ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

লক্ষ্মীপ্রিয়ার বাড়িতে একদিন দুপুরে

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০২২
লক্ষ্মীপ্রিয়ার বাড়িতে একদিন দুপুরে

লক্ষ্মীপুর থেকে ফিরে: ‘সার্কিট হাউজে দুপুরের খাওয়া শেষ করে বিকেল ৪টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা’। এ খবরটা যখন পেলাম, ঘড়ির কাটায় তখন দুপুর ২:৩০।

লক্ষ্মীপুর আসার পর থেকে তিন দিনে কাজ ছাড়া শখের ঘোরাঘুরি খুব একটা হয়নি বললেই চলে। ভোরবেলা শহর দেখতে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটাহাটি আর সন্ধ্যার পর এগলি ওগলি ঢু মেরে চায়ের আড্ডা। এই যখন রুটিন, তখন শেষ মূহুর্তে প্রায় চারশ বছরের ইতিহাসের টানে আর দম রাখা গেল না! তাইতো দেরি না করে বাংলানিউজের লক্ষ্মীপুর জেলা প্রতিনিধি নিজাম উদ্দিন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জেলার অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা দালাল বাজার জমিদার বাড়ি আর তার নৃত্যশালার স্মৃতির টানে।

হালকা বৃষ্টির পর দুপুরের রোদ যখন পুরোপুরি মাথার ওপর, তখন আমরা পা রাখলাম জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকার প্রথম সিঁড়িটিতে। বৃষ্টির পর মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ আর চারশো বছরের পুরনো ইটের ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে বন্ধ হয়ে আসে চোখ। কিছুক্ষণের জন্য চলে যাই কল্পনার জগতে- সতেরো শতক, রোদ-বৃষ্টি পেরিয়ে এক যাযাবর অতিথি হতে চলেছে জমিদার লক্ষ্মীনারায়নের ঘরে। তার পুত্র ব্রজবল্লভ রায় নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতায় দারুণভাবে সফল। আর নাতি পুত্র গৌরকিশোরকে লেখাপড়া করিয়েছেন কলকাতায়, ছেলের বউ হিসেবে এনেছেন সেতারের সুরের মতো মিষ্টি মেয়ে লক্ষ্মীপ্রিয়াকে। যতদূর জেনেছি, এই প্রিয়ংবদার নামেই নামকরণ হয়েছে এ নগরীর। তাই তার প্রতিও এই যাযাবরের আগ্রহ কম নয়!

সিঁড়ি পেরিয়ে অন্দরমহলের বারান্দায় পা রাখতেই আরও দৃঢ় হয় কল্পনা- বাড়িতে ঢোকার সময় রাজ তোরণ পেরিয়ে নজর কাড়ে রাজপ্রাসাদ, জমিদার প্রাসাদ এবং অন্দরমহল। পাশেই  বাঁধানো ঘাট, নাট মন্দির, পূজামণ্ডপ, উঁচু ভীম এবং বাড়ির প্রাচীর। হেঁটে যাচ্ছি এগুলোর মধ্য দিয়েই। ডান হাতে পড়া জানালাটা পেরুলেই যেনো পৌঁছে যাবো। একটু এগোলেই সুন্দর ব্যালকনির নিচে থাম পেরিয়ে বিশাল একতলা বাড়ি। সে বাড়িতে ঢুকতে আরও একটা বড় দারাজ পেরুতে হয়। সেই দারাজের কারুকার্য বলে দেয় বাড়ির মালিক কতটা নান্দনিক। অর্থের যে অভাব নেই তা বাড়ির সাজ-সজ্জা দেখলেই বোঝা যায়। বাড়ির বাঁকানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পরই পাওয়া যাবে সুন্দর সাজানো গোছানো বারান্দা, তার পাশে মাহফিলখানা। বাড়ির মনিব অন্দরমহলে বাস করেন। পাশের ঘরগুলোতে থাকে কর্মী, ভৃত্য আর পোষ্যরা। সেই ঘরগুলোর সামনে বেশ বড় বাগান। সেই বাগান থেকে ভেসে আসে নূপুরের শব্দ।

কল্পনা থেকে চোখ মেলতেই দেখি দর্শনার্থী নারী-পুরুষ ঘুরে ঘুরে দেখছেন জমিদার বাড়ির অন্দরমহল, বসে গল্প করছেন পুকুর ঘাটে। সে দৃশ্যে কল্পনায় সন্ধ্যা নামে- বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসে নূপুরের আওয়াজ। গভীর রাত পর্যন্ত চলবে এই আওয়াজে নাচ গানের আসর। সে আয়োজনের সুমধুর আওয়াজে পুরো এলাকা হবে মুখরিত। সারেঙ্গী সেতারের মিষ্টি সুর বাতাসে ঘুরে বেড়াবে। আসরে আমন্ত্রিত অতিথিরা ফুল ভালোবাসে দেখে হরেক রকমের ফুল নিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে ফুলওয়ালা। পানওয়ালা পান সাজিয়ে বসে আছে। এগুলো কোন সাধারণ পান নয়। জাফরান ও গোলাপজলে ভিজিয়ে রাখার পরেই এই পানগুলো দিয়ে খিলি বানানো হয়। আর খিলি বানানোর সময় মিশিয়ে দেওয়া হয় অল্প আফিম। তবে নৃত্য বা আফিমের নেশার থেকে সদ্য ‘রাজা’ উপাধি পাওয়া জমিদার পুত্র গৌরকিশোরের বেশি আকর্ষণ তার স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়ার প্রতি। সাজানো গোছানো বাড়িটি দেখলেই এ লক্ষ্মীপ্রিয়ার নান্দনিক রুচির পরিচয় পাওয়া যায়।

