ে হলাম অগ্রসর।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। লাশকাটা ঘরে পা রাখতেই অদ্ভুত এক গন্ধ নাকে ভেসে এলো। কিছুক্ষণের জন্য অনুভূতিগুলো যেন নিলো ভিন্ন রূপ। চারদিক স্তব্ধ। কয়েকটি নিথর দেহ পড়ে আছে লাশঘরে। বিশাল ঘরে এতো লাশের মধ্যে একজন জীবিত মানুষ লাশ কাটা ছেঁড়া নিয়ে ব্যস্ত। শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে এলো। লাশ কাটা ছেঁড়া নিয়ে ব্যস্ত মানুষটি মর্গ সহকারী।
বলছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের কথা।
লাশঘর শুনলেই অনেকে আ‍ঁতকে ওঠেন। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক হাসাপাতালেই এই লাশকাটার সঙ্গে যুক্ত অনেক মানুষ, যাদের ব্যস্ততা লাশঘর ঘিরে।

লাশ কাটা ছেঁড়ার সঙ্গে যুক্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তেমনি একজন মানুষ সিকান্দার (৪৬)। তিনি জানান তার পেশা জীবনের নানা অভিজ্ঞতা।

প্রায় ৩৫ বছর ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিজিকে মর্গসহকারী হিসেবে যুক্ত রেখেছেন। এই পেশা নিয়ে হয়েছে তার নানা অভিজ্ঞতা।
লাশঘরে প্রথম আসা ও প্রথম লাশ কাটার অভিজ্ঞতা নিয়ে জানতে চাইলে সিকান্দার মিয়া বলেন, আমি আগে হিন্দু ছিলাম। আমার বংশের অনেকেই এই পেশার সঙ্গে আগে যুক্ত ছিলেন। এই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগে আমার চাচা কাজ করত। চাচা মারা যাওয়ার পর আমি চাচার কাজটি বুঝে নেই।

প্রথম যেদিন লাশ ঘরে আসি তখন অনেকটা ভয় লেগেছিল। স্বাভাবিকভাবে যে কেউ হঠাৎ এই রকম পেশায় এলে ভয় পাওয়াটাই স্বভাবিক। প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮টি লাশ মর্গে আসে। একা একা লাশ কেটেছি। তখন ভয় লাগলেও কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। কিন্তু সব কিছুরই একটা পরিবর্তন হয়, অভ্যস্ততা আসে। ঠিক তেমনি আমারও তা হয়ে যায়। এখন আর লাশ কাটতে ভয় লাগে না। কারণ এটা আমার পেশা। ভয় পেলে চলবে না। এই কাজ করে আমার আয় রোজগার করতে হয়।

বাংলাদেশে এরা ডোম নামে পরিচিত। সুস্থ মানুষ হয়ে আপনি যখন বিকৃত লাশের সামনে যান তখন কোনো ভয় পান কি-না? অথবা একা ঘরে বা একা যখন চলাফেরা করেন তখন ভয়ের জন্য মানসিক কোনো প্রভাব পড়ে কি-না?
এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভয় বলতে কোনো কিছু মাথায় আসে না। একা একা থাকলে ভয় পাওয়ার বিষয়টি কখনো হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে কোনো ট্রাজেডিতে অনেক মানুষ মারা যায়। বিভিন্ন বয়সের মানুষের মৃতদেহ যখন একসঙ্গে দেখি তখন একটু খরাপ লাগে। তবে ভয় পাওয়ার তেমন কিছু হয়নি এখনো।

প্রায় ৩৫ বছরে রাতে লাশঘরে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে কি-না? এমন প্রশ্নে সিকান্দার বলেন, সূর্য ডোবার পর আমরা আর এই কাজ করি না। কিন্তু যখন জরুরি কোনো কাজের প্রয়োজন হয়, যেমন রাষ্ট্রের কোনো কাজ যেখানে সরকারের নির্দেশনা থাকে, অথবা ডাক্তাদের প্রয়োজনে রাতে কাজ করতে হয়। আন্য সময় যেভাবে কাজ করি রাতেও ঠিক স্বাভাবিকভাবে কাজ করি।

আমাদের নিয়ে অনেকের ধারণা আমরা কাজ করার আগে বিভিন্ন নেশা জাতীয় জিনিস পান করে তারপর কাজ করি। এটা ভুল ধারণা। আগে হয়তো গুটিকয়েক মানুষ কাজ শুরুর আগে নেশা জাতীয় কিছু পান করত যাতে নাকে র্দুগন্ধ না লাগে। তবে এখন র্দুগন্ধ এড়ানোর জন্য অনেক মেডিসিন ব্যবহার করা হয়, যার ফলে এসব নেশা থেকে অনেকেই দূরে রাখে নিজেকে।

মর্গ সহকারীর কাজের সঙ্গে যুক্তরা ৪র্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা। সাত থেকে আট হাজার টাকা বেতনে সংসার না চললেও পেটের দায়ে অনেকে রয়েছেন এই পেশায়। শুধু তাই নয়, এই পেশায় থাকায় সমাজের অনেকের কাছে তারা অবহেলিত।

সমাজে তাদের অবস্থান নিয়ে সিকান্দার মিয়া বলেন, যদি কোনো পেশায় থেকে কষ্টের বিনিময়ে আয় করা হয় তাহলে ওই পেশাটা নিশ্চই খারাপ হতে পারে না। আমরা সৎ কাজের বিনিময়ে আয় করি। দেশের সরকারি কর্মচারী আমরা। সন্ত্রাসীদের মতো হত্যা তো করি না। অন্য দেশে ফরেনসিক বিভাগে যারা কাজ করে মানুষ তাদের অনেক সম্মান করে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও গুটি কয়েক মানুষ ওই জায়গাটি তৈরি করে দেয়নি।

পরিবারেরর সমর্থনের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ কাজে পরিবারের কোনো বাধা নেই। কারণ এটা আমার চাকরি। এ কাজ করে তো সংসার চলে না, তাই চকুরির পাশাপাশি ব্যবসাও করি। আমার পরিবারে স্ত্রী ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার। কিছু দিন হলো মেয়ের বিয়ে দিলাম। আত্মীয়-স্বজন থেকেও কোনো অনীহা নেই এ পেশার প্রতি।  

মর্গ সহকারীদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী বলেন,  আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট একটি জাতি এ পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সমাজ এখন অনেক আধুনিক ও উন্নত হয়েছে তাই এখন মুসলমান অনেকেও এই পেশায় এসে কাজ করছে। সামাজে তাদের খাটো করে দেখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা ডাক্তাদের সহযোগি হিসেবে এখানে কাজ করে।

তিনি আরও বলেন, ডাক্তাদের নির্দেশনা মেনেই তারা সব কাজ করে। এছাড়া তারা কিছু করতে পারে না। তাদের ও ডাক্তারদের কাজ আরও সহজ করার জন্যে সরকার ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনটি আধুনিক মেশিন স্থাপন করেছে। সরকারিভাবে নিয়োগ হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা এ কাজ করে। ডোম শব্দ বলতে কিছু নেই মানুষের মুখে মুখে এই ডোম শব্দ উঠে আসে।

সরকার তাদের সামাজিক মর্যাদা দেয়ার জন্যে ডোম নাম পরিবরতন করে মর্গ সহকারী নাম দেয় বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০২০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।