ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

বিদেশি বণিকের শক্তি সঞ্চয়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৬ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
বিদেশি বণিকের শক্তি সঞ্চয় ইংরেজদের শুল্ক মুক্ত বাণিজ্য সুবিধা আদায়।

২৩ জুন ১৭৫৭ সাল। কয়েক ঘণ্টার ‘তথাকথিত-যুদ্ধ’ নামের প্রহসনে পাল্টে গেল বাংলার এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্য। যুদ্ধের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ধারার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পলাশীর ২৬০ বছর পূর্তিতে পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজ। পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব

ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, ১৬৫০-এর দশকে বিদেশি ইংরেজ বেনিয়া-বণিকেরা যখন বাংলায় ব্যবসার নামে প্রথম স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, তখনই রচিত হয় পলাশীর পটভূমি। বাংলার মুঘল শাসকরা এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বসবাস ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অনুমতি দেয় বাৎসরিক মাত্র তিন হাজার টাকা প্রদানের মাধ্যমে।

কিন্তু ইংরেজরা কেবল ব্যবসায়েই মগ্ন ছিল না। তারা গ্রহণ করে এমন পদক্ষেপ, যার পেছনে ছিল অন্যান্য উদ্দেশ্য।

বাংলার ক্ষেত্রে শুরুর দিকেই ইংরেজরা হুগলি ও কাসিমবাজারে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার কয়েক বছরের মধ্যেই আকারে এবং মূলধন নিয়োগে কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য, লোকবল ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দ্রুত বাড়াতে থাকে। কলকাতার আশপাশে ইংরেজদের এই বাড়-বাড়ন্ত রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত বাংলার বিখ্যাত সুবেদার শায়েস্তা খানের চোখ এড়ায় নি। বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও নানা বিষয়ে ইংরেজদের অনুপ্রবেশ সুবেদার সহ্য করেন নি। তিনি সামরিক শক্তিতে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। বেশ কিছুদিন এই বিদেশি শক্তি বাংলার মাটি থেকে দূরে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভবন, ১৮২৮

সুবাদার শায়েস্তা খানের পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা আবার বাংলায় আসার সুযোগ পায় ঢাকার সুবেদার ইবরাহিম খানের আমলে। এসেই তারা কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর নামের তিনটি গ্রাম কিনে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করে। এবং অচীরেই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম নামে একটি দুর্গও নির্মাণ করে।

জমিদারি ক্রয় ও ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য খুবই সুবিধাজনক বলে প্রমাণিত হয়। প্রাথমিক শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে ইংরেজদের মধ্যে যে কায়েমি স্বার্থের জন্ম নেয়, তা কোম্পানিকে কলকাতার আশেপাশে আরও ৩৮টি গ্রামের জমিদারি কিনতে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে, ইংরেজদের বাণিজ্যিক ও সামরিক সুবিধার অপব্যবহারের দরুণ বাংলার শাসকদের সঙ্গে তাদের প্রায়ই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। রপ্তানি বাণিজ্যের পাশাপাশি ইংরেজরা দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও অংশ নিতে থাকে এবং সময় সময় সামরিক শক্তি প্রয়োগেও উৎসাহ দেখাতে আরম্ভ করে। সিরাজের পূর্ববর্তী সকল শাসকই ইংরেজদের আচরণে বিরক্ত ও অতিষ্ঠ ছিলেন এবং এই বহিরাগত শক্তিকে যতটুকু সম্ভব দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন।

স্থানীয় শাসকদের বাধা-নিষেধ এবং অনিচ্ছাকে পরোয়া না করে ইংরেজরা বরং নিজের বাণিজ্যিক বলয় ও শক্তিমত্তা বাড়াতেই থাকে। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরও অধিক সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রচেষ্টায় দিল্লির তৎকালীন শাসক ফররুখ সিয়ারের দরবারে ধর্ণা দেয় এবং নানা উপঢৌকন ও লোভ দেখিয়ে সম্রাটের কাছ থেকেও সুবিধা আদায়ে সচেষ্ট হয়। ১৭১৭ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে ফররুখ সিয়ার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা প্রদান করেন। এসব সুবিধার মধ্যে ছিল: শুল্কমুক্ত বাণিজ্য, কলকাতায় টাকশাল স্থাপন এবং কিছু দুর্বল শর্ত সাপেক্ষে জমিদারি ক্রয় করার অধিকার। শায়েস্তা খান

