ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

'কোহিনূরের ১ম মালিক' কাকাতিয়া সাম্রাজ্যে হাঁটাহাঁটি

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৭
'কোহিনূরের ১ম মালিক' কাকাতিয়া সাম্রাজ্যে হাঁটাহাঁটি কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের অংশবিশেষ

ওয়ারাঙ্গাল (তেলেঙ্গানা) থেকে: কোহিনূর হীরা সম্পর্কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার আছে কি? ১০৬ ক্যারেটের এই শ্বেত হীরাটির কথা শোনেনি এমন বাচ্চা-বুড়ো খুঁজে পাওয়া মুশকিল! কেবল এই রত্নটির কারণেই অতীতে ঘটে গেছে কতো রাজায়-রাজায় যুদ্ধ, রাজ্য দখল বা ধ্বংস। এর উজ্জ্বলতায় কতো রাজবংশের প্রতাপ-প্রতিপত্তি ফিকে হয়ে গেছে!

শিরোনামের কাকাতিয়া সাম্রাজ্যটির ভাগ্যেও ছিলো এমনটি। আজ থেকে ১১শ বছর আগের কথা।

দক্ষিণ ভারতের একটি অংশের রাজা ছিলেন কিংবদন্তি শাসক দূর্জয়। ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন, তারই উত্তরপুরুষদের একটি ধারা থেকে এসেছেন কাকাতীয়রা। চালুক্য রাজবংশের সঙ্গেও কাকাতিয়াদের যোগ রয়েছে বলে অনেকের মত।
 
ইতিহাসের পাতায় প্রতাপ রুদ্র (১ম) থেকে পরবর্তী শাসকদদের কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রতাপ রুদ্র (১ম) ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্বায়ত্তশাসিত কাকাতিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও, ১০৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাদের যাত্রা। কিন্তু আগেকার শাসকদের সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য মেলে না।
 
প্রতাপ রুদ্র (১ম) কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন 'ওরুঙ্গাল'-এ। ওরুঙ্গাল থেকেই এসেছে ওয়ারাঙ্গাল। বর্তমানে এটি ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের অন্যতম একটি জেলা। হায়দ্রাবাদ থেকে ১৩৭ কিমি, তিন ঘণ্টার ট্রেন পথ। বাসেও যাওয়া-আসা যায়।  
কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের অংশবিশেষ
ওয়ারাঙ্গাল জেলাটি ভারতের অন্যতম ঘোষিত হেরিটেজ শহর। এর কারণ অবশ্যই কাকাতিয়া সাম্রাজ্য। সেসময়কার বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনও রয়ে গেছে। সাম্রাজ্য ও সেসব নিদর্শনের গল্প অন্য পর্বে অবশ্যই হবে, এখন ফিরে আসি শিরোনাম তথা কোহিনূর হীরার সংগে এ রাজবংশের সংযোগে।
 
ইতিহাসের পাতা উল্টে জানা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টার জেলার কল্লুর খনিতে পাওয়া যায় কোহিনূর হীরা।  
 
একটি সূত্র বলছে, এই হীরা প্রথম অধিকারে আসে দক্ষিণের মালওয়া রাজবংশের কাছে। খনি থেকে উত্তোলনের পরই তা মালওয়া রাজবংশের কাছে হস্তান্তরিত হয়। কিন্তু খুব বেশিদিন সেটি তারা নিজেদের অধিকারে রাখতে পারেননি। পার্শ্ববতী কাকাতিয়া রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে মালওয়া রাজা পরাজিত ও নিহত হন। আর তখন এই হীরা চলে আসে কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের অধীনে।
 
