ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

ঘরে চাউল নাই, গাঙ্গে ইলিশ নাই, মোরা খামু কি?

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩, ২০১৫
ঘরে চাউল নাই, গাঙ্গে ইলিশ নাই, মোরা খামু কি? ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পাথরঘাটা (বরগুনা) থেকে ফিরে: ‘ঘরে চাউল নাই, গাঙ্গে ইলিশ নাই, অ্যাহন সাগরে মাছ না পড়লে মোরা খামু কি? গত এক হপ্তা (সপ্তাহ) ধইরা (গাঙ্গে) জাল ফালাইছি। অ্যাহন তাইক (পর্যন্ত) জালে মাছ ধরা পড়ে নাই।

যে টাহা খরচ হরছি হেয় মনে হয় ওঠবে না। প্রত্যেক ফির গাঙ্গে যাইতে দ্যাড়-দুই লাখ টাহা (টাকা) খরচ হয়। কূলে গেলেই টাহার লাইগ্যা মহাজনরা তাগেদা দেয়। ’

এভাবেই বলছিলেন সাগর থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসা মো. বাদল জোমাদ্দার নামে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার এক জেলে। তিনি পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে নোঙর করে রাখা মৎস্য ট্রলার নীল সাগর-২ এ মাছ ধরেন।

সাগরে ইলিশ না পড়ায় এমনই হতাশা বিরাজ করছে বরগুনাসহ উপকূলীয় জেলেদের মাঝে।

ভরা মৌসুমেও মাছের রাজা ইলিশের দেখা নেই। জেলেরা সাগরে গিয়েও ফিরছেন খালি হাতে। ছেলে-মেয়ে ও পরিবার পরিজন নিয়ে সামনের দিনগুলো কীভাবে পার করবেন তা নিয়ে দুঃচিন্তায় আছেন সাগর থেকে খালি হাতে ফেরা একাধিক জেলে।

জালে ইলিশ ধরা পড়ার কোনো খবর না থাকায় অনেকে এরই মধ্যে সাগরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে জেলে পল্লীগুলোতে চলছে হাহাকার।

পাথরঘাটার একাধিক জেলে পল্লী ঘুরে জানা গেছে, ইলিশের মৌসুমেও পাথরঘাটা  সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না। এ বছর জেলেরা ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মাছ শিকার বন্ধ রাখলেও এখনো এর কোনো সুফল পাচ্ছেন না। ফলে সাগরপারের জেলে পল্লীগুলোতে হতাশা নেমে এসেছে।
 
মহাজন, দাদন ব্যবসায়ী ও আড়ৎদারসহ মৎস্যজীবী শ্রমিকরাও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রতিদিন জেলেরা ইলিশের সন্ধানে সাগর-নদী চষে বেড়ালেও খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে তাদের। নোঙর করেই অলস সময় কাটাতে হচ্ছে ওইসব জেলেদের।

প্রতিদিন সাগর চষে বেড়ানো ট্রলারগুলো এসে থামছে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। কিন্তু আশানুরূপ ইলিশ মিলছে না। কেউ কেউ সামান্য কিছু ইলিশ পেলেও তা পর্যাপ্ত নয়।

১১ দিন সাগর চষে বেড়ানোর পর বুধবার (১ জুলাই) ঘাটে এসেছে নীল সাগর-২ নামে ট্রলারটি। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে তিন বার সমুদ্রে গিয়েছে ট্রলারটি। কিন্তু প্রতিবারই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। তার ওপরে এবার সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি। ফলে সাগরেই ফেলে আসতে হয়েছে প্রায় সাত লাখ টাকার জাল। সবমিলিয়ে এ মৌসুমে ট্রলারটি সাগরে পাঠাতে ব্যায় হয়েছে ১২ লাখ টাকা। কিন্তু আয় হয়েছে মাত্র ২০ হাজার টাকা। এভাবে চলতে থাকলে জীবন ও জীবিকা নিয়ে মারাত্মক সংকটে পড়বেন এখানকার জেলেরা।