তৎকালে যেহেতু অন্যান্য ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট হারে শুল্ক দিতে হতো এবং ইংরেজ ও তাদের সহযোগীরা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করত, তাই স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য থেকে উৎখাত হওয়ার ভয় দেখা দেয়। ফলে সঙ্গত কারণেই বাংলার তৎকালীন নবাব মুর্শিদকুলি খান দিল্লির ফরমানের বাস্তবায়নে বাধা দেন। তিনি অনুভব করেন যে, কোম্পানি আমদানি-রপ্তানি বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও এ ব্যবস্থায় কোম্পানি নামমাত্র বার্ষিক তিন হাজার টাকা সরকারকে দেবে এবং কোম্পানির এই বিশেষ সুবিধার ফলে সরকার তার আইনানুগ বাণিজ্য শুল্ক ও টাকশালের উপর প্রাপ্য কর থেকে বঞ্চিত হবে। নবাব ইংরেজদের প্রতি বিরূপ থাকেন এবং এই বিদেশি শক্তিকে দমনের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে নবাব আলীবর্দী খানও ইংরেজদের দৌরাত্ম্য থামাতে সামরিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলার (১৭৩৩-১৭৫৭) ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নবাব ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে চলমান বিরোধ আরও অনিবার্য হয়ে পড়ে। নবীন নবাব পূর্বসুরী শাসকদের চেয়ে তীব্রভাবে বাংলায় কোম্পানির অবৈধ ও ক্ষতিকর কার্যক্রমের প্রতিবাদ জানান। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের তিনটি প্রধান অভিযোগ ছিল: ১. অনুমতি না নিয়েই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের প্রাচীর নির্মাণ ও সংস্কার; ২. কোম্পানির অবৈধ ব্যবসা ও কর্মচারিদের নিপীড়নমূলক তৎপরতা; ৩. নবাবের অবৈধ ও রাষ্ট্রদ্রোহী প্রজাদের আশ্রয় প্রদান করা।

উল্লেখিত অভিযোগের মীমাংসার জন্য পদক্ষেপ নিতে নবাব ব্রিটিশদের আহ্বান জানান এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের জন্য কলকাতায় ইংরেজদের কাছে অনেক প্রতিনিধিদল পাঠান। নবাব কোম্পানি নিকট অবাধ্য কৃষ্ণদাসকে তাঁর হাতে সমর্পনের দাবি করেন এবং দুর্গের নতুন প্রাচীর ভেঙে ফেলতে ও কলকাতার চারদিকের পরিখা ভরাট করতে নির্দেশ দেন। নবাবের যে বিশেষ দূত এ সকল দাবি সম্বলিত চিঠি নিয়ে কলকাতায় যান, ইংরেজরা তাকে চরমভাবে অপমানিত করে। কলকাতার ইংরেজ গভর্নর রজার ড্রেক নবাবের দূত নারায়ণ সিংহকে অপমানজনকভাবে তাড়িয়ে দেন।