রত্নটি কাকাতিয়া রাজাদের অধিকারে এলেও তার স্থায়িত্ব ছিলো খুবই অল্পদিনের। রাজধানী ওয়ারাঙ্গালের একটি মন্দিরে দেবীর চোখ হিসাবে হীরাটি বসিয়ে কাকাতিয়া রাজারা ভেবেছিলেন, এই হীরার কেউ সন্ধান পাবে না। কিন্তু ততোদিনে এই হীরার সৌন্দর্যের খবর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন দিল্লিতে খিলজি রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটেছে। তুর্কি শাসক গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহের রাজত্ব শুরু হয়। তিনি এই হীরার কথা জানতে পেরে তা নিজের অধিকার নেওয়ার জন্য সচেষ্ট হন। ১৩২৩ সালে তিনি কাকাতিয়া রাজা প্রতাপ রুদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং প্রতাপ রুদ্রকে পরাজিত করার জন্য তার বিশ্বস্ত ও চৌকস সেনাপতি উলুগ খানকে পাঠান। উলুগ খানের প্রাথমিক আক্রমণ প্রতিহত করা গেলেও কিছুদিন পর কাকাতিয়া রাজ্যের অপ্রস্তুত সৈন্যবাহিনী তার কাছে পরাজিত হয়। রাজা প্রতাপ রুদ্র এই অতর্কিত যুদ্ধে প্রাণ হারান। কাকাতিয়া রাজ্যের রাজধানী ওয়ারাঙ্গালে এক মাস পর্যন্ত লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা চলতে থাকে। কতো শত হীরা, মাণিক্য, রৌপ্য, গহনা লুণ্ঠন করে পাঠানো হয় দিল্লিতে। এর মধ্যে ছিলো কোহিনূরও।
কোহিনূর হীরা
কোহিনূর নিয়ে রচিত উপন্যাস ‘মিনিমালিস্ট’র রচয়িতা মাশুদুল হক একটি প্রতিবেদনে লেখেন, “কোহিনূরের উৎস নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হলো, তেরো শতকে অন্ধ্রপ্রদেশের কল্লুর খনি থেকে উত্তোলিত হয়েছিল এটি। সে হিসেবে এর প্রথম মালিক ছিল দক্ষিণ ভারতের কাকাতিয়া সাম্রাজ্য। কিন্তু এটা আবার মানতে রাজি নয় কিংবদন্তিপ্রিয় অনেকেই”।
 
তার প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, “অন্ধ্রপ্রদেশের কল্লুর খনিই কোহিনূরের উত্পত্তিস্থল ধরে নিলে মোগলদের আয়ত্তে এ হিরে আসে তারও প্রায় তিন শ-সাড়ে তিন শ বছর পর। চৌদ্দ শতকে আলাউদ্দিন খলজি যখন মালওয়া ও দাক্ষিণাত্য অভিযান করেন, সে সময় হিন্দু শাসক রায় মাহলাক দেও থেকে এ অতুলনীয় রত্ন মুক্তিপণ হিসেবে পান। তখনই তাঁরা জানতেন, এ হিরের মতো তুলনীয় দ্বিতীয় কোনো রত্ন ধরাধামে নেই। খলজি সেটি পরে টোমার রাজবংশকে দান করে যান কোনো এক সাহায্যের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ। তারপর সেটি এই বংশের সম্পদভাণ্ডারে রয়ে যায় বহুকাল। মোগলরা যখন পানিপথের যুদ্ধের পর আগ্রার দুর্গ ঘিরে ফেলে, তখন গোয়ালিয়রের মহারাজার স্ত্রী, সন্তানরা ও ভৃত্যরা পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। তাঁদের ভাগ্যে কী হবে সে সিদ্ধান্তের জন্য শাহজাদা হুমায়ুনের মত চাওয়া হয়। উদার শাহজাদা তেমন কোনো চিন্তাভাবনা না করেই তাঁদের মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন। বাবর তাঁর আত্মস্মৃতিতে পুত্রের এ ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, বন্দীরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে তরুণ শাহজাদাকে অনেক রত্ন উপহার দিয়ে যায়। যার মধ্যে ছিল আলাউদ্দিন খলজির সেই বিখ্যাত হীরাও”।
 
যেকোনো জনপ্রিয়, আলোচিত বা বিতর্কিত বিষয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকবিশ্বাস বা মত বেশ গুরুত্ব বহন করে। গবেষকরা বিশেষ পাত্তা না দিলেও, সাংবাদিকের এড়িয়ে যাওয়া চলে না! 
 
বছর সত্তরের এক ওয়ারাঙ্গালবাসী বুররা কেদারী। দাদা-পরদাদা থেকে ওয়ারাঙ্গাল ফোর্টের খুব কাছেই তাদের বাস। হিন্দিতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোহিনূরের প্রথম মালিক ছিলো কাকাতিয়া রাজারা— এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন কিনা! 
 
তেলেগু ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন না বুররা। আমিও জানি না তেলেগু। ইংরেজি ও তেলেগু জানা এক বন্ধুর কল্যাণে তার উত্তর যা উদ্ধার করা গেলো, তিনি এ বিষয়ে তেমনকিছু জানেন না।
 
প্রদ্যুম্না নামে স্থানীয় এক বর্ষীয়ান আলোকচিত্রী অবশ্য বললেন, কাকাতিয়া রাজারাই হীরার প্রথম মালিক ছিলো বলে আমি জানি। ঐতিহাসিকভাবে কতোটা সত্য জানি না, আমাদের জেলার রাজা বলে আমাদের এটাই বিশ্বাস করতে ভালো লাগে!
 
বাংলাদেশ সময়: ০৬০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।