ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

রবির ৩০ মিনিট!

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০২২
রবির ৩০ মিনিট! সপরিবারে বিকল্প উপায়ে চা শ্রমিক রবি দাসের মাছ শিকার। বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

মৌলভীবাজার: দারিদ্রপীড়িত মানুষের জীবন চলছে মারাত্মক দুর্ভোগে। সঙ্গতি নেই ন্যূনতম আয়ের সঙ্গে লাগামহীন ব্যয়ের।

বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর ক্রয়ের ক্ষমতা যেখানে নেই। যেখানে সাধসাধ্যের জিনিসপত্তরগুলো যেনো আজ সোনার হরিণ!

‘মাছ’ প্রতিটি বাঙালি প্রিয় খাবারের একটি। হোক সেটা বড় কিংবা ছোট মাছ। এক টুকরো মাছ রোজ পাতে থাকা চাই-ই। তাতে রসনার তৃপ্তি মিটে গিয়ে কিছুটা পুষ্টিপ্রাপ্তি হয় শরীরের। আমিষের বড় একটি অংশ মানুষ পেয়ে থাকে মাছ থেকে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই প্রিয় খাবারটুকু সংগ্রহ করা নানা বিবেচনায় আজ অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অর্থাৎ চা-বাগানের শ্রমিকদের আয়ের বড় একটা অংশই চলে যায় স্থানীয় মুদি দোকান থেকে নেওয়া আগের ঋণগুলো চুকাতে চুকাতে। তাহলে উপায়?এ উপায়টা বের করতে দেরি হয় না চা-শ্রমিক নারায়ণ রবি দাসের। আর্থিক অসঙ্গতির অর্থ যখন নিয়ন্ত্রণহীন কিংবা বাজার থেকে মাছ কেনার ক্ষমতা যখন নেই। তখন উপায় তো একটা বের করতেই হয়!

সদলবলে উদ্যোগী হলেন তিনি প্রকৃতি থেকে মাছ শিকারে। নিজের ছেলে, সঙ্গে দুই ভাইপোসহ (ভাজিতা) মোট চারজন মিলে ঠিক করলেন চা-বাগানের ছোট জলাভূমি থেকে পানি সেচে (সনাতনপদ্ধতিতে সেচ) মাছ ধরবেন। যেভাবে সেই কাজ! সেদিন ছিল তার সাপ্তাহিক ছুটি।

সময় তখন মধ্যাহ্ন। মাথার ওপর ক্ষিপ্রতায় জ্বলছে প্রকাণ্ড সূর্য। ‘পৃথিবী’ নামক গ্রহের ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের ‘সিলেট’ নামক এলাকার চা-বাগান ঘেঁষা জলাভূমিতে দারিদ্রতার সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ করে মৎস্য আহরণে তখন ব্যস্ত চা-শ্রমিক রবি দাস। ঘামের সংখ্যাতীত কণাগুলো তখন তার শরীরজুড়ে। যত সমস্যাই হোক – একটু মাছ চাই-ই চাই!

ঘড়ির কাটা সোয়া একটা। তিনি তার দলকে নিয়ে ব্রিজের নিচে জলাভূমিতে বাঁধ দিতে ব্যস্ত। একটু পরই পানিগুলো অন্যত্র সরিয়ে মাছ ধরা হবে। ছোট পরিত্যক্ত জলাভূমিটাকে বাঁধ দিতে কিছুটা সময় লেগে গেল। পাশের আইল থেকে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে প্রথম দেওয়া বাঁধটা টেকেনি, ভেঙে গেছে পানির তোড়ে। পুনরায় আবার একটু দূরের আইল থেকে মাটি কেটে কেটে অপেক্ষাকৃত বড় বাঁধ দেওয়া হলো। হ্যাঁ, এবার ঠিকঠাক। রবি দাস শুরু করলেন বাঁধ দেওয়া অংশের পানি অন্যত্র ফেলে দেওয়ার কাজ। একটু পর পরই একগুচ্ছ জলের শব্দ! ওরা যেনো দলগতভাবে উড়ে গিয়ে বিচিত্র শব্দে অন্যত্র পড়ছে! এ শব্দটি যেনো অনেকটাই ঘোর লাগা!

প্রায় ২০ মিনিট কেটে গেল। সব জলশূন্য হয়ে ছোট জলাভূমিটা শুকিয়ে গেল। ছোট ছোট শিং, মাগুর, খলিশা, চ্যাং প্রভৃতি মাছগুলো তাতে আত্মরক্ষায় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি আরম্ভ করে দিল। রবির সঙ্গে থাকা শিশুরাও মনের আনন্দে জলাভূমি কাঁদা ঘেঁটে ঘেঁটে মাছগুলোকে ধরার কাজে অতি ব্যস্ত তখন। একটা মাঝারি আকারের শিং মাছ যখন পানিহারা হয়ে নিজেকে বাঁচাতে কাঁদায় গিয়ে শরীর লুকালো।  শিশুরা তখন তাকে সুকৌশলে ধরে পাত্রে রেখে দিল।  এই পরমানন্দের দৃশ্যটি যেনো পৃথিবীর আর সব সার্থক দৃশ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতামুখর হতে চায়!

খুব যে বেশি পরিমাণে মাছ পাওয়া গেল - তা কিন্তু নয়, এই আক্ষেপটুকুর জবাব চাওয়া হলে রবির জমা রাখা কথাগুলো বের হওয়ার সুযোগ পেল।

তিনি জানান, টাকা কই পাবো বাবু যে, মাছলি (মাছ) কিনবো? সাপ্তাহিক যে টাকা পাই তা বাকিখাতা চুকাতে চুকাতে শেষ হয়ে যায়। একটু মাছ খাইতে মন চায় বার বার। তাই বাচ্চাদের নিয়ে এখানে মাছ ধরতে আইছি। এ মাছলি দিয়ে আমাদের মোটামুটি কোনোমতে একবেলা হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০২২
বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।