ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

অচেনা সন্ধ্যা | আকাশ মামুন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৭
অচেনা সন্ধ্যা | আকাশ মামুন অচেনা সন্ধ্যা

পাগলের মতো ঘরের মেঝের মাটি খুঁড়ে চলছে ঠান্ডু। এই শীতেও দরদর করে ঘামছে। কুচকুচে কালো চেহারায় ঘাম জমে চিকচিক করছে। মাথা নিচু করে মুখ দিয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে।

পিটানো শরীরে কোদালের কোপের সঙ্গে সঙ্গে পিঠের দুই পাশের পেশিগুলো শক্ত হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে। ভাঁজ পড়া কপাল আর সরু হয়ে আসা চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

ঠান্ডুর বউ ছয়ফুল মাটি সরাতে সরাতে আহাজারি করে বলছে, কেঠায় এতো বড় সব্বনাশ করতে পারলো! আল্লা যেনো তার বিচার করে, নুলা, আন্ধা হইয়া যেনো মরে, মরণের কালে জানি পানিও না জুটে কপালে। হায়রে আল্লা গো, এইডা কি সব্বনাশ হইয়া গেলো...।

ছয়ফুলের আহাজারিতে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। উত্তর পাড়ার রসুল, ছাত্তারের বউ, মনিরুদ্দির মা, ছয়ফুলের জা মইতনসহ আরও অনেকে। সবার উৎসুক দৃষ্টি ঠান্ডুর মাটি খুঁড়ে ঘরের মেঝে আলগা করার দিকে। মুনিরুদ্দির মা ফুলেতন ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ও ঠান্ডু কি হইয়ে। ঘর কুবাইয়া কি ছিরি করতাছস? কি হইছে কবি তো। ছাত্তারের বউ জিজ্ঞেস করলো, ও ছয়ফুল, কি হইছে তোমাগো? ছয়ফুল বিলাপ করেই চলছে। কারও উৎকণ্ঠা না ঠান্ডুর দৃষ্টি আর্কষণ করছে, না ছয়ফুলের বিলাপে ছেদ পড়ছে। সারা ঘরের মাটি খোঁড়া শেষ। কোনো হদিস নেই। এবার ঠান্ডুর রক্ত চক্ষু গিয়ে পড়ল ছয়ফুলের উপর। তখনো নানা রকম এলোমেলো আহাজারি করে যাচ্ছিল ছয়ফুল। আচমকাই ছয়ফুলের চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে মাটিতে ফেলে দিল ঠান্ডু। এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি দিতে দিতে খিস্তি দিয়ে ঠান্ডু জিজ্ঞেস করতে থাকলো, মাগি ক ট্যাকা কি করছস, কারে দিছস, কই রাখছস? আজইক্যা তরে আমি মাইরাই ফালামু। তুই ছাড়া ট্যাকার খবর কেউ জানে না। পুচ্চলিশ (৪৫) হাজার ট্যাকা। কাইলক্যা দরবেশের জমির ট্যাকা দেওনের কথা। যুদি ট্যাকা না পাই তাইলে তরে আমি খুন কইরা ফালামু। খুন কইরা জেলে যামু কইলাম।

