ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

সুতপা | নভেরা হোসেন

শিল্প-সাহিত্য ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৯
সুতপা | নভেরা হোসেন

ধানমন্ডি লেকের পারটা দিন দিন লোকে লোকারণ্য হয়ে যাচ্ছে। পুরান ঢাকার কিছু এলাকা যেমন লোকে গিজগিজ করে, পা ফেলার জায়গা থাকে না তেমন। রোজ সকালে এখানে হাঁটতে আসি খুব ভোরে, অফিসে পৌঁছাতে হয় নয়টার মধ্যে। ঘুম থেকে উঠতে হয় ছয়টায়। এক ঘণ্টা হেঁটে এসে গোসল সেরে নাস্তা, উবার ডাকা এসব করতে হয়। কখনও সাড়ে নয়টা বেজে যায়। পুনম সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসবা। অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে আসবা, কোনো টালটি-বালটি চলবে না, কোনো বন্ধু-ফন্ধু এসব চলবে না, যা করেছো বিয়ের আগে করেছো, এখন সেসব দিন ভুলে যাও। আর তোমার যেমন স্বভাব খালি মেয়েপ্রীতি, এসব বাদ দাও।

আমি যে সারাদিন ওই চিন্তায় বিভোর থাকি না, এটা পুনম কিছুতেই বুঝতে চায় না। ওর ধারণা অফিসে বসে আমি সারাদিন অনলাইন চ্যাট করি, না হলে লাঞ্চ আওয়ারে এক্স গার্লফ্রেন্ডদের সঙ্গে দেখা করি।

এটা যে খুব বেশি অসম্ভব তা নয়, আমার প্রাক্তন কাজলের বাসা অফিসের কাছেই। প্রথম প্রথম কাজল মেসেঞ্জারে দেখা করার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে, আমিই ওকে এভয়েড করেছি, বলেছি অফিসে কাজের চাপ। এছাড়া এখন আমরা যদি আবার দেখা করতে শুরু করি তাহলে সেটা আমাদের আবার কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে। কাজল আর আমার সম্পর্কটা হয়েছিল খুব ঝোঁকের মাথায়। তখন মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়েছে শহীদ মিনারের পাশে এনএক্স ভবনে। অঙ্কশাস্ত্রে পড়লেও আমার আগ্রহ ছিল লিটারেচারের প্রতি। প্রায়ই কলা ভবনে যেতাম, আড্ডা দিতাম ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদের সঙ্গে। কাজল জার্নালিজমে পড়তো ক্লাসের ফাঁকে আসতো হাকিম চত্বরে। ইংরেজির মামুন ছিল দারুণ স্মার্ট। মামুনের সঙ্গে কাজলের খুব বন্ধুত্ব। কাজল ছেলেদের সঙ্গে মিশতো খুব সাবলীলভাবে। তখনকার সময়ের ছেলে-মেয়েদের মেলামেশায় একটু দূরত্ব ছিল। বন্ধুত্ব হলেও দূরত্ব বজায় থাকতো। কাজল ছিল ব্যতিক্রম। টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত মেয়েদের মতো জীবনযাপন করতো না, চিন্তা ভাবনাতেও ছিল অগ্রসর, আধুনিক সাহিত্য ছিল ওর সঙ্গী, স্মোক করতো, ঘুরতো অনেক রাত পর্যন্ত। ওর কোনো বিশেষ বন্ধু ছিল বলে মনে হতো না। তখন খুব জার্মান কালচারাল সেন্টার আর এলিয়াস ফ্রাসিসে গিয়ে ছবি দেখতো অনেকেই। আমিও যেতাম মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে। ওখানেই কাজলের সঙ্গে প্রথম আলাপ, কফি রঙের একটা পাঞ্জাবি আর জিন্স পরা ছিল, খুব অ্যাডভান্সড। কিন্তু কেমন একটা বিষণ্নতা ঘিরে ছিল ওর চোখজুড়ে।

বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিল উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে আবার মাঝে মাঝে চুপ। দূরে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছিল। ইংরেজির মামুন কাজলের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। কাজল একটু হেসে ঘাড় নাড়লো, এরপর আবার দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি একটু যেচেই জানতে চাইলাম, কাজল আপনি কি ইংলিশের ছাত্রী? না জার্নালিজম, কাজল এতক্ষণে আমার দিকে একটু মনোযোগ দিলো।

আর আপনি?
আমি অঙ্কশাস্ত্র
শুনে কাজল কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম কেন ম্যাথের ছাত্র সিনেমা-টিনেমা দেখে না না-কি।
মুচকি হেসে কাজল বললো, না ম্যাথে আমার খুব এলার্জি। সবসময় ম্যাথকে এড়িয়ে চলেছি।

এরপর কাজলের সঙ্গে বহু কথা চলতে লাগলো। কাজলের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ওর স্বপ্ন সব একটু একটু করে আমার স্বপ্নের অংশীদার হয়ে উঠলো। এভাবে কয়েক বছর চললো। কাজল আর আমি একদিন না দেখা করে থাকতে পারতাম না। কাজল চমৎকার সব কবিতা লিখতো, ওর লেখার হাতটা দারুণ, একদম ফরাসি বোহেমিয়ান কবিদের মতো। বহুদিন আমরা শুধু কবিতা পড়ে কাটিয়ে দিতাম, ওই সময় ওর একটা বইও বেরিয়ে গেছে, এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করে ফেলেছিল সেসময়। কিন্তু সেই সময় একটা এক্সিডেন্ট ঘটলো। কাজলের মা স্ট্রোক করলেন। ওকে খুলনার বাড়িতে ডেকে পাঠানো হলো। কীভাবে কী হলো জানি না, খুলনা যাওয়ার পর কাজলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। হঠাৎ রাস্তায় কাজলের মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। ছেলেটি বললো খুলনা যাওয়ার পর কোনো এক ডাক্তার ছেলের সঙ্গে ওর আকদ হয়েছে। কাজলের মা অসুস্থ অবস্থায় মেয়েকে ডেকে নিয়ে এ বিয়ের আয়োজন করেন। কাজল পরে ঢাকায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করে বলে, ও যাওয়ার আগেই বাড়িতে সব ব্যবস্থা করা ছিল, ওর কথা কেউ শুনছিল না, কাজল ওর বড় বোনকে আমার কথা বলে, কিন্তু এরকম একজন ফুলটাইম বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কথা ওরা চিন্তাও করতে পারে না। কাজল যখন ঢাকায় এসে আমাকে ওর বিয়ের কথা বললো, তখন ওকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল। এতদিনকার চেনা কাজল যেন মুহূর্তে বদলে গেছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল না। ওর কাছে পারিবারিক মূল্যবোধ এত বড় আমার কল্পনাও ছিল না। ও কেন নিজের মতামতটা প্রতিষ্ঠা করতে পারলো না আমার বোধগম্য নয়। একটা খবর পর্যন্ত জানালো না। আমি জানলে ওর বাড়িতে গিয়ে কথা বলতাম।

যাইহোক এরপর বহু বছর প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছি। বায়িং হাউসে চাকরি নিয়ে চুপচাপ দিন পার করেছি। কাজলের ব্যবহার আমাকে বিমূঢ় করে তুলেছিল। দিন-রাত সিগারেট খেতাম, ড্রিংকসও করতাম প্রচুর, একটু বেপরোয়া জীবনযাপন করতে লাগলাম। কাজল মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতো। আমি এভয়েড করতাম। কারণ কাজল ছিল আমার কাছে একটা নেশার মতো। ওকে যত পান করতাম, ততই তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠতাম। এটা এমন নয় যে শুধু শারীরিক, কাজলের সঙ্গে কথা বলতে দারুণ আকর্ষণ বোধ করতাম, ওর প্রতিটা ভঙ্গির একটা বাঙময় রূপ ছিল। এটা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। নিজের মনের মধ্যে হাহাকারের পাহাড় জমে উঠছিল। একটা মানুষ অবলীলায় আরেকটা মানুষকে ছেড়ে চলে যেতে পারে, দিনের পর দিন বছরের পর বছর একই চিন্তা, একই অনুভূতি শেয়ার করে হঠাৎই আতশবাজির মতো মিলিয়ে যেতে পারে এটা ভাবা যায় না।

