ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

কালের সাক্ষী নরসুন্দর নারায়ণ ঠাকুর!

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৭
কালের সাক্ষী নরসুন্দর নারায়ণ ঠাকুর! কালের সাক্ষী নরসুন্দর নারায়ণ ঠাকুর!- ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: ‘স্বাধীনতার আগে যাদের জন্ম, নাপিতপট্টির কথা তাদের ভোলার কথা নয়। ওই সময় দুই আনায় চুল কাটতাম। সারি বেঁধে ১৪ জন নাপিত বসতাম। একজন একজন করে সবাই মরে গেছে। কেবল আমি একাই বেঁচে আছি।

এখন সেই নাপিতপট্টি আর নেই, হয়ে গেছে কুকারিজপট্টি! কিন্তু কোনো উপায় না থাকায় সাতপুরুষের এই পেশা ছাড়তে পারিনি। আমি মরে গেলে শেষ চিহ্নটুকুও ধুয়েমুছে যাবে!’।

রাজশাহী মহানগরের আরডিএ মার্কেটের পাশের কুকারিজপট্টির গলির দিকে ডান হাতের তর্জনি উঁচিয়ে ফেলে আসা দূর অতীতের স্মৃতিচারণ করছিলেন বর্ষীয়ান নরসুন্দর নারায়ণ ঠাকুর।  

‘সময় বদলেছে, কালের বিবর্তনে মানুষও বদলেছে। কিন্তু চুল কাটার স্থানটুকু বদলাইনি। বদলাইনি কাজের ধরনও। ’ –বলছিলেন কালের সাক্ষী নারায়ণ।
কালের সাক্ষী নরসুন্দর নারায়ণ ঠাকুর!- ছবি: বাংলানিউজ
নতুন যুগের ছেলেরা তাকে হয়তো চেনে না। তবে শহর ছাড়িয়ে দূর-দূরান্ত থেকে এখনও অনেক প্রবীণ এসে তার কাঁচির নীচে নিশ্চিন্তে মাথা এলিয়ে দেন। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে জানাচ্ছিলেন ষাট পেরুনো স্মৃতিকাতর নারায়ণ।   

তার পেশাগত দক্ষতা ও চারুতার পরিচয় পাশে বসে টের পাওয়া গেল। ঝড়ের গতিতে কাঁচি চালিয়ে নিখুঁতভাবে খচ খচ করে অবলীলায় চুল ছেঁটে চলেছেন তিনি। এক হাতে চিরুনি আর অন্য হাতে কাঁচি। আশপাশের কোনোকিছুর দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। আপন মনে গুন গুন করে গান গাইছেন আর চুল ছেঁটে চলেছেন। প্রথমে মাথার চুল ছাঁটছেন। এরপর শেভ বা ক্ষৌরকর্ম। এরপর হাত-পায়ের নখ কাটার কাজ। পার্লারে গিয়ে নখ কাটার কথা ঠিকই আছে। কিন্তু সেলুনে গিয়ে নাপিতের কাছে? না, তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পাড়া-মহল্লার সেলুন গিয়ে দীর্ঘ সময় লম্বা লাইন ধরে চুল কাটানোই যেখানে দায়। সেখানে চুল-দাড়ি কাটানোর পর হাত-পায়ের নখ কাটানো দুরূহ ব্যাপার তো বটেই।  

