ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

৯শ বছর ধরে হায়দ্রাবাদের প্রতাপ বয়ে চলেছে যে দুর্গ

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৭
৯শ বছর ধরে হায়দ্রাবাদের প্রতাপ বয়ে চলেছে যে দুর্গ গোলকন্ডা দুর্গ। বাংলানিউজ

গোলকন্ডা (হায়দ্রাবাদ) থেকে: চারদিক ঘিরে ফেলেছে মুঘল বাহিনী। নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং যুবরাজ শাহজাহান। দিল্লি সালতানাতের সিংহাসনে তখন সম্রাট আওরঙ্গজেব। অবস্থা বেগতিক দেখে সপ্তম কুতুব শাহী সুলতান আবদুল্লাহ কুতুব শাহ আশ্রয় নিলেন গোলকন্ডা দুর্গে।

হঠাৎ এই আক্রমণে আবদুল্লাহও খানিকটা বিস্মিত। এমন কী করে বসলেন যে, আওরঙ্গজেব গোলকন্ডা (বর্তমান) হায়দ্রাবাদ দখলে ফৌজ পাঠালেন।

এদিকে রাজ্য দখল নিয়েছে মুঘল সৈন্যরা। দুর্গে বসেই আবদুল্লাহ ভীষণ চেষ্টা করে চলেছেন ‘সম্মান ও সুবিধাজনক’ কোনো চুক্তিতে এসে আত্মসমর্পণ করার। কিন্তু মুঘল বাহিনীর নড়চড় নেই। কথা একটাই, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।
 
শেষে বৈবাহিক পথে একটা রফা হলো। আবদুল্লাহ মেজমেয়ে পাদশাহ বিবি সাহিবাকে বিয়ে দিলেন আওরঙ্গজেবের বড়ছেলে মুহাম্মাদ সুলতান মির্জার সঙ্গে। পাদশাহ ছিলেন মির্জার প্রথম স্ত্রী। রূপে-গুণে বড়ই সুন্দরী ছিলেন তিনি। ফতেহ দারওয়াজা।  ছবি: বাংলানিউজ
যাইহোক, সাম্রাজ্যের অন্য সুলতানরা দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করলেও আবদুল্লাহর ভাগ্য ততোটা সুপ্রসন্ন ছিলো না। তার একমাত্র সাফল্য ছিলো ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগর সাম্রাজ্য হাটিয়ে বর্তমান তামিলনাড়ুর ভেলোর দখল করা। এটা বাদ দিলে তার শাসনামল ছিলো নানা বাধা-বিপত্তিতে ভরা। প্রতিবারই তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গোলকন্ডা দুর্গ। এটি অবশ্য তার পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  
 
গোলকন্ডা দুর্গের সঙ্গে সঙ্গে কুতুব শাহী সাম্রাজ্যের নাম এলেও এর দখল তাদের হাতে আসে পূর্ববর্তী তিন সাম্রাজ্য ঘুরে। নিচ থেকে বারাদরি ও ইব্রাহীম মসজিদ।  ছবি: বাংলানিউজ
 
মানকাল নামেই একসময় পরিচিত ছিলো গোলকন্ডা। দক্ষিণ ভারতের আরেক প্রতাপশালী কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল এই দুর্গ। তাদের সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের নিরাপত্তার অংশ হিসেবে কান্দাপল্লী দুর্গের সঙ্গে এটি নির্মিত হয়। দুর্গটি গড়ে তোলা হয় ছোট একটি গ্রানাইট পাহাড়ের উপর। উচ্চতায় এটি ৪৮০ ফুট। শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে দুর্গের চারধারে বানানো হয় গভীর পরিখা। কাকাতিয়া রানি রুদ্রমা দেবী ও পরবর্তীতে তার নাতি প্রতাপরুদ্র দুর্গটি পুনর্নির্মাণ এবং এর ভিত আরও শক্ত করে গড়ে তোলেন।
 
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহ ১৩২৩ সালে ওয়ারাঙ্গালে কাকাতিয়া সাম্রাজ্য হটিয়ে নিজের দখলে নেন। তৎকালীন কাকাতীয়দের বিখ্যাত ওয়ারাঙ্গাল দুর্গসহ এ দুর্গটিও তুঘলকীদের দখলে আসে। এরপর মুসুনুরি নায়েক নামে দক্ষিণাত্যের এক বীর যোদ্ধা তুঘলকী সেনাবাহিনীদের পরাজিত করে দুর্গের দখল নেন। ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে একটি চুক্তির অংশ হিসেবে মুসুনুরি দুর্গটি বাহমানী সুলতানকে হস্তান্তর করেন। সেসময় বাহমানী সুলতানের অধীনে গোলকন্ডা দুর্গ এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ধীরে ধীরে সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। গ্রানাইটের সিঁড়িগ্রানাইটের সিঁড়ি।  ছবি: বাংলানিউজ
 ঠিক এ সময় বর্তমান হায়দ্রাবাদের গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয় সুলতান কুলি কুতুব-উল-মুলককে (১৪৮৭-১৫৪৩)। ১৫০১ সালের দিকে তিনি গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। বাহমানী সুলতানের সামাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকলে সুলতান কুলি ১৫৩৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তার অধীনস্ত রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
 