যাইহোক এসব নিয়ে এখন আর ভাবতে চাই না। পাস্ট ইজ পাস্ট অ্যান্ড পাস্ট ফরএভার। কিছুদিন ধরে অফিসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত, ছোটাছুটি করতে হচ্ছিল। এরমধ্যে হঠাৎ একদিন মেসেঞ্জারে খুব বিষণ্ন অবয়বের একজনের মেসেজ পেলাম। মেয়েটির চল্লিশোর্ধ চোখের নিচে কালি, ইনসমনিয়ার ছাপ। একদম অচেনা।

- শুভেচ্ছা, কেমন আছেন?
- ভালো, আপনি?
- তেমন একটা না।
- কেন কী হয়েছে? এভাবেই কথার শুরু...

সুতপা রোজ ঠিক দুপুর তিনটার দিকে মেসেঞ্জারে আসে, ওই সময় আমিও অনেকটা ফ্রি থাকি।
- সুতপা আপনাকে সবসময় এত ক্লান্ত লাগে কেন?
- ক্লান্ত লাগে? রাতে আমার ঘুম হয় না, রাতের পর রাত জানালা দিয়ে কালো আকাশ দেখি।
- কোনো ওষুধ খান না?
- হুম খাই, তবে খেলেও অনেকসময় কাজ করে না, তখন বই পড়ি, গান শুনি। বাথটাবে শুয়ে থাকি সাবানের ফেনার ভেতর।
- কেন আপনার হাসবেন্ড কোথায়?
- ওতো বেশিরভাগ দিনই বাসায় থাকে না, হয় বিজনেসের কাজে দেশের বাইরে, নাহলে ঢাকার বাইরে। এমনকি ঢাকায় থাকলেও গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে সোনারগাঁ বা অন্য কোথাও...
- আচ্ছা তখন আপনি এভাবে বাথটাবে পানির মধ্যে শুয়ে থাকেন?
- হুম, আমি খুব লোনলি, একাকিত্ব ঘোচাতে প্রচুর ড্রিংক করি, একমাত্র এই বিষয়টা আমাকে কিছু সময়ের জন্য সমস্ত ডিপ্রেশন, না পাওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
- কিন্তু তাতে কী লোনলিনেস কাটে?
- কাটে কি-না জানি না কিন্তু কিছু সময়ের জন্য নিজেকে অনেক হালকা লাগে, ভারমুক্ত লাগে।
- আপনার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই? যারা আপনাকে সময় দিতে পারে বা আপনার সন্তান?
- আমার কোনো ইস্যু নেই। আমরা কোনো চাইল্ড এডপ্ট করিনি। আমার ইচ্ছা ছিল বাট শফিক চায় না। ওর ধারণা অন্যের সন্তান কখনও নিজের হবে না। আর প্রোপার্টি নিয়ে ঝামেলা হবে।
- ও আচ্ছা বুঝলাম। আর বন্ধুবান্ধব? তারাও কী সব আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে?
- না তা যায়নি। কিন্তু কী জানেন বিপ্লব একসময় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষও অচেনা হয়ে যায়। সবাই যার যার পেরিফেরিতে চক্রাকারে ঘুরছে। একজন বন্ধুর লোনলিনেসকে ধারণ করার মতো মেন্টাল স্ট্যাটাস খুব কম জনেরই থাকে। ইউনিভার্সিটির বন্ধু করবী আমাকে অনেক ভালো বুঝতে পারে, ওর সঙ্গে শেয়ারিংটা দারুণ কিন্তু এখন ও কানাডায় সেটেল করেছে, বছরে একবার আসে। কথা হয় মেসেঞ্জারে নিয়মিত বাট...
- হুম কিন্তু কোনো ছেলেবন্ধু নেই আপনার? যে আপনাকে সময় দিতে পারে, কথা বলতে পারে, আপনিতো বেশিরভাগ সময় একাই থাকেন।
- না এখন তেমন কেউ নেই। একসময় ছিল। বিয়ের পরপর যখন শফিকের লাইফস্টাইল ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, প্রায়ই আমাদের কাঁঠালবাগানের বাড়িতে যেতাম। শফিক তখন স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্তে।