সব দিক বিবেচনা করে নবাব সিরাজের সামনে ঔদ্ধত্য ও বিদ্রোহী ভাবাপন্ন ইংরেজদের দমন করা ছাড়া বিকল্প কোনও পথই খোলা ছিল না। নবাব তৎক্ষণাৎ ইংরেজদের কাসিমবাজার কুঠি অবরোধের আদেশ দেন। কুঠির প্রধান আত্মসমর্পন করলেও কলকাতার ইংরেজ গভর্নর অবাধ্যতা অব্যাহত রাখে। ফলে নবাব কলকাতা অভিযান চালিয়ে তা দখল করে নেন। ইংরেজ কর্তারা পালিয়ে জাহাজ যোগে দূর সাগরে আশ্রয় নেয় এবং পরে মাদ্রাজের ঘাঁটিতে পালিয়ে যায়।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতে প্রাথমিকভাবে পরাজয়ের পর বাংলায় কোম্পানির পুনঃপ্রতিষ্ঠা দুই উপায়ে করা সম্ভব হতে পারত। হয় নবাবের নিকট আত্মসমর্পন নচেৎ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বল প্রয়োগের মাধ্যমে নবাবকে উৎখাত করা। ইংরেজরা বাংলায় ও ভারতে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য ও অপরাপর স্বার্থের কারণে দ্বিতীয় পন্থাটিকেই বেছে নেয়। বাংলার মতো এতো লাভজনক বাণিজ্য ক্ষেত্র এবং ভবিষ্যত-সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক কেন্দ্র ছেড়ে দিতে ইংরেজরা মোটেও রাজি ছিল না। বরং তা ফিরে পেতেই তারা ছিল মরিয়া। এবং এক্ষেত্রে নবাব সিরাজ ছিলেন তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় ও একমাত্র বাধা। অতএব সিরাজকে নবাবের পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতলবটি প্রকাশ্যে না বললেও ইংরেজদের পরিকল্পনার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ছিল। ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ইংরেজ শক্তি তখন বাংলার দিকে মনোযোগী ও ঐক্যবদ্ধ হয়। ইংরেজরা সিরাজকে নবাবের পদ থেকে সরাতে ও পরাজিত করতে সার্বিক তৎপরতা চালায়। সামরিক দিকে অগ্রসর হওয়ার আগেই ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক যুদ্ধ শুরু করে সিরাজের বিরুদ্ধবাদীদের দলে টানার মাধ্যমে। ফোর্ট উইলিয়াম

কলকাতা জয় করে নবাব সিরাজ রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে গেলে পালিয়ে যাওয়া ইংরেজরা আবার সরব হয়। প্রাথমিকভাবে ইংরেজ কর্তারা কলকাতা পুনরুদ্ধার করে শক্তি সঞ্চয়ের দিকেই মনোযোগী থাকে। অতিদ্রুত তারা নিজেরা সংগঠিত হয়ে মাদ্রাজের ইংরেজ ঘাঁটি ফোর্ট সেন্ট জর্জ থেকে অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর জন্য জরুরি আবেদন পাঠায়। সেখান থেকে রবার্ট ক্লাইভ ও এডমিরাল ওয়াটসনের অধীনে একদল ইংরেজ সৈন্য বাংলায় পাঠানো হয়। তারা ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে অরক্ষিত কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এবং নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টিতে সচেষ্ট হয়। নবাব সিরাজও বসে থাকেন নি। তিনি পুনরায় ইংরেজ দমনে অগ্রসর হন। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে নবাব আলীনগরে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করতে বাধ্য হন।

আপাতত সন্ধির মাধ্যমে বাংলার মাটিতে পুনরায় ঠাঁই পেয়ে ইংরেজরা চরম ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ নেয়। তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় বাংলার রাজনীতিতে তখন পর্দার অন্তরালে গৃহীত হতে থাকে একের পর এক চক্রান্তমূলক সিদ্ধান্ত। পলাশীর মাঠে সামরিক বিজয় অর্জনের পূর্বেই ইংরেজরা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও কৌশলগত জয় ছিনিয়ে নিতে থাকে। সন্ধির মাধ্যমে শান্তি প্রত্যাশী নবাব সিরাজকে চারদিক থেকে ক্রমে ক্রমে ঘিরে ফেলে আগ্রাসী ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা।

পরবর্তী পর্ব
চারিদিকে চক্রান্তের বিস্তার

পূর্ববর্তী পর্ব
ইংরেজ কোম্পানির নিঃশব্দ অনুপ্রবেশ

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।