রসুল বললো, কি পাগলা কতা কও ঠান্ডু! এতো ট্যাকা মাটির তলে থুইছো ক্যা। ডাইন হাতেরে বাও হাতের বিশ্বাস আছে? দেকছো কি কামডি নি করছে! সোজা কতা, পুচ্চল্লিশ হাজার ট্যাকা! গুঞ্জন পড়ে গেলো উপস্থিত সবার মাঝে। টাকার অংক শুনে সবার মাথায় বাজ পড়ার জোগাড়। হায় হায় করে সবাই আফসোস করতে লাগলো। অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে যে যার মতো সবাই আহাজারি করে উঠলো। গুঞ্জন ছাপিয়ে ছাত্তারের কথাই ঠান্ডুর কানে বাজতে থাকলো। ডাইন হাতরে বাম হাতে বিশ্বাস করতে নেই। ঠান্ডুর মাথায় চড়চড় করে রক্ত উঠতে লাগলো। দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে গেলো ঠান্ডু। খিস্তি দিয়ে বলতে লাগলো, আমি কিছু বুঝি না মনে করছস? মার খাওয়া থেকে বাঁচতে ছয়ফুলের কতো আকুতি। আমারে আফনে অবিশ্বাস কইরেন না। আমি এই কাম করবার পারি না। ভেংচি কেঁটে ঠান্ডু বলে উঠলো, আমি এই কাম করবার পারি না। আব্বাসের লগে কিয়ের এতো প্যাঁচাল, এতো কিলুকিলু কিয়ের আইজ বুঝলাম। ছাত্তারের বউ আর ঠান্ডুর বড়ভাবি মইতন ঠান্ডুকে ফের‍াতে গিয়েছিল। এক ঝটকায় ছাত্তারের বউকে ফেলে দিল ঠান্ডু। আলগা মাতবরি দেহাবার আইয়ো না কইলাম ছাত্তারের বউ। পুচ্চল্লিশ হাজার ট্যাকা, সোজা কতা না। বড ভাবিকেও শাসালো ঠান্ডু। ভাবি আপনে যাইন। আমাগো ঘরের ব্যাফারে আইবাই না কইলাম। ধাক্কা খেয়ে সাত্তারের বউ খেঁকিয়ে উঠলো, এই রহম ভুদাই কেউ এহন আছে। মানুষ মাটির তলে ট্যাকা থয়? ব্যাংকে না থুইয়া। তোমার যা মুনে চায় করগা। খালি বউডা মরুক। তারপরে তোমারে পুলিশ দিয়া কিবা কইরা শায়েস্তা করন নাগে হ্যাইডা দেহুমনি। মাই মাই মাই... কারো ভালা করনের নাই। পরিস্থিতি দেখে মইতনও পিছিয়ে গেলো। কোনো ঝামেলায় না জড়ানোই বিবেচনাপ্রসূত হবে মেনে মইতন দূরে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ পরিস্থিতির উপর দৃষ্টি রাখলো। ঠান্ডুর যে স্বভাব কখন না আবার মইতন আর তার স্বামীকে দোষারূপ করে সেই শঙ্কায় আচ্ছন্ন থেকে দূরত্ব বাজায় রেখে ঠান্ডুর কাণ্ড দেখতে থাকলো। ঠান্ডু আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলো। ফুসতে ফুসতে তলপেটে বার দুই লাথি মেরে বলে উঠলো মাগি তরে আমি তালাক দিলাম, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বাইন তালাক...। উপস্থিত সবার মাথায় বাজ পড়লো।  

ছয়ফুলের কান্না আচমকাই সবাইকে ছুঁয়ে গেলো এবার। কিছুক্ষণ আগের কান্নার সঙ্গে এই কান্নার যেনো কোনো মিল নেই। অনেক বেশি ভিতরে যার উৎস, অনেক বেশি দুঃখের বাষ্প যেই কান্নায় নির্গত হচ্ছে। ঠান্ডুর হাতের মার থেকে বাঁচতে ছয়ফুল এতোক্ষণ ডাঙায় তোলা মাছের মতো তপড়িয়েছে। এখন আর সেই তড়পানি নেই কিন্তু কান্নার গভীরতা আছে। মাটিতে গড়াগড়ি করে ছয়ফুল বিলাপ করে চলছে। সব ছাপিয়ে ছয়ফুলের জীবনের অনিশ্চয়তার কথাই বেশি বাজছে। এখন আমার কি হইবো? আমি কই গিয়া খারামু? আমি যে শ্যাষ হইয়া গেলাম। জীবন সংসারে আশ্রয়ের যে স্থানটি ছয়ফুলের ছিলো সেটা বাইন তালাক বলার সঙ্গে সঙ্গে অজানা অচেনা ঝড়ে গুড়িয়ে গেছে। সেই আশ্রয় ভিটা নিশ্চিহ্ন হয়ে প্রমত্তা সাগরের ঢেউয়ে ছয়ফুল ছিন্নমূল হয়ে সাগরে ভাসছে। নিমিষেই তার সুখের সাজানো সংসার সাগরে গ্রাস করে নিয়ে গেলো। মধ্য দুপুরেই তার জীবনে এক অচেনা সন্ধ্যা নেমে এলো। যে সন্ধ্যার অন্ধকার বড় নিষ্ঠুর, বড় ভয়ঙ্কর। এক অনিশ্চিত জীবন তার জন্য অপেক্ষা করছে, এটা ভেবেই ছয়ফুল ম‍ূর্ছা গেল। ফুলেতন বিজ্ঞের মতো মইতনকে ডেকে বললো, ওই ছেরি দেখ ছয়ফুল মনে কয় দাঁত নাগছে, বেহুশ হইয়া গেছে। পানি ঢাইল্যা হুস ফিরা।

