ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

‘পাড়ায় গিয়ে রেংমিটচা ভাষার সব দেখাবো’

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৭
‘পাড়ায় গিয়ে রেংমিটচা ভাষার সব দেখাবো’ হেডম্যান মেন পুং ম্রোর দফতর / ছবি: শুভ্রনীল সাগর

আলীকদম (বান্দরবন) থেকে: সেদ্ধ ডোরা আলু (পাহাড়ি আলু) ভেঙে মুখে দিতে দিতে বললেন, খেয়ে দেখুন, অনেক স্বাদের।

বাংলাটা খুব একটা খারাপ বলেন না মেন পুং ম্রো। গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলেও বাংলা শব্দের মধ্যে ম্রো ভাষার টান চলে আসে।

আসাটাই স্বাভাবিক! তিনি বান্দরবান বোমং সার্কেলের ২৯১ তৈনফা মৌজার হেডম্যান। তার অধীন মৌজাটি আলীকদম সদর সংলগ্ন।
 
মেন পুংয়ের খোঁজ দেন বান্দরবান জেলা পরিষদ সদস্য সিং ইয়ং ম্রো। তার বন্ধুজন। জানান, আটষট্টি বছরের প্রবীণ মেন পুং রেংমিটচা ভাষাটি জানেন। তার কাছে গেছে গেলে বিলুপ্তপ্রায় এ ভাষাটি সম্পর্কে অনেক তথ্য মিলবে।
 
এর আগে, বাংলানিউজে সোমবারের (০৯ জানুয়ারি) এক সংবাদে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী খবর দেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এমন এক মাতৃভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে, যে ভাষায় মাত্র ২৫ জন কথা বলেন। এ ভাষাটির নাম রেংমিটচা। ভাষা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার ওপর বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করতে গিয়ে এ ভাষাটির সন্ধান পায়।
 
রেংমিটচার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে বাংলানিউজও। ভাষাটির সুলুক সন্ধানে ঢাকা-চকোরিয়া হয়ে পাহাড়ি পথের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) সকালে পা পড়ে আলীকদমে। সূয্যিমামা উঠে গেছেন আগেই। হাত-পা ছড়িয়ে শুরু করে দিয়েছেন রোজকার দেন-দরবার।
 হেডম্যান মেন পুং ম্রোর দফতর
রেংমিটচা ভাষা নিয়ে কাজ হবে শুনে আগ্রহ ও আনন্দ দু’টিই জানয়েছিলেন ফোনে। সেটি আরও টের পাওয়া গেলো আলীকদম গিয়ে- পৌঁছানোর নির্ধারিত সময়ের আগেই অপেক্ষা করছেন বাস স্ট্যান্ডের পাশে ম্রো ছাত্রাবাসে।         
 
সাক্ষাৎপর্ব শেষে অতিথি নিয়ে চললেন তার পানবাজার পাড়ার বাড়িতে। সদর থেকে ইজিবাইকে মিনিট পাঁচেকের পথ। বাড়ির দিকে এগুতে এগুতে বললেন, ‘আমিও একজন রেংমিটচা। ’
 
গিয়েই বসে পড়লেন হেডম্যানের দফতরে। বাড়ির বারান্দায় চেয়ার-টেবিল পাতা, পাশে স্টিলের চার ড্রয়ারওয়ালা শেলফ। মাথার ডানদিকে ঝুলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পোস্টার, বামদিকে পার্বত্য ভিক্ষুকল্যাণ সমিতির ভিক্ষুরা। টেবিলের সামনে একদিকে দু’টি চেয়ার, অন্যদিকে কাঠের লম্বা বেঞ্চি। এটিই তার অফিস।
 
লোক এসে বসে ছিলো আগে থেকেই। ঝটপট ড্রয়ার টেনে কাগজপত্র বের করলেন। জুম চাষের নতুন মৌসুম শুরু হবে। সার্কেলের বাসিন্দারা কে কতো শতক জমি পাবেন এরই কাজ চলছে। খানিক বাদে এলেন স্নাতক পাস নাতি বিদ্যুৎ। ছোট চারকোণা কাগজে নাম তোলার কাজগুলো যত্ন নিয়ে করে দিলেন।
 
কাজের ফাঁকে অতিথির দিকে চোখ পড়তেই আশ্বস্ত করলেন, নাতিকে পাঠিয়ে দিয়েছি পাড়ায়। রেংমিটচা ভাষা যারা জানে দুপুরে তাদের এক জায়গায় থাকতে বলে দিয়েছি। আমি নিয়ে যাবো আপনাকে।
 
