ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

জুয়াড়ি | হানিফ মোল্লা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৭
জুয়াড়ি | হানিফ মোল্লা ...

থ্রি কার্ড খেলা চলছে নাবালক মিয়া বাইলেনের সেমি-পাকা ঘরের মধ্যে। বাইরে আকাশ কালো করে ঢিমে তালে গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে। আষাঢ় মাসের কান্না। জেদ ধরা বাচ্চা ছেলের মতো বায়না মেটার আগ পর্যন্ত থামার কোনো লক্ষণ নাই। এলাকার বাসিন্দারা নিম্ন আয়ের মানুষ। কুলি থেকে কাজের বুয়া, রিকশা চালক, সিএনজি ড্রাইভার, বন্দরের ডক শ্রমিক আর অফিস পিয়নদের জন্য যুতসই আবাসিক এলাকা।

এক কামরা দুই কামরার ঘরগুলাতে বৌ-বাচ্চা নিয়ে অনেকে থাকে। বেশিরভাগ ঘরের সাথে লাগানো টয়লেট নাই।

পাঁচ সাত পরিবারের জন্য একটা পায়খানা আর একটা অভিন্ন পাকঘর। বাসিন্দাদের অনেকের পরিবার আবার গ্রামের বাড়িতে। বেশিরভাগ ঘর মাসিক ভাড়ায় চলে। ঘরের মালিকেরাও এইসব দিনে মাঝে মাঝে জুয়াড়িদের সাথে বসে পড়ে মোনাজাতে। এরা জুয়া খেলার রূপক নাম দিয়েছে মোনাজাত। নেশাখোর যেমন গাঁজার নাম দেয় শাক-সবজি, ফেন্সিডিল সেবক যেমন আদর করে বলে মধু/মিষ্টি তেমনি জুয়া খেলার কালচারে এরা আদর করে লোকের কান ফাঁকি দিতে নিরাপদে ডাকে মোনাজাত। দুজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটলেও গায়ে গায়ে লেগে যায় এই এলাকার চিপা গলির সবগুলা হাঁটাপথ।  

কাশেম মোনাজাতের একজন পাকা হুজুর। পারতপক্ষে মন থেকে কেউ তাকে খেলায় নেয় না। কুত্তা ভাগ্য তার! হারতে হারতে ফতুর অবস্থা থেকেই সে কেমন করে যেন পাশার দান উল্টে দেয়। তবু মানব চরিত্রের অদ্ভুদ একটা ব্যাপার হলো, মানুষ যার সাথে হারে তাকেই সে বার বার চ্যলেঞ্জ করে যায় জিততে না পারা পর্যন্ত। সেই কারণেই হয়তো এখন পর্যন্ত কাশেম সময় পেলেই বসে পড়ে মোনাজাতে, তার আপাত সহজ সব প্রতিপক্ষের সাথে। কাশেমের বয়স চল্লিশের ঘরে। সে নিজেই তার বয়স নিয়ে সন্দিহান। তার মায়ের কাছে শোনা অনুযায়ী এই মাঘ মাসে তার বয়স চল্লিশ বেয়াল্লিশ কিছু একটা হবে।  

গরিব মানুষের জন্ম-মৃত্যুর তেমন গুরুত্ব নাই। এরা জন্ম নেয় চুপি চুপি মারাও যায় চুপিচুপি। মরণ নিয়ে কাশেমের ভয়-ডর নাই। সে কেবল ভয় পায় মোনাজাতের সময় যখন তার হাতে জুতসই কার্ড পড়ে না। মাঝে মাঝে উত্তেজনায় দম আটকে আসে। নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায় গভীর মনোযোগে। আর যখন তার হাতে ভালো ভালো কার্ড আসতে থাকে তার চোখের মণি জ্বলজ্বল করে ওঠে। বোর্ডের টাকা দুই হাতে মাটির মতো খাবলে ধরে তার সাদা লুঙ্গিতে জড়ো করে রাখে আর মনে মনে ভাগ্য দেবতাকে চুমু দেয়। সেই সময় তার ঠোঁটের কোনায় থাকে সিগারেট। খেলার উত্তেজনায় মাঝে মাঝে সিগারেটে টান দিতেই ভুলে যায়। অনেক্ষণ জ্বালানো সিগারেট না টানলে সেখানে প্রায় অর্ধেকটা ছাই জমে যায়। হঠাৎ দান পাওয়ার খুশিতে টানের সাথে সেই সিগারেটের ছাই ভেঙে পড়ে লুঙ্গির মাঝেই। সেই ছাইয়ে লুকানো আগুনের কণাতে তার লুঙ্গি পুড়ে যায় স্থানে স্থানে। ছোট ছোট কালো দাগ পড়ে লুঙ্গিতেই। সে এটাকেও তার ভাগ্যের অংশ মনে করে। তার বিশ্বাস যেদিন সে বাসি মুখে খালি পেটে খেলতে বসে সেদিন তার হাতে ভালো ভালো কার্ড আসে। আর সবচে বেশি আসে সেদিন, যেদিন খেলার মাঝখানে পিশাব আসে। রহস্য হলো পিশাব করে পানি নেওয়া যাবে না। নোংরা অবস্থায় খেলাতেই তার ভাগ্য।