ঠান্ডু যেমন চটেছিল ঠিক তেমনি ঝিম মেরে গেলো। নিজের কৃতকর্ম না টাকার শোক তাকে পেয়ে বসলো তা সহসাই কেউ বুঝে উঠতে পারলো না। বারান্দায় খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো ঠান্ডু। মইতন কলসিতে ভরে পানি নিয়ে দৌঁড়ে গেলো ছয়ফুলের দিকে। তাড়াহুড়োয় পা পিছলে পড়ে গিয়ে পানি সমেত মাটির কলসিটি ভেঙে গেলো। উঠানময় ভাঙা কলসির টুকরা আর পানিতে একাকার হয়ে গেলো। ধাক্কা খেয়ে যে সাত্তারের বউ এতোক্ষণ চুপ ছিল সেই এবার কুয়ো থেকে পানি তুলতে কলসি নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। রসুল শুধু ধিরে ধিরে বললো, এইডা কাম করলা মিয়া। ছয়ফুল তোমার সংসারে একটা লক্ষ্মী আছিল। সংসারের যে কামডি মিয়া করতো, তোমার সঙ্গে তো ক্ষেতে যাইয়াও কাম করতো। দুই তিন পাড়ার মধ্যে ইমুন বউ আছেনি? এইডা কোনো কাম করলা, আমি তো কল্পনাও করবার পারি নাই। আমার মাতায় কিছু খেলতাছে না। ঝিম মাইরা গেলা ক্যা? এহন কি করবা? যুদি রাখপার চাও তইলে তো হিন্না (হিল্লা) বিয়া দিওন নাগবো। পানি ঢেলে ছয়ফুলের জ্ঞান ফিরে আসতেই চোখ মেলে আবার ছয়ফুল সজ্ঞা হারিয়ে ফেললো।  