১৯৫০ সালে জমিদার প্রথা বিলুপ্তির পর এ জমিদার পরিবারটির শৌর্য-বীর্য কমতে থাকে। তারপরও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তারা এ বাড়িতে থেকেই নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। পরে ধীরে ধীরে তারা ভারত ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যান। তার পর থেকেই এই যাযাবরের কল্পনা আর ইতিহাসের নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে ঘাট বাঁধানো পুকুর, উঁচু উঁচু প্রাচীর ঘেরা নান্দনিক কারুকাজের দালান, নৃত্যশালাসহ নানা স্থাপনা। আর তা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে বেড়াতে আসেন ভ্রমণ পিপাসুরা।

দীর্ঘদিনের পরিত্যাক্ততা আর বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সংস্কার না হওয়ায় জমিদারি প্রথার স্মৃতিচিহ্ন গায়ে মেখে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটি হয়ে আছে জেলার ঐতিহ্য। লক্ষ্মীপ্রিয়ার প্রিয় বাড়িটির বিভিন্ন ভবনের দেয়াল এখন ধসে গেছে। ইটের স্তর ভেদ করে কোথাও গজিয়েছে বিশালাকার পরজীবী গাছ। কোনো কোনো ভবনের উপরিভাগ গেছে ক্ষয়ে। অথচ কতগুলো দিন সন্ধ্যাবেলায় এ বাড়িতেই সন্ধ্যাপূজোর প্রার্থনাতে দীর্ঘতা কামনা করেছেন লক্ষ্মীপ্রিয়া।

এলাকাবাসী জানান, জমিদার বাড়িটির এমন ভগ্নদশা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থী আসছে প্রতিদিনই। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সহজেই এখানে আসা যায়। তবে ধসে পড়েছে কোনো কোনো ভবনের দেয়াল। কোনোটিতে দেখা দিয়েছে ফাটল। জরাজীর্ণ এসব ভবন যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তবে দেখাশোনা করছে জেলা প্রশাসন।

জমিদার বাড়ির তিনদিকে সান বাঁধানো তিনটি পুকুর। সংস্কারের অভাবে এসবের সবই আজ জরাজীর্ণ। এজন্য একটু মন খারাপ হয়ে গেলেও বাড়িটির চারপাশে নানা ফলের গাছ দেখে মন ভালো হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় আরও কিছু সময় এখানেই পেরিয়ে যাক। তবে ঘড়ির কাটায় ডাক আসে- প্রায় চারটে বাজতে চলেছে।

আনুমানিক ৪০০ বছর আগে যে লক্ষ্মীনারায়ণ কাপড়ের ব্যবসা করতে লক্ষ্মীপুরে এসেছিলেন, পরবর্তীকালে তার  বংশধরেরাই জমিদারি করে গেছেন এই এলাকায়। আর এসব চরিত্রের মধ্যে মধ্যমণি যে বসে আছে, তার নাম লক্ষ্মীপ্রিয়া। নিঃসন্তান এই জমিদার দম্পতি রাজা-রানী হওয়া সত্ত্বেও তাদের দুঃখের শেষ ছিল না। সেই দুঃখ লাঘব করার জন্য ঢাকার বিক্রমপুর থেকে গোবিন্দ কিশোর নামের এক ছেলেকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সুযোগ্য সন্তান হিসেবে গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে গোবিন্দ কিশোরের তিন পুত্র ছিল- শৈলেন্দ্র কুমার রায়, সত্যেন্দ্র কুমার রায় এবং নবীন কিশোর রায়। এই তিন ভাই জমিদারি দেখাশোনা করলেও মূলত নবীন কিশোরই ছিলেন মুখ্য জমিদার। সেসব ইতিহাস ফেলে উঠতে ইচ্ছে করে না। তবুও রেখে ফিরতে হয় ব্যস্ত নগরীর উদ্দেশ্যে। পেছনে পড়ে থাকে অন্দর মহলের বাইজী ঘরসহ আরও কত জানা অজানা গল্প আর লক্ষ্মীপ্রিয়ার পিছুটান।

বাংলাদেশ সময়: ২৩৫৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০২২২
এইচএমএস/এনএইচআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।