তবে কাজটি খুবই স্বাভাবিক অধুনালুপ্ত নাপিতপট্টির নারায়ণ ঠাকুরের কাছে। নারায়ণ ঠাকুর সবকিছুতেই পটু। তাই সব সেবাই তার কাছে মেলে। তাকে বলা যায় হরফুন মাওলা বা সকল কাজের কাজি। নরসুন্দর নামের সার্থকতার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি যেন তিনি! 
কালের সাক্ষী নরসুন্দর নারায়ণ ঠাকুর!- ছবি: বাংলানিউজ
শেভ করতে করতে নারায়ণ ঠাকুর বলেন এখানেই তার বিশেষত্ব। মাত্র দু্’ আনা দিয়ে চুল ছাঁটার কাজে হাতেখড়ি তার। তারও অনেক পরে চুল-দাড়ি ছাঁটার মজুরি বেড়ে ওঠে ছয় আনায়। চুল চার আনা, আর শেভ বা গোঁফদাড়ি কামানোর জন্য দু’ আনা। এখন চুল-দাঁড়ি ছাঁটা আর হাত-পায়ের নখ কাটার ফুল প্যাকেজের মজুরি নেন মাত্র ৩০ টাকা।  

এখন রাজশাহী মহানগরে সেলুনে চুল ছাঁটতেই সাধারণত ৫০ থেকে ৭০ টাকা লাগে। আর তাপানুকূল সেলুনে নেয় ১শ’ টাকা। অথচ নারায়ণ ঠাকুর নেন মাত্র ৩০ টাকা। কেবল মাটিতে পাতা কাঠের টুলে বসতে হবে। হয়তো গায়ে জড়ানোর জন্য শুভ্র সফেদ কাপড় মিলবে না তার কাছে! পাওয়া যাবে না সুমসৃণ তোয়ালেও।

তবে চুল ছাঁটার পর যে কেউ তারিফ করবেন তার পাকা হাতের। অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, কাজের প্রতি অখণ্ড মনোযোগ আর নিষ্ঠাই তার পুঁজি। আর কাঁচি, ক্ষুর, ব্লেড, চিরুনি, ব্রাশ, মলিন চাদর, শেভিং ক্রিমই তার জীবনের নিত্যসঙ্গী। কেউ মনে রাখুক আর বা রাখুক, সাহেব বাজারের এই সরু গলিতেই জীবনের বাকি সময়টা চুলে কাঁচি চালিয়ে পার করে দিতে চান তিনি।

তার কাছে চুল ছাঁটতে আসা পবার পিল্লাপাড়া গ্রামের হামিদ শেখ বললেন, পাকিস্তান আমল থেকেই দাদার কাছে চুল আর দাড়ি-গোঁফ ছাঁটাই করাই।  

অন্য কোথাও বা অন্য সেলুনে কখনও বসেছেন বলে তার মনঁই পড়ে না। খোলা আকাশের নিচে টুলের ওপর বসে চুল ছাঁটা যেন তার প্রিয় অভ্যাস হয়ে গেছে। ছেলেরা বারণ করলেও কোনো কাজে পবা থেকে শহরে এলেই চুল আর গোঁফ ছাঁটিয়ে নেন ‘দাদা নারায়ণ ঠাকুরের কাছে’।

সস্তায় চুল ছাঁটাটা বড় বিষয় নয়, সম্পর্ক আর এতো-এতো বছরের অটল আস্থা-ভালোবাসাই তাকে পুরনো নাপিতপট্টির এই গলিতে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে আসে। কে কী ভাববে এটা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। এভাবেই নিজের আবেগ ঢাললেন প্রবীণ হামিদ শেখ।  

এ সময় নরসুন্দর নারায়ণ ঠাকুর মুখ টিপে হেসে বলেন, ‘বাপু হে, পুরানা চাল ভাতে বাড়ে। আমি অতো  ‘ফ্যাশন কাট’ চুল কাটতে না পারলেও এ যুগের নাপিতরা আমার কাছে ভিড়তে পারবে না।  

এক সময় পাড়ায় পাড়ায় বাড়ি-বাড়ি গিয়েও সবার চুল ছেঁটে দিয়েছি। আমার হাতে চুল ছাঁটাই করা  অনেকে এখন বড় বড় চাকরি করে। সবাই এখানে আর চুল না ছাঁটলেও কালেভদ্রে কেউ কেউ কুশল-কথা বলতে, জানতে এখনো ঠিকই ছুটে আসে প্রাণের টানে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৭
এসএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।