ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

মুক্তো ঝরা শিশিরে হেমন্তেই শীতের হাতছানি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২২
মুক্তো ঝরা শিশিরে হেমন্তেই শীতের হাতছানি ধানক্ষেতে ভোরে দেখা মিলছে শিশিরের

রাজশাহী: নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে শরৎ বিদায় নিয়েছে এই কদিন আগেই। শুভ্র সফেদ শরতের বিদায়ে প্রকৃতিতে অভিষেক ঘটেছে ঋতু রানি হেমন্তের।

শিশির বিন্দুতে সাদা কাশফুলের রঙও এখন হয়ে উঠেছে ধূসর। এরই মধ্যে মিলছে শীতের আগমনী বার্তা।

ভোরের স্নিগ্ধ শিশিরে মিলছে শীতের আবেশ। পুব আকাশে সূর্য যখন উঁকি দিচ্ছে, ঘন কুয়াশার চাদরে তখন ঢাকা পড়ছে ভোরের সেই সোনারাঙা রোদ। বিকেল পাঁচটা না বাজতেই পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছে রক্তিম সূর্য। অলস বিকেলের গোধূলী লগ্ন পেরিয়ে জলদিই নেমে আসছে সন্ধ্যা। ভোরের আলো ফুটতেই স্নিগ্ধ শিশিরে ভেজা সবুজ ধানের পাতাগুলো নুয়ে পড়ছে বাতাসে। এই মুক্তো ঝরা শিশিরে হেমন্তেই হাতছানি দিচ্ছে শীত।

আবহমান বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে আবারও শুরু হয়েছে ঋতুর পালাবদল। আবারও পাল্টাচ্ছে প্রকৃতি ও জীবন। ছয়ঋতুর বঙ্গাব্দ বর্ষপঞ্জিতে এখন চলছে কার্তিক মাস। কার্তিক-অগ্রহায়ণ এ দুই মাস বাংলায় হেমন্তকাল। আর হেমন্তকে বলা হয় অনুপম ও অপরূপ রূপের ঋতু। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্না। এ ঋতুতেই স্বপ্ন দেখেন বাংলার কৃষক-কৃষাণী। সকালের শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রকৃতিতে বেজে ওঠে শীতের আগমনী বার্তা। মাঠের পাকা সোনালি ধান, কৃষকের ধান ঘরে তোলার দৃশ্য, কৃষক-কৃষাণীর আনন্দ সবই হেমন্তের রূপের অনুষঙ্গ।

আর মধ্য কার্তিকে এবার পদ্মাপাড়ের রাজশাহীতে অনেকটা এভাবেই নির্মিত হয়েছে মিষ্টি শীতের আবহ। প্রকৃতিতে এখনই টের পাওয়া যাচ্ছে শীতের স্পর্শ। প্যাচপ্যাচে গরম যেন যাইযাই করছে। কয়েক দিনের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে পদধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে শীতের। তাহলে কাঁপন ধরা শীত নামবে কবে? আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, ডিসেম্বরের আগে নয়। অর্থাৎ অগ্রহায়ণ পেরিয়ে পৌষ মাস এলেই নামবে হাড় কাঁপানো শীত।  

তবে কার্তিকের স্নিগ্ধ সকালের শিউলি ঝরা প্রকৃতিতে এখনই ছড়িয়েছে শীতের বারতা। পাখির কিচিরমিচির শব্দে রক্তাভ আকাশে সূর্য উঁকি দিতেই শিশির ছড়াচ্ছে সবুজ দূর্বাঘাসে। নিগূঢ় রাতের আড়মোড়া ভেঙে ভোরের আলো ফুটতেই শিশিরবিন্দুগুলো আটকা পড়ছে ধানক্ষেতের মাকড়সার জালে। আর শীষের ডগায় জমা শিশিরগুলো যেন মুক্ত দানার মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। হয়ে উঠেছে সবুজ প্রকৃতির প্রতিবিম্ব।