পেশায় বছর কয়েক আগেও সে কাঠ মিস্ত্রি ছিলো। কাঠের গায়ে নানান রকম নকশা তোলার কাজ করতো কাশেম। সেই কাজে তার আয় রোজগার খুব বেশি না হলেও গ্রামের বাড়িতে থাকা তার পরিবার আর তার একা শহুরে জীবন কেটে যাচ্ছিল কোনো মতে। কোথা থেকে কী হয়ে গেলো সে নিজেই বুঝতে পারলো না। একদিন শখ করে টাকার বাজিতে লুডু খেলতে গিয়ে সে দেড়শ টাকা জিতে গেলো। সেই শুরু, এরপর সে মাস দুয়েকের মধ্যেই শিখে গেলো কল ব্রিজ, আমেরিকান ব্রিজ, টুয়েন্টি নাইন আরও নানান রকমের তাসের খেলা। পাঁচ ছয় মাসের মাথায় সে খেয়াল করলো মোনাজাতে বসে সে যে টাকা রোজগার করছে সেটা তার কয়েক মাসের বেতনের সমান। ধীরে ধীরে সে তার পেশার প্রতি মনযোগ হারায় আর মোনাজাতে আগ্রহী হয়। সে এখন পেশাদার জুয়াড়ি। গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠায় আগের মতো হিসেব করেই, কিন্তু তার জুয়াড়ি মন নানা রকম শখ আল্লাদে ভরে ওঠে। তার ঘরের মাঝে এখন চোদ্দ ইঞ্চি রঙ্গিন টিভি, সিডি প্লেয়ার, মাথার উপরে সিলিং ফ্যান। এইসব জোগাড় হয়েছে জুয়ার টাকায়। বাড়তি টাকার গরম মানুষকে নানানভাবে তাড়িত করে। সমাজে একটি প্রচলিত কথা আছে-পুরুষ মানুষ চেনা যায় টাকা থাকলে, নারী চেনা যায় টাকা না থাকলে।  

কাশেমের বাড়িতে বৌ-বাচ্চা আছে সেটা তার পরিচিত সবাই জানে। কিন্তু ইদানিং তার নজর পড়েছে মোনাজাতের সঙ্গি রফিকের সোমত্ত মেয়ের ওপর। তার ঘরের জানলা দিয়ে সে প্রায় দেখে মেয়েটাকে। নাম ফরিদা। বয়স ঊনিশ-বিশ। পুরুষের চিরকালীন বহুমুখিতার স্বভাবটা জুয়ার বাড়তি টাকার সাথে উঁকি দেয় এই মেয়েটাকে দেখলে। কলতলায় মেয়েটা যখন কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে হাড়ি পাতিল মাজে, তখন তার মেধহীন শরীরটা বেশ চুম্বকের মতো বেটা ছেলেদের টানে। কাশেম তখন নিজের প্রায় আধা হয়ে আসা যৌবনের ডাক টের পায় তার শরীরে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়ে গেলে লুঙ্গির ভেতর বিশেষ জায়গায় চুলকাতে চুলকাতে দু একবার বদ ইশারা ও দিয়েছে মেয়টাকে। কিন্তু সেটা ধোপে টেকে না। মাঝ বয়সি পুরুষ মানুষ তার উপর বৌ-বাচ্চা আছে। আর এই ধরনের ইশারা মা মরা গরিবের সুন্দর মেয়েকে সুযোগ পেলে রাস্তার ভিখিরিও দিতে ছাড়ে না। এসব নিয়ে ফরিদার কোনো রাগ-ক্ষোভ কিছুই নাই। অথচ কাশেমের নিজের প্রায় এই বয়সি একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছে। ফরিদার রিকশাচালক বাপ সংসার চালাতে হিমসিম খেলেও গরিবের ঘোড়া রোগের মতোই জুয়ার নেশা তাকে টানে। যেন ‘পোন্দে ত্যানা নাই ,মাথায় বাহারি পাগড়ি’। রিকশা চালিয়ে সে যে তিন চারশো টাকা পায় তার পঞ্চাশ টাকার মতো চা-পান, বিড়িতেই চলে যায়। মাঝে মাঝে শ’ খানেক টাকা ফরিদার হাতে গুঁজে দিয়ে মরিচ দিয়ে ভাত খেয়ে মোনাজাতে বসে পড়ে। মেয়েটা যে বিয়ের বয়স পার করছে এটা তাকে বাবা হিসেবে ভাবালেও টাকার অভাব তাকে সেই ভাবনা থেকে দূরে রাখে। জুয়া খেলা হেরোইনের নেশার মতোই। একবার যাকে পায় তার ভেদ বুদ্ধি আর বাকি থাকে না।

