ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

চাকাঅলা ব্যাগে থমকে গেছে কুলিদের ভাগ্যের চাকা!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৭
চাকাঅলা ব্যাগে থমকে গেছে কুলিদের ভাগ্যের চাকা! চাকাঅলা ব্যাগে থমকে গেছে কুলিদের ভাগ্যের চাকা!

ঢাকা: একটা সময় স্টেশনে ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যেতো কিছু মানুষের। কে কোন বগিতে কার আগে প্রবেশ করবে চলতো প্রতিযোগিতা। স্টেশনে যাত্রীরা নামবেন আর তাদের সঙ্গে থাকা ব্যাগগুলো সানন্দে মাথায় তুলে নিতো মানুষগুলো। যেন অনেক দিনের চেনা-জানা কোনো অতিথি এসেছে, আর তাকে এগিয়ে নিতে এসেছেন তারা।

যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামিয়ে স্টেশনের বাইরে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতো মানুষগুলো। বিনিময়ে সেই ক্ষনিকের অতিথি খুশি হয়ে যা দিতেন তাই হাত পেতে নিতেন তারা।

মাথা পেতে বোঝা বওয়ার বিনিময়ে হাত পেতে যা বখশিস পেতেন তাতে কোনো প্রকারে চলে যেতো দিন।

কিন্তু সেইসব দিন আর নেই। মানুষগুলোর ভাষায়, চাকাযুক্ত ব্যাগের কারণে তাদের আর সেই রকম কদর নেই। সারাদিন বসে থেকে হাজার মানুষের আসা-যাওয়া দেখেন, কিন্তু ‘অতিথি’ হয়ে আসেন না কেউ।

চিত্রটি রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনের আর দিনবদলের এই গল্পটি ‘কুলি’ হিসেবে পরিচিত কিছু মানুষের। আধুনিকতার চাকার ঘূর্ণনে যাদের থেমে যেতে বসেছে ভাগ্যের চাকা।

প্রায় ১০ বছর ধরে স্টেশনে কুলি হিসেবে কাজ করেন ৫৫ বছর বয়সী মো. দিদার। পরনে লাল রঙের ফতুয়া দেখে সহযেই বোঝা যায় তিনি এখানকার কুলি।

সোমবার (১০ এপ্রিল) বিকেলে কমলাপুর স্টেশনে একটি ট্রেন থামে। ট্রেনটি পুরোপুরি থামার আগেই শুরু হয়ে যায় দিদারের চঞ্চলতা। তার সঙ্গে আরো ৫-৬ জন এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করছেন। কোন বগিতে উঠবেন সেটা ঠিক করছেন। ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে ভিআইপি কেবিন দেখে সেই বগির সামনে দাঁড়ালেন। কিন্তু ফিরলেন আশাহত হয়ে। কেউ তার সাহায্য নিতে রাজি হননি। অথচ যাত্রীদেরকে সাহায্য করতেই অপেক্ষমান ছিলেন দিদার।

বাংলানিউজকে দিদার বলেন, সবার সঙ্গেই চাক্কাওলা ব্যাগ। এহন আর আমাগো কাম লাগে না। যার যার ব্যাগ হেয় লইয়া যায়। যার ব্যাগ, হেয় না দিলে তো আমার কিছু করনের নাই।
চাকাঅলা ব্যাগে থমকে গেছে কুলিদের ভাগ্যের চাকা!
তিনি জানান, আগে এই স্টেশনে কয়েকশ কুলি কাজ করতো। এখন সবমিলে সর্বোচ্চ একশ জন হবে। কারণ, এখন আর আগের মতো কাজ নেই। যারা আছে তাদেরও কাজ হয় না বললেই চলে। কিছু যাত্রীর সাথে বস্তা থাকে, সবার মধ্য থেকে প্রতিযোগিতা করে মাঝে-মধ্যে কিছু বস্তা আনা নেওয়া করলেই কিছু আয় হয় তাদের।

বিকেল ৫টা পর্যন্ত দিদারের ৪০ টাকা আয় হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কাম করতে পারলে খাই, নইলে না খাইয়াই পইড়া থাকি। রাইত হইলে ইস্টিশনেই ঘুমাই। ’

চার সন্তানের জনক দিদার জানান, তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছেলের বয়স ১২। পরিবারে আর কেউ উপার্জনক্ষম নেই বলে তিনি এখানে পড়ে আছেন। আগে স্টেশনের বাইরে চায়ের দোকান ছিল। সেই দোকান উঠিয়ে দেওয়ার পর বাধ্য হয়ে কুলির কাজ শুরু করেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দিদার।

তিনি জানান, আগে এই কুলিদের একটা সমিতি ছিল। সেই সমিতিই তাদের সব কাজ পরিচালনা করতো। এখন নুরু মিয়া নামে একজন সরদার আছেন কেবল। তার নেতৃত্বেই স্টেশনে কাজ করেন তারা।

স্টেশনের প্ল্য্যাটফর্মে বসে বলতে থাকেন দিদার, কী কমু আর, দুঃখে ভরা জীবন বাবা। আগে তো এখানে আমাগো থাকনের একটা মহল্লা আছিল, এহন হেইডাও নাই।

ব্যস্ততম এই স্টেশনে ট্রেনের কু-ঝিক কু-ঝিক শব্দে দিদারের কথার ফাঁকে ফাঁকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দটুকু মূহূর্তেই আড়াল হয়ে যায়। আবার ট্রেন আসে, আশায় বুক বেঁধে আবার দৌঁড়ে যান দিদার----যাত্রীরূপী অতিথির আশায়।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৭
পিএম/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।