শ্যামল এই প্রকৃতিতে ম ম করছে মল্লিকা, শিউলি, কামিনী আর ছাতিম ফুলের মিষ্টি সৌরভ। কুয়াশার আঁচল সরিয়ে যখন ঝিরিঝিরি উত্তুরে বাতাস বইছে শরীরে তখন ছড়িয়ে পড়ছে শীতের হিম স্পর্শ। আর সেই পরশেই হিমেল হয়ে উঠেছে কার্তিকের ছোট্ট সকাল।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের পর গেল কয়েক দিন থেকে ক্রমেই নামছে তাপমাত্রার পারদ। কমছে অসহ্য গরম। ভোরে ও সন্ধ্যায় হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে গ্রাম ও শহুরে প্রকৃতি। শেষ রাতের হিমেল পরশ আর সকালের নরম রোদের আবেশ জানান দিচ্ছে- হেমন্তের হাত ধরেই ধীর পায়ে আসছে শীত। ষড়ঋতুর এই অপরূপ বাংলা তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য দিয়ে মানুষকে বিমোহিত করতে আসছে আবারও। আর যে কারণেই হোক এমন নিয়ম মেনে শীত নামেনি যেন অনেক বছর। গেল বছরও শীতের প্রকোপ ছিল একেবারেই কম। যেন অনেক দিন পর তাই একরাশ সজীব স্বপ্ন নিয়ে আবারও হাজির শীতোষ্ণ প্রকৃতি।  

ভোরের কুয়াশামাখা প্রকৃতি আর দুপুরের মাঠে সোনালি ধানের সোঁদা গন্ধ কৃষকের চোখে-মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠেছে এখনই। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে কার্তিকের পর অগ্রহায়ণ পেরিয়ে পৌষ-মাঘ শীতকাল ধরা হলেও এবার মধ্য কার্তিকেই মিলছে শীত শীত অনুভূতি।

ভোররাতে হাতে সেলাই করা রঙিন নকশি কঁথা, কম্বল বা চাদর গায়ে মুড়ি না দিলে যেন উষ্ণতা মিলছে না। ঘুমন্ত শরীরটাও যেন ওম চাইছে। তাই দুদিন থেকে সকাল-বিকেল শীতের কাপড় নিয়েই বাইরে বেরুতে হচ্ছে শীতকাতুরে মানুষকে। আলমিরায় বন্দি থাকা গরম কাপড়গুলো তাই এখনই ঠাঁই নিতে শুরু করেছে ঘরের আলনায়। গরমের সেই ক্ষিপ্রতা নেই। গাছের নরম-কচি পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে মিষ্টি রোদ। শুষ্ক হয়ে উঠছে ত্বক। বিকেল গড়ালেই রোমাঞ্চিত করছে হিমেল হাওয়া। রাতে সেই হাওয়া কাঁটা দিচ্ছে শরীরে। গরম কাপড় উঠছে তাই সবার গায়েই।  

বরেন্দ্রভূমি খ্যাত এই রাজশাহীকে বলা হয় দেশের এই রুক্ষ ও উষ্ণ অঞ্চল। এখানে গরমের সময় গরম বেশি। শীতের সময় শীত। তাই গরমের পর একটু আগেভাগেই এবার রাজশাহীতে আঁচড় বসিয়েছে শীত। ভোরের আলো দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়তেই মেঠোপথ ঘেঁষা মাঠের ধানের পাতাগুলো ভিজে উঠছে স্নিগ্ধ নীহারে।

হামাগুড়ি দিয়ে শীত যখন অপরূপ এই প্রকৃতিতে আসছে তখন শুরু হতে যাচ্ছে নবান্ন উৎসব। এই নবান্ন উৎসব আবাহমান বাংলার চিরায়ত প্রথা হিসেবে যুগযুগান্তর থেকে চলে আসছে। মধ্য হেমন্তে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে উঠতে থাকে নতুন ধান। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মনে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দেয়। কালের বিবর্তনে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও কৃষকরা নবান্ন উৎসব পালন করতে ভুলে যায়নি আজও।

