ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

এ যেন বাঙালি-বিহারি খাবারের একটা ভিন্ন জগৎ

টিপু সুলতান, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২২
এ যেন বাঙালি-বিহারি খাবারের একটা ভিন্ন জগৎ

ঈশ্বরদী (পাবনা): সেই ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ঈশ্বরদী রেল জংশন। শতবর্ষের ঐহিত্যবাহী ঈশ্বরদী শহরটি বাজার কেন্দ্রীক বলে লোকসমাগম থাকে সারাক্ষণই।

একসময় উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের বড় মোটরস্ট্যান্ড ছিল এই শহরে।

উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বারও বলা হয় ঈশ্বরদীকে। যেখানে গড়ে উঠেছে কয়েক লাখ মানুষের বসতি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে রয়েছে হাজারো উর্দুভাষী। যারা দীর্ঘদিনের বসবাসে এখন বাংলা ও উর্দু- উভয় ভাষাতেই পারদর্শী।

বাংলা এবং উর্দু- এই দুই ভাষার মধ্যে মিল রেখেই বাঙালি-বিহারি খাবারের আলাদা একটা জগৎও আছে ছোট্ট এই শহরে।

শত বছরের পুরনো ঈশ্বরদী শহরে সেই ব্রিটিশ আমলের হরেক রকমের বিহারি খাবারের ভিড়ে তন্দুরি রুটি, শিক কাবাব, নিহারি, মোগলাই পরোটা ও গরু বা খাসির হালিম, ভুড়ি ভাজা বেশ জনপ্রিয়। সপ্তাহে শুক্রবার ছাড়া গোটা বছরেই শিক কাবাব আর তন্দুরি রুটির বেশ চাহিদা থাকে এখানে। তবে শীত মৌসুমটা সকলের কাছে পায় আলাদা জনপ্রিয়তার মাত্রা। বিশেষ করে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আশপাশের কয়েকটি জেলা শহরের মানুষের আনাগোনায় মুখরিত থাকে এই শহরের ঐতিহ্যবাহী ‘তৃপ্তি হোটেল’।

ঈশ্বরদী বাজারে অবস্থিত এই তৃপ্তি হোটেলের সামনে যে কেউ দাঁড়ালেই চোখে পড়বে উত্তপ্ত কয়লায় পোড়ানো শিক কাবাবের দৃশ্য, আর নাকে পৌঁছে যাবে তার মৌতাত চড়ানো ঘ্রাণ। মাটির চুলায় গরম তন্দুরি রুটি তৈরীর দৃশ্য মুগ্ধ করবে যে কোনও ভোজন রসিককেই।

বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যাতেও দেখা মেলে তেমনই দৃশ্যের। কেউ হোটেল বসে তৃপ্তিভরে খাচ্ছেন, তো কেউ পার্সেল করে বাড়িতে পরিবারের সকলের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে আবার এই খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে আসেন আশপাশের জেলা থেকেও।

ঈশ্বরদীর বাঙালি-বিহারি খাবারের সমাহার এই ‘তৃপ্তি হোটেল’-এ একটা সময় তন্দুরি রুটি ছিল ২ টাকা, শিক কাবাব ১০ টাকা এবং নিহারি ১৫ টাকা। পরে তন্দুরি রুটি ৫ টাকা, শিক কাবাব ২০ টাকা ও নিহারি ৩০ টাকা হয়। বর্তমানে তন্দুরি রুটি ২০ টাকা, শিক কাবাব ৬০ টাকা আর নিহারি ১২০ টাকা দামে বিক্রি হলেও এসব মুখরোচক ভোজনে বিন্দুমাত্র আগ্রহ কমেনি কারোরই।  

হোটেলটি স্থাপিত হওয়ার পর কাবাব তৈরির কারিগর ছিলো সাবেদ। তার কাছ থেকে কাবাব তৈরি আয়ত্ত করেন আনোয়ার হোসেন। তিনিই ২০ বছর যাবৎ এ হোটেলের কর্মচারী। দিনশেষে হাজিরা মেলে মাত্র ৫শ টাকা। তন্দুরি রুটি বানানো কর্মচারীর দৈনিক মজুরীও একই।  

দেখা যায়, তৃপ্তি হোটেলে বসে তন্দুরি রুটি আর শিক কাবাব উপভোগে ব্যস্ত দুই বন্ধু। দু’জনই শিক্ষার্থী, আবির হাসান ও মাহমুদুল হাসান। সন্ধ্যা না হতেই রসনা বিলাসে এসেছেন তৃপ্তি হোটেলে।  

