ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

কুঠির শিল্পে ভাগ্য বদল

উত্তম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৫ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১৫
কুঠির শিল্পে ভাগ্য বদল ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

যশোর: কাঠের তৈরি মোমদানি, ফুলদানি, মেয়েদের চুরির আলনা, কলস, বাটি, পাউডার কেস, বয়াম, ডিম সেট, আপেল সেট, হারিকেন, পেন্সিল ফুলদানি, চরকা, খুনতি, হামাম, পিঁড়ি, বেলুন, সিগারেটের এশ ট্রে, লেবু চাপা, ব্যাংক (ঘট), সিঁদুরের কৌটা, ধামাপাতি, কয়েলদানি, টিফিন বক্স, ট্রফিসহ বিভিন্ন নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী। দেখলে যেমন মন কাঁড়ে, তেমনি এসব সামগ্রী তৈরির কাজ তথা কুঠির শিল্প বদলে দিয়েছে হাজারো বেকার মানুষের ভাগ্য।



বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত কুঠির শিল্পের মালিক-শ্রমিকরা বছর দশেক আগেও সংসারের খরচ চালাতে অন্যের জমিতে কামলা খেটেছেন। কাজের অভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে কেটেছে অনেকের দিন। কয়েক বছরের ব্যবধানে মেধা, মননশীলতার মাধ্যমে কুঠির শিল্প প্রতিষ্ঠা করে সাবলম্বী হয়েছেন তারা। যশোরের কেশবপুর উপজেলার আলতাপোল, তেইশমাইল, কন্দপপুর ও মঙ্গলকোট গ্রামের বর্তমান চিত্র এটি।

শুরুর দিকে আলতাপোল গ্রামের কয়েকজন বেকার যুবক বিভিন্ন কাঠ খোদাইয়ের যন্ত্রপাতি দিয়ে কুঠির শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে গ্রামের কিছু অংশে বিদ্যুতায়ন হলে মোটর বসিয়ে অনেক বেকার যুবক এ শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে এ শিল্পের বিকাশ দেখে পার্শ্ববর্তী তেইশমাইল, কন্দপপুর ও মঙ্গলকোট গ্রামের অনেক মানুষ এ শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এ তিন গ্রামে অন্তত ৪০০টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার মালিক-শ্রমিক, কাঠ ব্যবসায়ীসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ২০ হাজার লোক জীবিকা নির্বাহ করছেন।

এসব গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের নারী-পুরুষ সবাই ব্যস্ত সময় পার করছেন। গ্রামটির শতকরা ৬০ভাগ বাড়িতেই কুঠির শিল্প কারখানা রয়েছে। এসব  কারখানায় তিন থেকে সাত জন পর্যন্ত শ্রমিক রয়েছে। কারখানায় স্থাপিত মোটরের মাধ্যমে ছোট-ছোট কাঠের টুকরা দিয়ে তৈরি হচ্ছে বাহারি ডিজাইনের মোমদানি, ফুলদানি, কলস, বাটি, পাউডার কেস, বয়াম, ডিম সেট, আপেল সেট, হারিকেন, পেন্সিল ফুলদানি, চরকা, খুনতি, হামাম, পিঁড়ি, মেয়েদের চুরি রাখার আলনাসহ বিভিন্ন সামগ্রী।

এসব সামগ্রী চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া, খুলনাসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। ওইসব এলাকা থেকে পাইকারি ক্রেতারা সরাসরি কারখানায় এসে চাহিদা মোতাবেক মালামাল কিনে নিয়ে যান।

স্থানীয় তেইশ মাইল এলাকার কুঠির শিল্প মালিক কবির হোসেন, শাহদাৎ, নজরুল, কাদের, বাবুল, নজরুল, জামান, রাজ্জাকসহ অনেকেই বাংলানিউজকে জানান, আমাদের কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের সারাদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে, কাঠ ও রংয়ের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং লোডশেডিংয়ের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। এছাড়া, এই শিল্পে ব্যাংক ঋণ না থাকায় অর্থ সঙ্কটে ভুগছেন কিছু কারখানার মালিক।

আগে প্রতি সেপটি কাঠ ৬০/৬৫ টাকায় কেনা হলেও এখন দাম বেড়ে ১৭০ টাকা হয়েছে, এ কাজে ব্যবহৃত রং আগে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো অথচ এখন দাম বেড়ে ২২০০ টাকা হয়েছে। একই সঙ্গে দেড় টাকা দামের প্রতিপিস সিরিশ কাগজ এখন কিনতে হচ্ছে সাত টাকায়।

তারা আরও জানান, কয়েকবছর আগেও প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন খরচ বাদেও প্রায় অর্ধেক টাকা লাভ হত। তবে, বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যার কারণে লাভের পরিমাণ কমে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, মেহগনি, রেইনট্রি, বাবলা বা এ জাতীয় মাঝারি সাইজের গাছের লগ কিনে ‘স’ মিলের মাধ্যমে ছোট ছোট আকারে কাটিয়ে নেওয়া হয়। এরপর বিদ্যুতিক মোটরের মাধ্যমে বিভিন্ন ডিজাইন করে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করা হয়। পরে, এসব সামগ্রী মোটরের মাধ্যমে কাঠের রংয়ের আদলে রং করা হয়।

কুঠির শিল্প তৈরি শ্রমিক পলাশ, আলমগীর, মোস্তফা, সেলিম হোসেন, বিলাল হোসেন, জাহাঙ্গীর হোসেনসহ অনেকেই বাংলানিউজকে জানান, আগে এ অঞ্চলের শ্রমিকরা রোদে পুড়ে সারাদিন কামলা খেটেও সংসার চালাতে হিমশিম খেত, অথচ এখন কারখানায় বসে অল্প পরিশ্রমে কাজ করতে পারছেন। তারা উৎপাদনের ভিত্তিতে পণ্য গুণে মজুরি পান। অনেকে অন্যের কারখানায় কাজ শিখে ৫/৬ হাজার টাকা খরচ করে মোটর কিনে নিজ বাড়িতে কারখানা তৈরি করছে। সবমিলিয়ে ভাল রয়েছেন তারা।

কেশবপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য গৌতম রায় বাংলানিউজকে জানান, বছর দশেক আগেও স্থানীয় দরিদ্র মানুষ কাজের অভাবে না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। কুঠির শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে, গ্রামের কিছু অংশে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ওইসব এলাকার বেকার মানুষ শিল্প স্থাপন করতে পারছে না। এছাড়া, এ শিল্পে সরকারিভাবে ঋণের ব্যবস্থা না থাকায় অর্থ সংকট রয়েছে। যার কারণে শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে না।

ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একাধিকবার যোগাযোগের পর কয়েকজন কর্মকর্তা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তবে, এখনও ঋণের ব্যবস্থা হয়নি। এ শিল্পে ঋণ দেওয়ার পাশাপশি গ্রামের বাকি অংশে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৫     
এমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।