পাড়া বলতে গহীন পাহাড়ে তাদের স্থায়ী নিবাস। তারা বলেন পাড়া। সদরে টিনের বেড়া দেওয়া দুই রুমের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন হেডম্যানের দায়িত্ব পালনে।
 ম্রো দাদি-নাতনির হস্তশিল্প
মূল দরজায় দাঁড়াতে চোখ যায় উঠানে। তাঁতে গোলাপি সুতা সাজিয়ে দাদি বসেছেন। তার পাশে পরম আগ্রহ নিয়ে বসেছে নাতনি। পূর্ব প্রজন্মের ডান হাতের সুতা টানার কাজটি করে দিচ্ছে নতুন প্রজন্ম। ঐতিহ্যের এ পরম্পরার মাথার উপর ঠিকরে পড়ছে মধ্যাহ্নের আলো।
 
এদিকে, দাপ্তরিক কাজ মিটে গেছে। চেয়ারে পা তুলে আরাম করে বসলেন হেডম্যান মেন পুং। কোত্থেকে যেনো ৫শ মিলি লিটারের একটি প্লাস্টিকের বোতল বের করে টেবিলে রাখলেন। কাছেই ছিলো ছোট্ট চিনেমাটির কাপ, তাতে একটু ‘আরাগ’ ঢাললেন। এটি তাদের ঐতিহ্যবাহী পানীয়। নিজে একটু গলা ভিজিয়ে রীতি অনুযায়ী অতিথিকেও আমন্ত্রণ জানালেন।
 
‘আরাগ’ এসেছে রেংমিটচা ভাষা থেকেই। এরপর এই ভাষায় আলমারি, টেবিল, চেয়ারকে কী বলে সেটি শোনালেন। কিছুই যে বুঝছি না সেটি বুঝতে পেরে হেসে বললেন, পাড়ায় চলেন সব লিখে দেবো আপনাকে। ওখানে লেখা পাবেন, গান পাবেন। পাড়ায় গিয়ে রেংমিটচা ভাষার সব দেখাবো।
 
এরপরও কথা চলতে থাকে রেংমিটচাকে ঘিরেই। এই কথা পাড়ি, সেই কথা তুলি- একটু বলেন, বাকিটা তুলে রাখেন পাড়ার জন্য। যেনো এখানে বললে গোটা বিস্ময়টাই ফিকে হয়ে যাবে!
 মেন পুং ম্রো
বরং মধ্যাহ্নভোজের জন্য অতিথিকে তাড়া দেন। এক ফাঁকে নাতির হাত দিয়ে পলিথিনে করে দোকান থেকে আনা কোনো একটি পদ ঘরে ঢোকে। খেতে বসে বোঝা যায়, সেটি মুরগির মাংস। পায়ের তালু থেকে মগজ তাঁতানো ঝাল দেওয়া ছুরি শুঁটকি, চিংড়ি শুঁটকি দিয়ে বাঁধাকপি ভাজি, ক্ষেতের বেগুন-মুলার তরকারি ও তেঁতুল দিয়ে বোম্বাইট্টা মাছের ঝোলের পাশে জায়গা করে নেয় দু’টি মাংসের পিস। রাজধানীবাসীর জন্য শেষের এই বিশেষ পদ। কিন্তু খেতে বসে পাশার দান ঘুরে মুরগির মাংস হেডম্যানকেই খেতে হলো। অতিথির একচ্ছত্র দখলে থাকলো ঘরোয়া পদগুলো।
 
খাবার শেষে পাহাড়ি পান-সুপারির ডালা নিয়ে বসলেন হেডম্যান। অভ্যাস না থাকলেও এড়ানো গেলো না কাঁচা সুপারি আর জুম ক্ষেতের ছোট্ট বাচ্চার হাতের সাইজের পান!
 
মুখে পান, হাতে খোলা ব্লেড নিয়ে কোনো পানি-ক্রিম-সাবান ছাড়াই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি কামিয়ে চললেন। চোখ অতিথির দিকে, চলছে কথাবার্তাও। অথচ খচ খচ শব্দে দাঁড়ি কাটায় কোনো ব্যাঘাত নেই।
 
‘ভোরে আমরা যাত্রা করবো। অনেক হাঁটতে হবে। বনের অনেক ভেতরে যেতে হবে। পাহাড়ে হাঁটতে পারবেন?’
উত্তরে হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকাই…
 
** রেংমিট্‌চা: বাংলাদেশে যে ভাষায় কথা বলে মাত্র ২৫ জন!

বাংলাদেশ সময়: ২০১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৭
এসএনএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।