যাইহোক তবুও চলছিল একটু একটু করে।

এভাবে মেসেঞ্জারে সুতপার সঙ্গে কথা চলছিল, শুইয়ে সুতো গাঁথার মতো পরস্পর জড়িয়ে পড়ছিলাম, কেউ যেন কাউকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়তে পারছিলাম না। সুতপা একটু একটু করে তার ইচ্ছার কথা বলতে শুরু করলো। প্রখর রোদে সমুদ্র স্নান দুজনে একসঙ্গে, যেন একটাই শরীর, সুতপার হাতের মধ্যে আমার হাত, পায়ে পা, ঠোঁটে ঠোঁট, একটু একটু করে পান করছি সুতপার বাদামি ঠোঁট, জিভের মধ্যে জিভ, অগাথ সমুদ্রে মন্থন, একটু একটু করে জেগে উঠছি, যেন বহু বছরের ঘুমন্ত ড্রাগন জাগছে, সুতপা ওর চুম্বক টানে আমাকে ঘোরগ্রস্ত করে তুললো। অফিসে যতক্ষণ থাকি, কথা বলতে থাকি। কখনও সে আমাকে গভীর অরণ্যে নিয়ে যায়, কখনও সমুদ্রের গভীর তলদেশে, একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে কতটা ভালো লাগায় আচ্ছন্ন করতে পারে, তা সুতপার সঙ্গে পরিচয় না হলে জানতে পারতাম না, সুতপার রাত জাগা চোখের ভেতর একটা অজানার হাতছানি যেন সে এখানকার কেউ না, কখনও তাকে জিপসি মেয়ে মনে হয়, যে নিজের খেয়াল-খুশি মতো পাহাড়ে ঘুরছে, কখনও মৌনব্রত পালনকারী এক সন্ত। ও নিজেকে ফুলের পাপড়ির মতো আমার কাছে মেলে ধরেছে কিন্তু এ ফুল আমার অচেনা, ভয় হতো হয়তো এই ফুলের গন্ধ নিতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো নয়তো পরিচিত গণ্ডি থেকে ছিটকে পরে যাবো মহাশূন্যতায়। অফিস ছুটির পর নানা কফি শপে দেখা হতে লাগলো। তারপর একদিন সুতপা তার বাড়িতে নিয়ে গেলো। সুন্দর ছিমছাম ফ্ল্যাট। উত্তরা লেকভিউ রোডে। সারাবাড়িতে একটা অচেনা ফুলের গন্ধ। সুতপা চা বানিয়ে খাওয়ালো।

- তুমি এখন আর কিছু খাবে?
- না।
- কেন অফিস থেকে আসছো ক্ষুধা পায়নি?
- না।
- আমার পেয়েছে। দুপুরে ঠিকমতো লাঞ্চ করিনি, চলো পাস্তা রান্না করি।