কাশেম, ফরিদার বাপ সহ আরো দুইজন আজ আবার সেই নাবালক মিয়া বাই লেনে মোনাজাতে মগ্ন। সেমিপাকা পুরাতন একটা ঘরের মধ্যে বিড়ি, সিগারেটের ধোঁয়ায় ভর্তি। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। থেকে থেকে হালকা হাতে তালি দেবার মতো তাস পেটার শব্দ আর থেকে থেকে দু একবার গুঞ্জন ওঠে, ফিস ফাস শব্দ হয়। বাইরে আকাশ আর পৃথিবী খেলছে আরেক জুয়া। সে খেলায় মাটির পৃথিবী বরাবরের মতো পরাজিত হয়। আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে ঠিক তবে আকাশ কখনো ভেজে না নিজে। খেলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফরিদার বাপের টাকা শেষ হয়ে যায়। সে অসহায়ের মতো কাশেমের দিকে তাকায়।  
-আমারে আর পাঁচশো টেকা ধার দাও কাশেম ভাই!
-না মিয়া, আগের ই তো চোদ্দ হাজার পাই। জমতে জমতে তুমি তো লাখ টেকা -ধার করবা দেখতাছি।
-দাও না মিয়া, দান পাইলে শোধ দিমু।
-হ, আমারে পাগল পাইছো! আইজ আর ধার দিতে পারুম না। তুমি বইয়া খেলা দেখো।

এর মধ্যে তিনজন মিলে খেলা চলতে থাকে। ফরিদার বাপ চেয়ে থাকে আর মাঝে মাঝে বলে দেও না ভাই। শোধ দিমু তো... আল্লার কিরা! কাশেম দুই দান হেরে যায়। সে কথায় কান দেয় না। তিন দানে এসেই কাশেম আবার একটা বড় দান পেয়ে বসে। ডাবল, রিডাবল, সিন, আনসিনের মারপ্যাঁচে দশ টাকার বোর্ড হয়ে যায় দুইশো টাকা। চোখের সামনে দশ বিশ পঞ্চাশ একশো টাকার নোটের একটা ছোট ঢিবির মতো। সবাইকে অবাক করে কাশেম তিন গোলামের জোরে জিতে নেয় সবটা। বাকিদের গলা থেকে ধুর, ধুত, বাল এই জাতীয় হতাশা ঝরে। জুয়ার এই এক নেশা যতো হারে ততোই জেদ বেড়ে যায় খেলার, আর জিতলে তো কথাই নাই!

ফরিদার বাপ সুযোগ বুঝে আবার ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। মুখের বিড়িতে তৃপ্তির টান দিয়ে কাশেম এইবার কি মনে করে বলে... দিতাম পারি... তবে তুমি তো শোধ দিতে পারবানা। তাও দিবো কিন্তু আমার একটাই আশা। তুমি তো রাজি হইবা না মিয়া।
-উৎসুক হয়ে ফরিদার বাপ বলে কী মিয়া কইয়া ফেলাও?
-না থাক, বাদ দাও। তুমি না বুইঝাই আমার লগে পরে রাগ করবা। তবে তোমারে আগের সব টেকা মাফ কইরা দিমু যদি রাজি থাকো। এইবার বাকি দুই জনও উৎসুক হয়ে ওঠে।
-আরে না না মিয়া কি কও? রাগ করমু ক্যা? কইয়া ফালাও।

