ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

ইতিহাসের মহানায়ক ম্যান্ডেলা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১০ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৭
ইতিহাসের মহানায়ক ম্যান্ডেলা নেলসন ম্যান্ডেলা। ফাইল ফটো

নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু (৫ ডিসেম্বর ২০১৩ ) ছিল ইতিহাসের অবসান। তাঁর জন্ম (১৮ জুলাই ১৯১৮) ছিল ইতিহাসের সূচনা। জন্মশতবর্ষের পথে তিনি এখনো ইতিহাসেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বিংশ শতাব্দীর সর্বশেষ ও জীবন্ত সংগ্রামী ছিলেন তিনি। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ম্যান্ডেলা মানবমুক্তির প্রেরণা।

৯৫তম জন্মদিন থেকেই ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সেই সংগ্রামও শেষ হয়ে তিনি হয়েছেন সংগ্রামের প্রেরণা। মৃত্যুতেই  হারিয়ে যাবে  না তার সংগ্রামের স্মৃতি। যার পুরোটা জীবনই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগে উজ্জ্বল, সেই জীবনের স্মৃতি পৃথিবী ভুলতে পারবে না সহজে। শেষ জন্মদিন থেকে জীবনের কোনও জন্মদিনই ম্যান্ডেলার জন্য খুব বেশি ‘শুভ’ নয়। তাঁর জীবনের ২৭টি ‘শুভ জন্মদিন’ পালিত হয়েছে কারান্তরালে। আর ৯৫তম জন্মদিন পালিত হয় রোগ শয্যায়। তবু বিটপীর মতো বিশাল এই মানুষটি  ধ্রুবতারার আলোকচ্ছটায় প্রবাহমান মুক্তিকামী বিশ্ববাসীর অমলিন চেতনায়। আগামী বছর তাঁর জন্ম শতবর্ষ। ১৯৩৭ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা

কালো আফ্রিকার মুক্তির লাল সূর্য ম্যান্ডেলা তাঁর গোত্রের দেয়া মাদিবা নামে পরিচিত। পুরো নাম নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা। জন্ম: ১৮ জুলাই ১৯১৮। দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম  প্রেসিডেন্ট (১৯৯৪ হতে ১৯৯৯)। আগে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র সংগঠনের নেতা হিসাবে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬২ সালে তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ম্যান্ডেলা ২৭ বছর কারাবাস করেন। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি কারামুক্ত হন। এর পর তিনি তাঁর দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সাথে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। এর ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে ১৯৯৪ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গত চার দশকে ম্যান্ডেলা ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার  পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার, ১৯৮৮ সালে শাখারভ পুরস্কারের অভিষেক পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন।

ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় কুখ্যাত রবেন দ্বীপের কারাগারে। এখানে তিনি তাঁর ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। জেলে থাকার সময়ে বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি বাড়তে থাকে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। সশ্রম কারাদণ্ডের অংশ হিসাবে রবেন দ্বীপের কারাগারে ম্যান্ডেলা ও তাঁর সহবন্দিরা একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হন। কারাগারের অবস্থা ছিলো অতি শোচনীয়। কারাগারেও বর্ণভেদ প্রথা চালু ছিলো। কৃষ্ণাঙ্গ বন্দিদের সবচেয়ে কম খাবার দেয়া হতো। সাধারণ অপরাধীদের থেকে রাজনৈতিক বন্দিদের আলাদা রাখা হতো। রাজনৈতিক বন্দিরা সাধারণ অপরাধীদের চেয়েও কম সুযোগ সুবিধা পেতো। ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনীতে লিখেছেন,  তাঁকে ডি-গ্রুপের বন্দি হিসাবে গণ্য করা হতো, অর্থাৎ সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন্দিদের তালিকায় তাঁকে রাখা হয়েছিলো। তাঁকে প্রতি ৬ মাসে একটিমাত্র চিঠি দেয়া হতো এবং একজনমাত্র দর্শনার্থীর সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হতো। ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি কারাগারের সেন্সরকর্মীরা অনেকদিন ধরে আটকে রাখতো। চিঠি ম্যান্ডেলার হাতে দেয়ার আগে তার অনেক জায়গাই কালি দিয়ে অপাঠযোগ্য করে দেয়া হতো।

কারাগারে থাকার সময়ে ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় পড়াশোনা শুরু করেন এবং আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালে তাঁকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি প্রিন্সেস অ্যানের কাছে সেই নির্বাচনে হেরে যান। রবেন কারাগার।

