ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

মহা ধুমধামে হায়দ্রাবাদে গণপতি বাপ্পার বিসর্জন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৭
মহা ধুমধামে হায়দ্রাবাদে গণপতি বাপ্পার বিসর্জন হুসাইন সাগরে সবচেয়ে বড় গণেশের বিসর্জন, ছবি: শুভ্রনীল সাগর

হায়দ্রাবাদ থেকে: ভারতের মহারাষ্ট্র ও সাউথ ইন্ডিয়ান রাজ্যগুলোতে গণপতি বাপ্পার জয়জয়কার। গণপতি বাপ্পা মানে গণেশ। বঙ্গীয় অঞ্চলগুলো তথা বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা, বিহার, ওড়িশ্যা, আসাম, ত্রিপুরা জায়গায় দেবী দূর্গার প্রভাব যেমন বেশি; তেমনি গণেশ এখানে খুব বড় দেবতা হিসেবে মহা ধুমধামে পূজিত হন।

তেলেঙ্গানা একটি সাউথ ইন্ডিয়ান রাজ্য। এসব রাজ্যে দূর্গা পূজা একবারে হয় না যে তা নয়, কিন্তু গণেশের মতো বাড়ি বাড়ি, অলি-গলি, পাড়া-মহল্লায় নয়।

৫৭ ফুট উচ্চতার গণেশ ছবি: শুভ্রনীল সাগরএদিকে গণেশ পুজো মানে বিশাল বিশাল আয়োজন। গণেশ চতুর্থীর দিন থেকে শুরু হয় মহাউৎসব। ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থীকে গণেশ চতুর্থী বলা হয়। সনাতন ধর্মে, এই দিনটি গণেশের জন্মদিন।

পুরাণ অনুযায়ী, একবার শুক্লা চতুর্থীতে প্রতি বাড়িতে মোদক ভক্ষণ করে ভরা পেটে ইঁদুরে চেপে ফিরছিলেন গণেশ। পথে ইঁদুরের সামনে একটি সাপ এসে পড়লে সে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। এতে গণেশ পড়ে যান ও তার পেট ফেটে সব মোদক রাস্তায় পড়ে যায়। গণেশ উঠে সেগুলো কুড়িয়ে পেটের মধ্যে পুরে পেটের ফাটা জায়গাটি ওই সাপ দিয়ে বেঁধে দেন। আকাশ থেকে চন্দ্র তা দেখে হেসে ফেলেন। তাই গণেশ শাপ দেন যে, চতুর্থীর দিন চাঁদ কেউ দেখবে না। ট্রাকে গণেশের লাইন,ছবি: শুভ্রনীল সাগরঅন্যমতে, এই দিনে শিব গণেশকে লুকিয়ে কার্তিককে একটি ফল দিয়েছিলেন। চন্দ্র তা দেখে হেসে ফেলেন বলে শিব চন্দ্রকে অভিশাপ দেন।

যাই হোক, চলতি বছর গণেশ চতু্র্থীর ইংরেজি তারিখ ছিলো ২৫ আগস্ট। সাউথ ইন্ডিয়ার বড় দেবতা হিসেবে তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দ্রাবাদের অলি-গলিতেও শুরু হয়ে যায় উৎসব। শপিং মলগুলোতে ছাড়ের ছড়াছড়ি। গণেশের মূর্তি ও ফুল-মিষ্টির দোকানে লম্বা লাইন। যেখানে পা পড়ছে ঢাকের আওয়াজ আর সেইসঙ্গে ভক্তিময় হাঁক— গণপতি বাপ্পা, মোরিয়া! গণপতি বাপ্পা, মোরিয়া!বিসর্জনের জন্য ক্রেনে গণেশ, ছবি: শুভ্রনীল সাগরহায়দ্রাবাদ আবার সবচেয়ে বড় গণেশ মূর্তি বানানোর জন্য বিখ্যাত। শহরের খয়রাতাবাদের ঐতিহ্যবাহী গণেশ পুজোর তাই খুব সুনাম। এখানকার পুজো কমিটি এবার ৬০তম গণেশ ‍পুজো করতে যাচ্ছে। সেই হিসেবে উচ্চতা ৬০ ফুট করতে চাইলেও রাজ্য কমিটি ৫৭ ফুট পর্যন্ত অনুমতি দেয়। এটি চওড়ায় ছিলো ২৮ ফুট। তাকে দেখতে ছিলো রোজ লাখো মানুষের ভিড়।

গণেশ চতুর্থীর পর দেখতে দেখতে চলে আসে বিসর্জনের দিন। শুক্লা দশমীর দিন থেকে বিসর্জন শুরু হলেও চলে এরপরও চার-পাঁচদিন। সেই হিসেবে এবার বিসর্জনের যবনিকা পড়লো ০৫ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) মধ্যরাতে। ৫৭ ফুট উচ্চতার গণেশও বিসর্জন দেওয়া হয় মঙ্গলবার। বিসর্জনের পরও অর্ধেক ভেসে থাকা বড় এ গণেশকে দেখতেও  লাখো মানুষের ভিড় ছিলো। বিসর্জনের জন্য ক্রেনে গণেশ, ছবি: শুভ্রনীল সাগরছোটখাটো এবং কাছাকাছি মণ্ডপ ও বাড়ির গণেশগুলো বিসর্জন দেওয়া হয় দুরগাম চেরুভু হৃদে। খয়রাতাবাদের গণেশ বিসর্জনসহ সবচেয়ে বড় আয়োজন হয় শহরের হুসাইন সাগরে। বিসর্জন উপলক্ষে রাজ্যের পক্ষ থেকে থাকে বিশেষ নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা।