কাশেম বোঝে এই সুযোগ। সে মনের কথাটা বলেই ফেলে কোন ভনিতা না করে। আমার সব টেকা আইজকাই ফেরত দিবা, আর নাইলে ফরিদারে আমি শাদি করতে চাই। লগে টাকাও দিমু। আর তোমার মাইয়া আমার কাছে সুখেই থাকবো।  

সবার মুখ হা হয়ে যায়। খেলার সঙ্গি স্থানীয় একজন হেসে ওঠে-চোদানির পোয়া ফওল অইগিয়ে... ফরিদার বাপেরে তুই চোদনা পাইওনা? কাশেম খেলার বিরতি পেয়ে পেশাব করতে চলে যায়। বন্ধ ঘরের মাঝে সবাই কেমন জানি থমকে যায়। সবাইকে আরও অবাক করে দিয়ে ফরিদার বাপ রাজি হয়ে যায় মাত্র বিশ হাজার টাকা নগদ আর আগের বাকি টাকা ফেরত না দেওয়ার শর্তে। এরপরের জুমার দিনে হুজুর ডেকে তাদের বিয়ে হয়ে যায়।

ঘটনা এইখানে শেষ হলেই ভালো হতো। কিন্তু সবচে বড় খেলোয়াড় তো আরও একজন আছে। সাত আসমান জমিনের মালিক। তার হাতে এখনো বড় অনেক কার্ড রয়ে গেছে। যোগাযোগের দুনিয়া এখন। এক টিপ দিলে দুনিয়ায় যে কোন জায়গায় খবর চলে যায়। কাশেম তার বিয়ের কথা চেপে গেলেও খবরটা কিভাবে যেন তার গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অথচ তার জুয়া খেলার খবর এখনো তার পরিবারের কানে ওঠে নাই। তার প্রথম স্ত্রী সে কথা শুনে আর বেশি দেরি না করে মাস খানেকের মধ্যেই ছেলে-মেয়ে নিয়ে একদিন বিকাল বেলা হাজির হয় নাবালক মিয়া বাই লেনে। একে-তাকে নাম বলাতেই লোকজন উৎসুক হয়ে আগ বাড়িয়ে কাশেমের ঘর দেখিয়ে দিলো। কয়েকটা চিপা গলি পার হয়েই কাশেমের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিতেই ফরিদা দরজা খুলে দিলো। শুরু হয়ে গেলো কেয়ামত, দুই সতিনে খিস্তি খেউড় আর চুলোচুলির যতটা করা সম্ভব তার সবটাই করলো। এইসব ঘটনা এই যায়গায় নতুন কিছু না। বড় ছেলে মেয়ে দুইটা কাছে দাঁড়িয়ে কেবল দর্শক। লোকজন আর পিচ্চি বাচ্চাদের একটা জটলা হয়ে গেল। যেন দুই মুরগির লড়াই দেখছে। কাশেম তখনো সেসব জানে না। মোনাজাত তার ধ্যান জ্ঞান! কেউ একজন এসে খবরটা দিয়ে গেলো। কিছু হয়নি এমন একটা ভঙ্গিতে- ওহ! শব্দটাই সে করলো। সেদিন-ই নানান ঝামেলার পর দুই সতিনের দুটি আলাদা সংসারের ব্যবস্থা করে দিলো লোকজনের একটা সান্ধ্য সভা।

বড় বড় দুটি ছেলে মেয়ে নিয়ে প্রথম পক্ষের বৌ এই নাবালক মিয়া বাইলেনে সংসার পেতে বসলো। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য সে আর কাশেমের হারাম টাকার ওপর নির্ভর করতে পারছে না। আর ইদানিং কাশেমের জুয়ার হাতের যশ কমে গেছে। আগের মতো জেতে না। দুইটা সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে তার জুয়ার টাকায় আর বরকত নাই। এজন্য সে তার নসিবকে দুষতে থাকে। প্রথম বৌয়ের ছেলেটার নাম আলী। দেখতে শুনতে একেবারে মন্দ না। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ালেখা আছে। গলির মুখের চায়ের দোকানে তাকে পেপার পড়তে দেখে দু একজন অবাক হয়েছে বটে, কিন্তু গ্রামের ছেলে হলেও যে সে বুদ্ধিতে কম না সেটা টের পেতে আরো কিছুদিন সময় লাগছে। কাকে কাকে যেন বলে কয়ে আলী একটা অফিসে পিয়নের কাজ জুটিয়ে নেয়। এর মধ্যে তার মা কোন এক বাসায় ঝিয়ের কাজ জুটিয়ে নিলে তাদের সংসার ভালোই চলে যায়। মাঝে মধ্যে দুই সতিনে বেকার ঝগড়া ছাড়া এখন সব প্রায় ঠিকঠাক।

একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আলী দেখলো মোড়ের চায়ের দোকানে প্রচুর লোকের জটলা। সে আগ্রহী হয়ে কাছে গিয়ে দেখলো ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। ভারতীয় আইপিএল। দোকানের ভেতরে একদল মানুষ হইহল্লা করছে। এই ওভারে দুই হাজার। এই বলে পাঁচশ। পরের বলে ছক্কা হলে দুইশ। এইভাবে বাজি চলছে খেলার তালে তালে। সে গ্রামে অনেক বার খেলা দেখেছে। তবে এইরকম বাজি ধরা দেখলো এই প্রথম। কয়েক ওভার খেলা দেখেই যা বোঝার বুঝে গেলো। ভালোই টাকার লেনদেন হচ্ছে এখানে। দু একজনকে তো পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে ফিরতে দেখা গেলো। সে ভাবে এতো কস্ট করে চাকরি করে আর কয় টাকাই পাওয়া যায়। এইখানে একটু বুদ্ধি করে বাজি ধরলেই বাজিমাত। পরের দু একদিন পরে সে নিজেই বাজি ধরতে শুরু করে। বাবার মতো জুয়াতে তারো কুত্তা ভাগ্য। প্রথম দিনেই সে হাজার চারেক টাকা কামাই করে ফেলে। এই যে মজা পেয়ে গেলো। এইবার রোজ রোজ খেলা দেখতে আসে আর একটার পর একটা বাজি ধরতেই থাকে। কখনো জিতে কখনো হারে কিন্তু রোজই সে লাভ না করে ফেরে না। এই করতে করতে বেশ কিছু টাকা সে জমিয়ে ফেলে। সেগুলো সে তার মায়ের কাছেই রাখে। এরি মধ্যে খেলার এই সিজন শেষ হয়ে যায়। মাস কয়েক পার হয়। তার বিয়ের যোগ্য বোনটির বিয়ের কথা শুরু হয়। এই বয়সী মেয়ে এই পরিবেশে ঘরে রাখা মুশকিলের ব্যাপার। এইটা কাশেম বোঝে বলেই মেয়ের জন্য একটা ছেলে ঠিক করে নেয়। এতে তার প্রথম স্ত্রী আর ছেলের আপত্তি থাকে না। উপরোন্তু কাশেম মেয়ের বিয়ের জন্য এক লাখ টাকা তার প্রথম বউয়ের হাতে দিয়ে আসে মেয়ের বিয়ে বাবদ। সে এতে নিজেকে তার কৃতকর্মের জন্য কিছুটা নির্ভার মনে করে। হাজার হোক নিজের মেয়ে। পাত্র পক্ষ বিয়েতে রাজি কেবল মাত্র এই কারণেই যে যেহেতু মেয়ের বাবা দুই বিয়ে করছে তাই মেয়ের বিয়ে সহজে হবার কথা না। তবে হবু বরকে যদি কালেমা পড়ার দিন লাখ খানেক টাকা দেয়া যায় তবেই এই বিয়ে হবে। কথা পাকাকাকি হয়ে যায় যে মাস দুয়েক পর একটা ভালো দিন দেখে বিয়ে হয়ে যাবে।