বিকেল নাগাদ ছয়ফুলের ভাই সরকু মন্ডল গায়ের দুইজন মাতব্বর নিয়ে এসে ছয়ফুলকে নিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় ঠান্ডুকে শাসিয়ে গেছে এই বলে যে, ঠান্ডুকে সে দেখে নেবে। দুই একদিনের মধ্যেই সে সালিশ ডাকবে। নয়তো আদালতে মামলা করবে সরকু। ঠান্ডু কোনো উত্তর করেনি। ছয়ফুল যাওয়ার আগে আর একবার বুক চাপড়ে কেঁদে উঠেছিল। ঠান্ডুর দিকে তাকিয়ে বার দুই জিজ্ঞেসও করেছিলো, আপনে এই কামডা কিবা কইরা করলেন? এতো নিষ্ঠুর আপনে কিবা কইরা হইলেন? ঠান্ডু ছয়ফুলের দিকে তাকায়নি, সেই সাহস তার মন ও চোখে ছিলো না। ঠান্ডুর ভিতরটা মুচড়ে যাচ্ছিল তখন। মুখে না বললেও, উপস্থিত সবাই তা আঁচ করতে পারছিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বারান্দায় বসে পা দিয়ে উঠানের মাটি খুঁটছে ঠান্ডু। তার কোনো বিকার নেই। এখন বোঝা যাচ্ছে, ছয়ফুলকে তালাক দেওয়া যে তার অন্যায় হয়েছে সেটা সে অনুধাবন করতে পারছে। ছেলে নেই ঠান্ডুর, বড় মেয়ে জন্মানোর পর ছেলের আশায় বছর দুই আগে ছোট মেয়েটার জন্ম হয়েছে। স্বাস্থ্য আপা বলেছে, ছেলে নাই তো কি হয়েছে? মেয়েই এখন ছেলের কাজ করবে। পড়ালেখা শিখাও ঠান্ডু। সেই থেকে ছেলের আশা ছেড়ে দিয়েছে। বড়মেয়ে মামার বাড়ি থেকে পড়ছে। ছোটমেয়ে এখনও বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটতে চলছে। ধানের মৌসুমে ছয়ফুল একাই কাজ করে, বাড়ির কাজে কোনো মানুষ নেয় না। এমন কর্মঠ বউ যে ঠান্ডুর জন্য ভাগ্য ছিলো সেটা এখন সে বুঝতে পারছে। রাগের মাথায় যে কাজ করেছে তার জন্য ঠান্ডুর মধ্যে এক ধরনের অনুশোচনা কাজ করছে। ঠান্ডু মাটি খুঁটেই চলছে।

আচমকা মইতনের চিৎকারে ঠান্ডুর সম্বিত ফিরে এলো। উপস্থিত সবাই দৌঁড়াতে লাগলো রান্না ঘরের পেছনের দিকে। মইতন হাপাতে হাপাতে বলতে লাগলো ইন্দুরের গাতা থিকা ট্যাকার টুকরা বাইরোইতাছে। আল্লাগো ট্যাকা গুলান কিরহম কইরা কাইটা ফালাইছে গো। টাকার টুকরাসহ ইঁদুরের মাটি তখনও উঠছিলো। ঠান্ডুকে ডেকেছে অনেকেই কিন্তু ঠান্ডু সেই টাকার টুকরা দেখতে যায়নি। স্থির হয়ে বসেছিল আর পা দিয়ে মাটি খুঁটে যাচ্ছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার বেড়েই চলছিল। আজকের সন্ধ্যা ঠান্ডুর কাছে বড় অচেনা সন্ধ্যা মনে হলো। জীবনের কোনো সন্ধ্যার সঙ্গেই যার মিল নেই। কোমল সৌন্দর্যের সন্ধ্যা দানব হয়ে আজ তার জীবনে হানা দিয়েছে। আর তার জন্য সে নিজেই দায়ী। আরও একটু অন্ধকার বাড়লে ঠান্ডু উঠে দাঁড়াল। কাঁপা কণ্ঠে অসহায় গলায় রসুলকে ডেকে বললো, রসুল তুমি আমার লগে এট্টু যাবা? বিস্ময়, উদ্বেগ আর জিজ্ঞাসু ভরা কণ্ঠে রসুল পাল্টা প্রশ্ন করলো, কই যাবা ঠান্ডু? ঠান্ডু শুধু বললো, আহ আমার লগে। কুয়াশায় ঢেকে আসা চারপাশের নীরবতা ভেদ করে ঠান্ডু আর রসুল মসজিদের দিকে হাঁটতে লাগলো। মাওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করবে, কোনো উপায় আছে কিনা? দরকার পড়লে হিল্লে বিয়ে লাগলেও ঠান্ডু রাজি আছে। নির্বাক হেঁটে চলছে দুজন। ঠান্ডু আগে, রসুল পিছনে। টুপটাপ গাছের পাতায় শিশির ঝড়ছে। ঠান্ডুর মনে হলো, এ যেনো শিশির পতনের শব্দ নয়, এ যে তার ভিতরের কান্নার শব্দ। ছয়ফুলকে হারানোর শব্দ। বার দুই চোখ মুছে চুপচাপ হেঁটে চললো ঠান্ডু।    

যোগাযোগ

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