দক্ষিণ আফ্রিকার গোয়েন্দা বিভাগের গুপ্তচর গর্ডন উইন্টার ১৯৮১ সালে আত্মজীবনী লিখেন, যার শিরোনাম ছিলো Inside BOSS। এই আত্মজীবনীতে উইন্টার দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের একটি গোপন ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেন। এই ষড়যন্ত্র অনুসারে ১৯৬৯ সালে ম্যান্ডেলাকে কারাগার থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে কারাগারে হামলা চালাবার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। উইন্টারের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার গুপ্তচরেরা এই ষড়যন্ত্রে অংশ  নেয় ও মদত  দেয়। উদ্দেশ্য ছিলো, কারাগার থেকে ম্যান্ডেলাকে পালাতে  দেয়া, যাতে তাঁকে ধাওয়া করে পুনরায় গ্রেপ্তারের নামে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা যায়। এই ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস হওয়ায় তা নস্যাৎ হয়ে যায়।

১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ম্যান্ডেলাকে রবেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোলস্মুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় ম্যান্ডেলার সাথে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের উচ্চপদস্থ নেতা ওয়াল্টার সিসুলু, অ্যান্ড্রু ম্লাগেনি, আহমেদ কাথরাদা এবং রেমন্ড ম্লাবাকেও সেখানে নেয়া হয়। ধারণা করা হয়, রবেন দ্বীপে কারারুদ্ধ নতুন প্রজন্মের কৃষ্ণাঙ্গ রাজনৈতিক বন্দিদের উপর ম্যান্ডেলা ও অন্যান্য নেতার প্রভাব কমানোর জন্যই এটা করা হয়। তরুণ কর্মীদের উপরে ম্যান্ডেলা ও তাঁর সহযোদ্ধাদের এই প্রভাবকে ব্যঙ্গ করে "ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়" বলা হতো। কারাগারের যে কক্ষে ম্যান্ডেলা থাকতেন।

১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন  প্রেসিডেন্ট পি ডব্লিউ বোথা ম্যান্ডেলাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেন। শর্তটি ছিলো, ম্যান্ডেলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করতে হবে। কোয়েটসিসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা অবশ্য বোথার এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তারা মত প্রকাশ করেন যে, ম্যান্ডেলা ব্যক্তিগত কারামুক্তির লোভে পড়ে কখনোই নিজের সংগঠনকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে আনবেন না। ম্যান্ডেলা এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তিনি তাঁর মেয়ে জিন্দজির মাধ্যমে একটি বিবৃতিতে বলেন, “আমাকে মুক্ত করার জন্য দেয়া এ কেমনতরো প্রস্তাব, যেখানে জনগণের সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে রাখা হচ্ছে? কেবল মুক্ত মানুষই আলোচনায় বসতে পারে। বন্দিরা কখনো চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে না। ”

১৯৮৮ সালে ম্যান্ডেলাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে সরিয়ে  নেয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা এখানেই বন্দি ছিলেন। আস্তে আস্তে তাঁর উপরে কড়াকড়ি কমানো হয় এবং দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার অনুমতি  দেয়া হয়। ম্যান্ডেলার কারাবন্দিত্বের সময়ে তাঁর মুক্তির জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের উপরে চাপ বাড়তে থাকে। ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য এই আন্দোলনের বহুল ব্যবহৃত শ্লোগানটি ছিলো, Free Nelson Mandela! ম্যান্ডেলার মুক্তি চাই। ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের পরেই ডি ক্লার্ক ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি  দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। ১৯৯৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে শান্তি আলোচনাকালে ম্যান্ডেলা

ম্যান্ডেলার কারাবন্দিত্বের সময়ে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির দূতেরা বেশ কয়েকবার তাঁর সাথে রবেন দ্বীপ ও পোলস্মুর কারাগারে দেখা করেন। এই সাক্ষাতগুলো সম্পর্কে ম্যান্ডেলা বলেন, “ব্যক্তিগত ভাবে আমার জন্য এবং আমার মতো অন্য রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য রেডক্রস ছিলো কারাগারের অমানুষিক নিষ্ঠুর অন্ধকার জগতে আলোর দিশা। ” একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিশ্বে ম্যান্ডেলা অন্ধকার ভেঙে আলোর দিশা জাগানো মশাল। তাঁর জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।