তবে এমন ভিন্ন আবহে কার্তিক কাটলেও মধ্য ডিসেম্বরের আগে বাড়বে না শীতের তীব্রতা। গত সপ্তাহ থেকেই মাত্র দিনের তাপমাত্রাও কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে রাজশাহীতে দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২২ থেকে ১৯ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। এভাবে কমতে কমতে হাড় কাঁপানো শীত নামবে ডিসেম্বরেই। অর্থাৎ অগ্রহায়ণ শেষে পৌষের শুরুতেই নামবে কাঁপন ধরানো শীত।

বাংলাদেশের পরিবেশবিদরা বলছেন, সমুদ্রের গভীর থেকে নিরক্ষীয় বায়ুর প্রভাবে শীতল স্রোত তৈরি হচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরে এরইমধ্যে এই স্রোত দেখা দিয়েছে। যার জন্য উত্তর নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণতা কমতে শুরু করে। এবার সেই লা নিনার প্রভাবেই ঠাণ্ডা পড়বে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, শীতের আগমন নির্ভর করে মূলত জলবায়ুর ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের বৃষ্টিপাতের ধারা পরিবর্তন ও দক্ষিণের বায়ু প্রবাহের যে হেরফের হয়েছে এতে আমাদের মৌসুমি বাউন্ডারিগুলো আর আগের মতো নিয়মিত নয়। ফলে শীত কোনো বছর আগে আবার কোনো বছর পরে শুরু হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমবেশি হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রারও পরিবর্তন হয়। এতে বায়ুপ্রবাহের দিক ও সমুদ্র স্রোতের কিছুটা পরিবর্তন হয়। আমাদের দেশে যে শৈত্যপ্রবাহ আসে এটি মূলত উত্তর বা উত্তরপশ্চিম দিকের বায়ু। এই শীতল বায়ুর প্রভাবে আমরা ঠাণ্ডা অনুভব করি। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় সেখানের উষ্ণ বায়ুর পরিমাণ কমে গেছে। এতে উত্তরের শীতল বায়ু এখন খুব সহজে আমাদের দিকে চলে আসতে পারছে। ফলে দ্রুত শীত পড়েছে।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, চার-পাঁচদিন থেকে আবহাওয়ার ধারাবাহিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গড় তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। আর আজ শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছে ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তাপমাত্রা সাধারণ ১৮ ডিগ্রির নিচে নামলেই শীত পড়তে শুরু করে।

তিনি জানান, দেশে ১৫  ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত শীতের তীব্রতা থাকবে। এ সময়টায় সর্বোচ্চ শীত পড়বে। এরপর থেকে আবার শীত কমতে শুরু করবে। তাই মধ্য ডিসেম্বরে রাজশাহীসহ গোটা উত্তরাঞ্চলে জেঁকে বসবে শীত। নভেম্বরে বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস রয়েছে। আর ঘূর্ণিঝড়ের রেশ না কাটতেই ডিসেম্বরে শৈত্যপ্রবাহেরও আশঙ্কাও রয়েছে। তবে এখন থেকেই রাত ও দিনের তাপমাত্রা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকবে।

এদিকে, ঢাকা আবহাওয়া অধিদফতরের তিন মাস মেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে- এই অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা কিছুটা বেশি থাকতে পারে। তবে নভেম্বরে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতে পারে।  

এ মাসে বঙ্গোপসাগরে ১-২ টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। যার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়েও রূপ নিতে পারে। এ মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা কমতে থাকবে। ডিসেম্বরে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতে পারে।  

এ মাসে রাতের তাপমাত্রা কমে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে এক থেকে দুইটি মৃদু (৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) শৈত্যপ্রবাহ এবং মাঝারি (৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ মাসে শেষরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চল ও নদ-নদী অববাহিকায় মাঝারি থেক ঘন কুয়াশা এবং অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি কুয়াশা পড়তে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২২
এসএস/এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।