গোলকন্ডা দুর্গকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয় কুতুব শাহী রাজবংশের সাম্রাজ্য। এর পরবর্তী ৬২ বছরে কুতুব শাহী রাজবংশের প্রথম তিন সুলতান- সুলতান কুলি, জামশেদ কুলি কুতুব শাহ ও সুবহান কুলি কুতুব শাহ দুর্গটি সম্প্রসারিত করেন। বর্তমানে দূর্গটির যে গঠনশৈলী তা এই তিন সুলতানের অবদান। তবে দুর্গটি নির্মাণে হিন্দু ও মুসলিম দুই শাসকের ভূমিকা থাকায়, দুর্গের স্থাপত্যশৈলীতে প্রবলভাবে এর প্রভাব দেখা যায়। তারামতি মসজিদ।  ছবি: বাংলানিউজ
 
বর্তমানে যেটুকু দেখা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে ধরলে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কুতুব শাহীদের হাতে শেষ হয় দুর্গের কাজ। এর আগে কাকাতিয়া সাম্রাজ্য থেকে ধরে দুর্গের বয়স হিসাব করলে, ৯শ বছর এমনিতেই হয়ে যায়। কারণ, কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের ব্যপ্তি ১০৮৭ থেকে ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দ।
 
হায়দ্রাবাদ শহর থেকে প্রায় ১২ কিমি পশ্চিমে দুর্গটির ভৌগলিক অবস্থান। যেকোনো প্রান্ত থেকে ক্যাব-অটোতে যাওয়া যায় সেখানে। জনপ্রতি ১৫ রুপিতে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা অব্দি ঘোরা যাবে দুর্গ। ক্যামেরার জন্য গুনতে অতিরিক্ত ২৫ রুপি।
 
মূল গোলকন্ডা মূলত চারটি আলাদা আলাদা অংশে বিভক্ত। সমতল ভূমিতে না হয়ে ৪৮০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি পাহাড়ে হওয়ায় এই বিভক্তিগুলো দারুণভাবে চোখে পড়ে এবং যারপরনাই সৌন্দর্যও বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। প্রায় সাত কিলোমিটার আয়তনবেষ্টিত বাইরের দেয়ালে রয়েছে ৮৭টি বুরুজ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে এখনও সেসময়কার কামান রাখা আছে। এছাড়া ৮টি প্রবেশদ্বার ও চারটি পরিখা সেতু দুর্গকে দিয়েছে অন্য মাত্রা। আসলাহ খানা।  ছবি: বাংলানিউজ
 
ভেতরে রয়েছে অসংখ্য রাজকীয় কক্ষ, দরবার, নাচ-গানের কক্ষ, মসজিদ, মন্দির, বাগান, জেলখানা ইত্যাদি। এগুলোর নাগিনা বাগ, মুর্দা গেট, আক্কানা মাদান্না, আসলাহ খানা, রঙ্গীন মহল, নাক্কার খানা, তারামতি মসজিদ, ভাগমতি প্যালেস, দাদ মহল, রানি মহল, খিলওয়াত, রামদাস প্রিজন, জেনানা হল, জেনানা মসজিদ, অম্বর খানা, ইব্রাহীম মসজিদ, মন্দির, বারাদরি (দরবার হল), রোটি খানা প্রভৃতি নাম।
 
একদম নিচে মূল দুর্গে ঢোকার সদর দরজার নাম হলো ‘ফতেহ দারওজা’। সুদৃশ্য কারুকার্য মণ্ডিত দরজাটিতে লাগানো রয়েছে লোহার ফলা, যেনো হাতি দিয়েও গুড়িয়ে দেওয়া না যায়। কথিত রয়েছে, আওরঙ্গজেবের বাহিনী অনেক চেষ্টা-তদবির করেও ঢুকতে না পেরে এখান থেকেই ফিরে যান এবং দুর্গের চারধারে অবস্থান নেয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত দূর্গের সীমানা।  ছবি: বাংলানিউজ
এরকম আরও নানা গল্প, রহস্য ও ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে দুর্গজুড়ে, সেসব অন্য পর্বে নিশ্চয়ই হবে। শুধু নির্মাণশৈলীর দিক দিয়েই নয়, হায়দ্রাবাদের গোলকন্ডা দুর্গ ও এর প্রভাব-প্রতিপত্তি তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের রাজনীতেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কাকাতিয়া, মুসুনুরি নায়েক, বাহামানী সুলতান ঘুরে কুতুব শাহী। এরপর মুঘল, নিজাম, ব্রিটিশদের হাত ঘুরে দুর্গ এখন বর্তমান স্বাধীন ভারতের আর্কেওলজিক্যাল সার্ভের তত্ত্বাবধানে। যা গত ৯শ বছর ধরেই হায়দ্রাবাদ তথা ভারতেরই শান ধারণ করে চলেছে। এর রাজনৈতিক ব্যপ্তি তো ছিলোই, বিস্তৃতিও এতো বড় যে ক্যামেরার এক ফ্রেমে আঁটে না। দুর্গের পূর্বদিকের অংশ।  ছবি: বাংলানিউজ
বর্তমানে কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক ও পর্যটন আকর্ষণী মূল্য থাকলেও, দক্ষিণ থেকে দিল্লি— সেসময় সব সাম্রাজ্যের শাসকই চাইতেন অভেদ্য এ দুর্গটি দখলে নিতে। প্রভাব-প্রতিপত্তির অনন্য নিদর্শন ছিলো এটি। সময়ের হিসাব করলেও এটি অনন্য! কতো আক্রমণ, ঝড়-ঝাপটা, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ গেছে— কিন্তু পাহাড় চূড়ার মতো প্রবল বিক্রমে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোলকন্ডা দুর্গ।

** গোলকন্ডা দুর্গ: বোবা পাথরে অসমাপ্ত প্রেমের হাহাকার
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।