ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন

যশোরের যশ, খেজুরের রস

মাহমুদ মেনন ও উত্তম ঘোষ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫
যশোরের যশ, খেজুরের রস ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

যশোর (তেজরোল গ্রাম) থেকে: যশোরের যশ, খেজুরের রস। শীতের ভোরে সূর্য যখন পূব আকাশে সামান্য আভা ছড়াচ্ছে তখন মাইল কয়েক ছুটে গিয়ে অতি গাঁয়ে, যেখানে গ্রামের সব সুধা গন্ধ আর রস বর্তমান সেখানে গাছির হাতে ঢেলে দেওয়া এক গ্লাস খেজুরের রস পান করার পর ঠিক এই কথাটাই মনে বাজবে।



সূর্যের সঙ্গে গাছিদের সম্পর্ক। সূর্য ডোবার আগেই গাছ কেটে হাঁড়ি পেতে দিতে হয়। সারা রাত ফোঁটায় ফোঁটায় রস পড়ে টপ টপ। আর সকালে সূর্য ওঠার আগেই, কিংবা সঙ্গে সঙ্গেই নামিয়ে আনতে হয় হাঁড়ি ভরা রস। মিষ্টি খেজুরের রস সারা দেশেই সুস্বাদু। তবে যশোর শহরের অদূরে এই গ্রামগুলোতে রসের স্বাদই বুঝি আলাদা। আর সে কারণেই মানুষের মুখে মুখে, খেজুরের রস, যশোরের যশ।

গ্রামের নাম তেজরোল। এখানে সামছু গাছির পুরো রস সংগ্রহ প্রক্রিয়া ধরা পড়লো বাংলানিউজের ক্যামেরায়। সামছুরা গৃহস্থ ঘরের। তিন ভাইয়ের মধ্যে গাছ বাটোয়ারা হওয়ার পরেও প্রত্যেকের ভাগে শতাধিক খেজুর গাছ পড়েছে। ভোরে ভার হাতে গাছি যান রস নামাতে। গাছের আকার কোনোটি ৩০-৩৫ ফুটের মতো উঁচু। কোনোটি আবার গাছিরই ঘাড় সমান।

তেমনই একটি পুঁচকে গাছ থেকে হাড়ি ভর্তি রস নামিয়ে বললেন, দেখেন এই পুঁচকের তেজ। এতো মিষ্টরস তার নিজের ৫০ বছরের জীবনে কমই দেখেছেন, আর এক গাছে এতো রস।

এতো রস কিন্তু স্রেফ কাঁচা খেয়ে ফেলার জন্য নয়। তা জ্বাল দিয়ে ঘন করে তৈরি হয় গুড়। ওটা রস সংগ্রহের পরের ধাপ।   

গাছি ঘরের বধূরা ওই রস পরিষ্কার কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে মাটিতে তৈরি বড় চুলায় (তাফালে) বড় টিনের পাত্রে জ্বালিয়ে তবেই এই গুড় তৈরি করেন। খেজুরের গুড়ে নয়া পাটালি। তাতেই রস অর্থনৈতিক উপযোগিতা পায়। কারণ সেই গুড় বাজারে বিক্রি করে আসে অর্থ, গৃহস্থ ঘরকে করে তোলে অর্থনৈতিকভাবে সম্মৃদ্ধ। এই অর্থনীতিতে পুরুষ গাছিদের সঙ্গে সঙ্গে গৃহবধূদেরও থাকে সমান ভূমিকা। রস সংগ্রহের পর তা থেকে গুড় তৈরির সময় ও সতর্কতাসাপেক্ষ কাজগুলো নারীদের করতে হয়। এছাড়াও গাছ কাটতে যাওয়ার আগে হাঁড়িগুলো ধুয়ে রোদে শুকিয়ে গাছে পাতার জন্য প্রস্তুত করতে হয় প্রতিদিনই।