বরগুনা সদর উপজেলার মাঝের চর গ্রামের জেলে সালাম মাঝাই বাংলানিউজকে বলেন, বৈশাখ মাস থেকেই সাগরে ইলিশ ধরা পড়ার কথা। অথচ আষাঢ় মাস শুরু হলেও এখনো সাগরে আশানুরূপ ইলিশের দেখা মিলছে না। গত বছর এমন দিনে সাগরে ভালো ইলিশ ধরা পড়েছিল বলেও দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, গতবার এ দিনে অন্তত ৫০/৬০ মণ ইলিশ নিয়ে ফিরতো একেকটি ট্রলার। আর এবার বেশিরভাগ ট্রলার ফিরছে শূন্য হাতে। আর যাদের ভাগ্য ভালো, তারা আধা মণ থেকে এক মণ ইলিশ নিয়ে ফিরছেন। এখন যে অবস্থা হয়েছে তাতে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া মহাজনের টাকা কিভাবে শোধ করবেন জানেন না তারা।

এফবি মমতাজ, এফবি তামান্না, এফবি আল্লাহর দান, এফবি রাসেলসহ বিভিন্ন ট্রলার ফিরেছে খালি হাতে। জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমুদ্র উত্তাল থাকায় জেলেরা সমুদ্রে গেলেও জাল ফেলতে পারছেন না। আবার অনেকে সাগরে জাল ফেললে হঠাৎ করেই সমুদ্র উত্তাল হয়ে গেলে জীবন বাঁচাতে সেই জালও ফেলে রেখে চলে আসতে হচ্ছে।

এফবি রাসেলের জেলে মোস্তফা বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছর এমন সময় ৭০/৮০ মণ ইলিশ নিয়ে সাগর থেকে তীরে এসেছি। কিন্তু এ বছর সমুদ্র উত্তাল থাকায় সাগরে জাল ফেলা যাচ্ছে না। ফলে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে আমাদের। অন্যদিকে, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে জাল ফেলেছে তারা কিছু মাছ পেলেও তা খুবই অল্প।

এ রকমই একটি ট্রলার এফবি নুরজাহান। এ বছর তিন বার সমুদ্রে গেছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। আর তিনবারে ফিরেছে মাত্র পাঁচমণ ইলিশ নিয়ে। যা বিক্রি করে আয় হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা।

পাথরঘাটা মৎস্য আড়ৎদার সমিতির সভাপতি নুরুল আমিনসহ একাধিক মৎস্য আড়ৎদার বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি বছর এমন দিনে গড়ে প্রায় এক থেকে দেড়’শ মণ ইলিশ আড়তে আসতো। অথচ এখন ১০ থেকে ১৫ মণ ইলিশ পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে বাইরে থেকে মাছ কিনতে আসা ক্রেতাদের ফিরে যেতে হচ্ছে খালি হাতে।

প্রতি বছর এমন দিনে জেলেরা আড়তে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। অথচ এ বছর আড়ৎ ঘাটগুলো একেবারে নীরব।

তারা বলেন, ট্রলার প্রতি জেলেদের এক থেকে দেড় লাখ টাকা দাদন দেওয়া রয়েছে।

সাগরের মাছ ধরা না পড়লে সেই টাকা ফিরে আসবে না বলেও শঙ্কা প্রকাশ করছেন আড়ৎদাররা।

বিএফডিসি মৎস্য বাজার ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল বাংলানিউজকে বলেন, এমন সময় পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ক্রেতা বিক্রেতায় সরগরম থাকলেও এবারের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে কর্মহীন হয়ে পেড়েছে ঘাটের শ্রমিকরা। সামনের ঈদ উদযাপন নিয়েও আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।

এ ব্যাপারে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বঙ্কিম চন্দ্র বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, ইলিশ মাছ ধরা পড়া বা না পড়া অনেকাংশে বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও কেন মাছ ধরা পড়ছে না তা বোঝা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সময়: ১১২৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৫
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।