ইদানিং টেলিভিশন খুললেই খেলা আর খেলা। বাজার অর্থনীতির জাদু মন্ত্র, টাকা যেখানে আছে সেখানে সব কিছুই আছে। তারই ধারাবাহিকতায় শুরু হয়ে গেছে বিপিএল। গত কয়েকমাস ধরে লাগাতার বিজ্ঞাপন চলছে টিভিতে। আর এইদিকে নাবালক মিয়া বাইলেনের জুয়াড়িরাও মাঠের বাইরে তাদের প্রস্তুতি শেষ করেছে। এইবার নিজ দেশের খেলা। বড় বড় অঙ্কের টাকার বাজি হবে। দু একজন তো চুপিচুপি ঘরের গহনা বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করে রেখেছে। জব্বর খেলা হবে। গলির মোড়ের যে দোকানে বাজি হয় সেখানে এখন পুরাতন বাক্স টিভির বদলে চলে আসছে আটাশ ইঞ্চি ফ্লাট টিভি। আর কষ্ট করে ঝুঁকে পড়ে কত রান, কত উইকেট দেখতে হবে না। আলীর বোনের বিয়ের সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। টাকাপয়সা সব তার মায়ের বিছানার নিচে একটা ট্রাঙ্কের ভেতর জমা আছে। আলী এই তথ্য জানে। সে বোনের বিয়ের চেয়ে বেশি উৎসুক বিপিএল খেলা নিয়ে। তিনদিন আগে খেলা শুরু হয়ে গেছে। সে রোজ নিয়ম করে খেলা দেখতে আর বাজি ধরতে গলির মোড়ের দোকানে যায়। পাঁচ হাজার, দশ হাজার টাকার বাজির খেলা হচ্ছে এইবার। মনে মনে আশা বাঁধে, এই বার সে অনেক টাকা জিতবে। তার ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস অগাধ! প্রথম দুই দিনে তার বাজির দল হেরে গেলো। এতে তার মাসের বেতনের পুরো টাকাটাই গচ্ছা গেছে। সে মরিয়া হয়ে এদিক সেদিক ধার খুজতে লাগলো। কিন্তু একটা সামান্য অফিস পিয়নকে এই বাজারে কেই বা টাকা ধার দেয়। আলীর রাতের ঘুম-খাওয়া প্রায় হারাম হবার অবস্থা। তাকে বাজি ধরে জিততেই হবে। সেমিফাইনাল খেলা আজ। আলীর মেজাজ বোঝা যাচ্ছে না, সে খুব তেঁতে আছে। দোকানে মানুষের জটলা আজ অনেক বড় বাজি হবে। পরশু তার বোনের বিয়ে। সেদিনই ফাইনাল খেলা। যা করতে হবে আজকের মধ্যেই তাকে করতে হবে। প্রথম দশ ওভারে নব্বই রান হবে এই নিয়ে বাজি ধরে সে এরি মধ্যে বিশ হাজার টাকা গচ্ছা দিছে। সে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলো। এইবার তার দল জিতবে বলে লাখ টাকার বাজি ধরলো। দোকানের মধ্যে এইটা হই হই রব পড়ে গেলো। অনেক নাটকীয়তার পর শেষ বলে এসে আলীর বাজির দল এক রানে হেরে গেলো। খেলা শেষে বাজিতে যে জিতলো তার পয়সায় সবাই চা, সিগারেট খেলো। এরপর সবাই যে যার যার মতো চলে গেলো। আলী এখনো অসহায়ের মতো সেই দোকানেই বসে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। চোখ ভরা বেদনার জল। কিন্তু সে কাঁদতেও পারছে না। নিজের প্রতি তার খুব ঘেন্না হচ্ছে।

আলীর বোনের বিয়ে আজ। অথচ তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। তার বাবা কাশেম এই নিয়ে মহা বিরক্ত। বর পক্ষের জন্য সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। লোকজনের খাওয়া দাওয়া শেষ। বরের বাবা এদিকে বিয়ের কালেমার আগেই হাতে টাকা চায়। নাইলে এই বিয়ে হবে না বলে সে সাফ জানিয়ে দেয়। আলীর মা কাশেমকে জানায় তার দেয়া টাকাটা পাওয়া যাচ্ছে না। এইদিকে বরের বাবা টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। কই ভাই? আর কতক্ষণ। রাত তখন প্রায় বারোটা, বর পক্ষের লোকজন হাউকাউ করতে করতে বিয়ে না করেই চলে যাচ্ছে। অসহায়ের মতো অনেক চেষ্টা করেও কাশেম কিছু করতে না পেরে শেষে বরের বাবার পায়ে পড়ে গেলো। বরের বাবা অনড়। সে চিৎকার করে বলে ফেললো- কোনো জুয়াড়ির মেয়ের সাথে আমার ছেলে বিয়া দিমু না। এই সব ঝুট ঝামেলার ভিতরে একজন এসে বলে গেলো খাল পাড়ে কার যেন একটা লাশ পাওয়া গেছে, অন্ধকারে চেনা যাচ্ছে না। নাবালক মিয়া বাইলেনের এই পরিবারটি ছাড়া আর সবাই যে যার যার মতো রাতের ঘুম দিতে চলে গেলো। কাশেম নিজের অশেষ হতাশা নিয়ে কেবল একটা কথাই ভাবতে থাকলো– জীবন অবশেষে তাকে নিয়ে জুয়া খেলে গেলো!

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৭
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