এই তেজরোল গ্রামে এ বাড়ি, ও বাড়ি, প্রায় সব বাড়ির চেহারাই এক। বাড়িতে বাড়িতে গাছি বধূরা রস জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি তৈরিতে মহাব্যস্ত সময় পার করেন এই শীতের মৌসুম জুড়ে। আর তা বিক্রি করতে খুব বেশি দূরে যেতে হয় না তাদের। পাশেই খাজুরা গ্রামের সঙ্গে এসে মিশেছে শহরের পাকা সড়ক। সেখানে এখন বড় খাজুরা বাজার। দেশে পাটালিগুড়ের সবচেয়ে বড় বাজার।

খেজুরের পাটালি গুড়ের জন্য যশোর এক সুপরিচিত জনপদ। তেজরোল ছাড়াও এনায়েতপুর, লেবুতলা, পান্তাপাড়া, যাদবপুর, গোবরা, জহুরপুর, মাঝিয়ালি, মথুরাপুর, তেলকুপ, মির্জাপুর প্রভৃতি গ্রামেও হয় গাছিদের রস সংগ্রহ ও গুড় বানানোর কাজ।

এবছর অগ্রহায়ণের শুরুতেই এ অঞ্চলে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়েছে। তবে তুলনামূলক শীত কম হওয়ার কারণে গাছে রস কম হচ্ছে। পৌষ মাসের শেষ ভাগেও শীত জেঁকে বসেনি। আর সে কারণে রস এখনো কম। গাছের সংখ্যাও কমে আসছে।

তেজরোল গ্রামের নামকরা গাছি বারিক লস্কর (৭৫) জানালেন, বছর ১৫ আগেও তাদের চার পনেরও (এক পন অর্থ ৮০টি) বেশি খেজুর গাছ ছিল। এখন সেই সংখ্যা সব মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র শ’ খানেক।

এক কেজি গুড় তৈরির জন্য দেড় হাঁড়ি রসের প্রয়োজন। খেজুর গাছ কাটা হয় তিনপালা বা সপ্তাহে তিনদিন। কোনো ধরনের চিনি বা অন্য দ্রব্য না মিশিয়ে গুড়-পাটালি তৈরি হলে তা ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে অধিক মুনাফার আশায় প্রায় অর্ধেক পরিমান চিনি মিশিয়ে রস জ্বাল দিয়ে যে গুড় তৈরি হয় তার দর প্রতি কেজি ১২০ টাকা।

চিনি মেশানোর কারণে যশোরের নলেন গুড় পাটালি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বলেও অভিযোগ অনেকের। তবে বারিক লষ্করের মতো গাছিরা এখনো ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এই জেলায় প্রায় ১০ লাখ খেজুর গাছের মধ্যে সাত লাখ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে।

তবে ইটভাটার আগ্রাসনসহ নানা প্রতিকূলতায় খেজুরগাছ বিলুপ্তের উপক্রম হচ্ছে বলেই মত অনেকের।

ঐতিহ্য ধরে রাখতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরে খেজুরগাছ ও তাল গাছ সংরক্ষণে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে খেজুরগাছ লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়াও বেসরকারি উদ্যোগেও খেজুরগাছ লাগানোর কিছু কিছু উদ্যোগ রয়েছে।









বাংলাদেশ সময়: ০৭১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫
এমএমকে

** প্রতীক দেখে সিল দেবে, মিছিল ভোটের ঐতিহ্য
** মানবিক গুণের প্রার্থী হলে বেশি ভোট
** দলীয় প্রতীক এখানে আশীর্বাদ
** ভোট যত বেশি, নির্বাচন তত সফল
** চৌগাছায় চাপা পরিবেশ, মোটরবাইক নিষিদ্ধে খুশি
** ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল’
** চালনায় উচ্ছ্বাস বেশি, ভোটাররাই খোঁজে প্রার্থীদের
** আউশের চিড়া ও তার কারিগরের গল্প
** প্ল্যাটফর্মে বস্তা-বস্তা ডাক, ডিজিটালে চাপ কমছে
** সাড়ে ৩ ঘণ্টা বিলম্বের কথা জানতেও দেড় ঘণ্টা বিলম্ব
** চালনায় ভোটের মাঠে নারী, পুরুষরা ধান কাটছে












বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।