যে যার মণ্ডপ থেকে ট্রাকে গণেশকে তুলে হাজির হয় হুসাইন সাগরে। এখানে থাকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় অত্যাধুনিক অনেকগুলো ক্রেন। এতে ঝুলিয়ে যথাযোগ্য ভক্তির মাধ্যমে বিসর্জন দেওয়া হয় বুদ্ধি, ঋদ্ধি ও সিদ্ধির দেবতাকে।

শিব ও পার্বতী পুত্র গণেশের নামটি একটি সংস্কৃত শব্দবন্ধ। ‘গণ’ ও ‘ঈশ’ শব্দদু’টির সন্ধির মাধ্যমে এই শব্দটির উৎপত্তি। ‘গণ’ শব্দের অর্থ একটি গোষ্ঠী, সমষ্টি বা বিষয়শ্রেণি এবং ‘ঈশ’ শব্দের অর্থ ঈশ্বর বা প্রভু। গণেশের নামের পরিপ্রেক্ষিতে ‘গণ’ শব্দটির মাধ্যমে বিশেষভাবে একই নামের একপ্রকার উপদেবতার গোষ্ঠীকে বোঝায়। তারা গণেশের পিতা শিবের অনুচরবর্গ যারা কৈলাসে থাকেন। শিব গণদের দলনেতা বানান তারই পুত্র গণেশকে। এখান থেকে তার নাম গণেশ এবং আরেক নাম গণ+পতি অর্থাৎ গণপতি।

তার ধড় হাতির মাথা হওয়ার পেছনেও রয়েছে একটি কাহিনী। শিবপুরাণ অনুসারে, পার্বতী একদিন নন্দীকে দ্বারী নিযুক্ত করে স্নান করতে যান। এমন সময় শিব সেখানে উপস্থিত হলে, তিনি নন্দীকে তিরষ্কার করে পার্বতীর স্নানাগারে প্রবেশ করেন। এতে পার্বতী অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হন। অবশেষে সখী জয়া ও বিজয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি জল থেকে পাঁক তুলে একটি সুন্দর পুত্রের মূর্তি নির্মাণ করেন ও সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে নিজের বিশ্বস্ত অনুচর নিয়োগ করেন।

এরপর একদিন এই কুমারকে দ্বারী নিয়োগ করে পার্বতী স্নানে গমন করলে শিব আবারও উপস্থিত হন। কুমার শিবকে যেতে বাধা দেন। এতে শিবের অনুচর গণদের সঙ্গে তার বিবাদ ও পরে পার্বতীর ইঙ্গিতে যুদ্ধ হয়। গণেশ বিসর্জন, ছবি: শুভ্রনীল সাগরগণ, শিব ও সব দেবতা এই যুদ্ধে পরাজিত হন। তখন নারদের পরামর্শে বিষ্ণু কুমারকে মোহাচ্ছন্ন করেন ও শিব শূল দিয়ে তার মস্তক ছিন্ন করেন। এই সংবাদ শুনে পার্বতী ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বসৃষ্টি বিনষ্ট করতে উদ্যোগী হন। নারদ ও দেবতারা তাকে শান্ত করেন। পার্বতী তার পুত্রের পুনর্জীবন দাবি করেন ও ইচ্ছা প্রকাশ করেন যেনো এই পুত্র সবার পূজ্য হয়। কিন্তু কুমারের মুণ্ডুটি তখন আর পাওয়া যায় না। শিব তখন গণদের উত্তরমুখে পাঠান এবং যাকে প্রথমে দেখা যাবে তারই মস্তক নিয়ে আসতে বলেন। তারা একটি একদন্ত হস্তিমুণ্ডু নিয়ে উপস্থিত হন ও দেবতারা এই হস্তিমুণ্ডের সাহায্যেই তাকে জীবিত করেন। শিব তাকে নিজপুত্র রূপে স্বীকার করেন। দেবতাদের আশীর্বাদে এই কুমার সবার পূজ্য হয়ে গণেশ নামে আখ্যাত হন। এজন্যই গণেশ পুজা এতোদিন ধরে হয়ে থাকে। পানিতে ডুবে যাচ্ছে গণেশ, ছবি: শুভ্রনীল সাগরফিরে আসা যাক বিসর্জনে। এ উপলক্ষে প্রতি বছরই বড়সড়ো মেলা বসে হুসাইন সাগরের পাড়ে। এবারও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। রাস্তার একপাশজুড়ে মণ্ডা-মিঠাই, চাট, ফুচকা, আইসক্রিম, ভুট্টা ইত্যাদি হরেক রকম খাবার। বাচ্চাদের খেলনার দোকানও কম ছিলো না। অন্যাপাশজুড়ে হাজারো মানুষের ভিড়। বিসর্জন দেওয়া গণেশকেও যেনো দেখা শেষ হয় না!

রাত বাড়ে, কিন্তু বিসর্জনের জন্য গণেশ বহনকারী ট্রাক আর মানুষের আনন্দ-উল্লাসে ভাটা পড়লো না।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।