ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

টেরাকোটায় ভাস্বর স্বাধীন বাংলার ইতিহাস

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০২১
টেরাকোটায় ভাস্বর স্বাধীন বাংলার ইতিহাস

রাজশাহী: একটি টেরাকোটা জুড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস। ফুটে উঠেছে ৪৭’র দেশভাগ থেকে শুরু করে ৭৫’র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পট।

আছে পরাধীনতার শেকল থেকে বাঙালির মুক্তির স্বাদ আস্বাদনের সংগ্রামী পথের নিশানা। প্রতিফলিত হচ্ছে স্বপ্ন, বেদনা ও গৌরব। জাগ্রত করছে চেতনাবোধ।  

কোনোটা বড় আকারের মুখোশ, কোনোটা নারীর গড়ন। বড় পরিসরে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবয়বও দারুণ নান্দনিক। শির উঁচু করে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে এক যোদ্ধা। এক প্রান্তে জাতীয় চার নেতার অবয়ব। শিল্পীর শৈল্পিক ছোঁয়ায় টেরাকোটার ফ্রেমে ধারাবাহিকভাবে ধরা দিয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড দৃশ্যপট।

তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশের ইতিহাস পৌঁছে দিতে দেশসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজে নির্মিত হয়েছে এমনই এক মনকাড়া ও অপূর্ব টেরাকোটা। এতে ফুটে উঠেছে দেশের সুবিশাল সংগ্রামের ইতিহাসের শৈল্পিক অবয়ব। এই টেরাকোটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ইতিহাস।

'টেরাকোটা' শব্দটি এসেছে লাতিন থেকে। লাতিন ভাষায় টেরা মানে মাটি, কোটা অর্থ পোড়ানো। সহজ করে বললে মাটি পুড়িয়ে যে শৈল্পিক ভাস্কর্য গড়া হয়, শিল্পের ভাষায় তাই টেরাকোটা। টেরাকোটা শিল্প হিসেবে এ অঞ্চলে হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন। আধুনিক স্থাপত্যশিল্পেও এর কদর কম নয়।

প্রাচীন বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল এই টেরাকোটা। উত্তরের জেলা বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসিজদসহ প্রত্নতাত্ত্বিক নানা স্থানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে নানা আকার, আকৃতি ও নকশার হাজার বছরের পুরনো টেরাকোটা।

আধুনিক যুগের শিল্পীরা ওই ঐতিহ্য মনে রেখে নিজের মননশীলতা দিয়ে নির্মাণ করেন একেকটি শৈল্পিক টেরাকোটা। শিল্পীদের এই নিপুণ কাজে ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে অত্যাধুনিক সব কলাকৌশল।

রাজশাহী কলেজ সূত্রে জানা যায়, নির্মিত টেরাকোটার দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট ও প্রস্থ ৫ ফুট। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘উদয়-অস্ত বাংলাদেশের’। শিল্পী সৈয়দ মামুন-অর-রশিদ টেরাকোটার কাজটি করছেন। এতে ব্যয় হচ্ছে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। অসাধারণ এই কাজের মাধ্যমে উঠে এসেছে বাংলাদেশের বিবর্তন ও পরিবর্তনের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো।

নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে স্থাপনাটি এক অনন্য নিদর্শন। টেরাকোটার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে ১৯৪৭’র দেশ ভাগ, ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনসহ পরবর্তী ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থান।  

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস ফুটে উঠেছে এখানে।

রাজশাহী কলেজে এই টেরাকোটা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, টেরাকোটার ফ্রেমে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড দৃশ্যপট। এর কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও সর্বস্বত্যাগী সংগ্রামী মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের তেজোদীপ্ত ভাষণের কারুকার্য খচিত ফলক। তার পাশেই উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা।

এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ দেশমাতৃকার বীর সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের সময়ের সুচারু অবয়ব। রয়েছে রাইফেল হাতে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নজরকাড়া বিপ্লবী ভঙ্গিমা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে বীর সৈনিক বিজয়ীর বেশে নির্ভীক প্রহরীর মতো স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

টেরাকোটার চিত্রপটে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর শহীদদের আত্মত্যাগ, দুঃখ ও শোকের প্রতীক দৃশ্যমান। যা প্রতি ক্ষণে মনে করিয়ে দিচ্ছে বাংলার স্বাধীনতার গৌরবময় স্মৃতির কথা। এ শিল্পকর্মটি দেখতে প্রতিদিন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ কৌতুলহী সাধারণ মানুষ আর দর্শনার্থীর ভিড় লেগেই আছে।

টেরাকোটা নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হবিবুর রহমান বলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে আমাদের এই প্রচেষ্টা। আগামী সপ্তাহের মধ্যে পুরো কাজটি সম্পন্ন হবে। এরপর এটির বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন করা হবে। এমন স্থাপত্যের মাধ্যমে শুধু কলেজের শিক্ষার্থীরাই নয়, দর্শনার্থীরাও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং পূর্ববর্তী ঘটনাবলি সম্পর্কে জানতে পারছে। বুকে ধারণ করছে দেশপ্রেমের প্রতিজ্ঞা।

পদ্মাপাড়ের এই শহরে ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী কলেজ বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের ৬৮৫টি কলেজের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি তিনবার দেশসেরা কলেজের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশে এই কলেজেই সর্বপ্রথম মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া শুরু হয়। এটি বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি দেয়। ১৯৯৬ সাল থেকে এই কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ছাত্র নথিভুক্ত করা বন্ধ করা হলেও ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে পুনরায় ভর্তি করা হচ্ছে।

ড. কুদরত-ই-খুদা, ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কাজী মোতাহার হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ঋত্বিক ঘটক, আনোয়ার পাশা, ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াসহ অসংখ্য গুণী ব্যক্তি এই রাজশাহী কলেজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০২১
এসএস/এমআইএইচ/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।