অনুভূতি জানতে চাইলে আবির হাসান বাংলানিউজকে জানান, শিক কাবাব আর গরম তন্দুরি রুটি হলো ঈশ্বরদীর অনেক পুরাতন ঐতিহ্য। এই শহরের অনেক নামীদামী নতুন খাবার থাকা সত্ত্বেও তৃপ্তি হোটেলের তন্দুরি রুটি ও শিক কাবাবের যে স্বাদ, এটা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।

পাবনা থেকে আসা ইমরোজ খোন্দকার বাপ্পী নামের এক ব্যক্তি বাংলানিউজকে বলেন, স্বাদ মতো শিক কাবাব, তন্দুরি রুটি ও নিহারি তৈরী করা অনেক কঠিন। তবে তৃপ্তি হোটেলের এই বিহারি স্বাদের খাবার সত্যিই অসাধারণ। আমি প্রায় দিনই সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে পাবনা থেকে এখানে আসি মনোহারি এই খাবারের জন্য। একে তো অনন্য স্বাদ, তার ওপর আর কোথাও এই খাবারটি পাওয়া যায় না। বাঙালিয়ানার সঙ্গে বিহারি স্বাদের মিশেলে তৈরি এই খাবার দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে ভোজন প্রিয় মানুষের সন্ধ্যার নাস্তা।

ঈশ্বরদীর বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম তাবিন ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তন্দুরি রুটি আর শিক কাবাব কিনতে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই পরিবারের জন্য নাস্তা নিতে আসেন এই দুই শিশু।

ঈশ্বরদী জংশনের টিকিট কাউন্টারের পাশে পুরাতন মোটরস্ট্যান্ডের দক্ষিণে অবস্থিত এই ‘তৃপ্তি হোটেল’। হোটেলটির মালিক আব্দুল মালেক মানিক বাংলানিউজকে জানান, ব্রিটিশ আমলের পুরাতন শহর ‘ঈশ্বরদী’তে একবার নতুন কেউ এলে, একবেলা খাবারের জন্য কিন্তু তৃপ্তি হোটেলেই আসেন। ঈশ্বরদীতে খাবারের হোটেল তো অনেক রয়েছে, কিন্তু সকলেই ঐতিহ্যবাহী এই হোটেলকেই খুঁজে নেন।  

আব্দুল মালেক মানিক আরও জানান, এবারই ৫০ বছরে পা রাখল ঈশ্বরদীর তৃপ্তি হোটেল। এই হোটেলের পুরনো ঐতিহ্য, পুরনো কিছু খাবার, যা ভোজন রসিকদের বেশ আকৃষ্ট করে। এসব ঐতিহ্যকে আমরা এখনও ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি।  

তিনি আরও জানান, ১৯৭২ সালে রেলের জায়গা লিজ নিয়ে হোটেলটি নির্মাণ করেছিলেন আবদুর রহিম ফকীর। পরে তা ভাড়া নিয়ে হোটেলটি চালু করেন আমজাদ হোসেন ডোমনা। পরে হুমায়ুন হোসেন, ইদ্রিস আলী হোটেলটি পরিচালনার দায়িত্ব পান। এখন আমি ও আমার ভাই হোটেলটি পরিচালনা করছি।

বর্তমানে হোটেলটিতে ১৬ জন কর্মচারী, দুইজন ম্যানেজারসহ মোট ২০ জন কাজ করছেন। আগে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকতো। করোনার পর ভোর ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত- ১৬ ঘণ্টা খোলা থাকে। সপ্তাহে শুক্রবার বন্ধ থাকে।  

জানা যায়, ‘তৃপ্তি হোটেল’ ঈশ্বরদীর রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে অন্যতম। হোটেলটিতে বসে খাবার উপভোগ করেছেন দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতা, আমলা, এমপি, মন্ত্রী, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের। একসময় হোটেলের সামনে বিশাল রেডিও টাঙানো থাকতো। মানুষ বিবিসি বাংলার খবর শুনতে জড়ো হতো। প্রয়াত সাংবাদিক কামাল লোহানী, কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল, সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুসহ দেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে হোটেলটি।  

সম্প্রতি হোটেলটির ৫০ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। দরজাবিহীন ‘তৃপ্তি হোটেল’-এ করোনাকালীন শাটার লাগানো হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২২
টিএস/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।