সুতপার কিচেনে গেলাম, একটু এলোমেলো কিন্তু ওর রান্না করা পাস্তা অসাধারণ, দুজনে গ্রোগ্রাসে খেলাম। সুতপা ওর বেডরুমে আমাকে নিয়ে গেলো, ধবধবে সাদা বিছানা, জানালায় নীল পর্দা, বিছানায় পর্দার শেড পড়েছে। ফ্রিজ থেকে ওয়াইন নিয়ে এলো সুতপা। দুজনে একটু একটু করে পান করতে লাগলাম। দুজনের মোবাইল সুইচড অফ, সারা পৃথিবী থেকে আলাদা। বাথরুমে বিশাল বাথটাব। বাথটাবে লিকুইড সোপ দিয়ে শুভ্র ফেনা তৈরি করলো সুতপা, তারপর দুজনে সেই বাথটাবে অবগাহন, হাতে ওয়াইনের গ্লাস। দুজনে উন্মাদ হয়ে উঠলাম, পস্পরকে পান করতে লাগলাম। সুতপার জমাট স্তনে আমার ঠোঁট, সুতপা কেঁপে কেঁপে উঠছিল, যেন এক আদিম ভাস্কর্য। সুতপা আমাকে বাস্তব পৃথিবী থেকে ভিন্ন এক পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। এই পৃথিবীতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো বিশাল বিশাল বৃক্ষ, নিশাচর ঘুরে বেড়াচ্ছে গভীর অরণ্যে, সেখানে সুতপা আর আমি উড়ন্ত সসারে করে পরিভ্রমণ করছি। উপর থেকে দেখা পৃথিবীকে অনেক ছোট আর মিনিয়েচারের মতো লাগছে। ওর সঙ্গে সম্পর্কটা সাধারণ প্রেমকে ছাড়িয়ে অন্য এক মাত্রায় চলে গেলো। যা বন্ধুত্ব-প্রেম আর পারস্পরিক বিনিময়ের এক যৌথতা। প্রথাগত সম্পর্কের বাইরে এক ভিন্ন ধরনের অবয়ব।

মানুষ যখন বাস্তবে থেকে তার বাইরে ঘুরে বেড়ায় সেটা অন্যেরা অনেকটাই বুঝতে পারে। পুনম আমার আচরণে অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করলো, বার বার জানতে চাইলো কী হয়েছে?

অফিসে কোনো সমস্যা বা অন্য কোথাও? আমি হু না টাইপ উত্তর দিয়ে পুনমকে থামাতে চাইতাম। দিন দিন এমন হলো পুনমের বিষয়ে সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। বিশেষ করে আমার বিষয়ে ওর অধিক কৌতূহল বিরক্ত করে তুললো। অফিস শেষে বেশিরভাগ দিন সুতপার সঙ্গে কাটাতে লাগলাম। সুতপার হাসবেন্ডের অনুপস্থিতিতে ওর বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম। পুনম ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলো, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে অভিযোগ জানাতে লাগলো এবং যতক্ষণ ওর সঙ্গে থাকতাম পাগল করে তুলতো, একবিন্দু শান্তি ছিল না, যতক্ষণ সুতপার সঙ্গে থাকতাম ততক্ষণ সব আনন্দ, ভালোলাগা...

একদিন পুনম ছুরি নিয়ে নিজের গলায় ধরে বললো আমি যদি না বলি সব কথা সে আত্মহত্যা করবে, নিরুপায় হয়ে তাকে বললাম। একজন কেউ আমার জীবনে এসেছে, তাকে বাদ দেওয়া সম্ভব না, কিন্তু পুনমের জীবনকে আমি বিপদগ্রস্ত করতে চাই না। আমরা যেমন আছি তেমন থাকবো, তাকে ছেড়ে যাবো না। আমার কথা শুনে পুনম ঘরের দরজা বন্ধ করে রইলো সারারাত, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে অফিসে গেলাম, সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে, মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রনা। সুতপার মেসেজের কোনো উত্তর দিলাম না, ওর ফোন কেটে দিতে লাগলাম। এসব করে নিজের প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রনা হতে লাগলো। এভাবে কয়েকদিন কাটালাম, ঘরে ফিরে চুপচাপ ড্রয়িং রুমে বসে থাকতাম, টেলিভিশন চলছে, রিমোট নিয়ে অনবরত চ্যানেল বদলাচ্ছি, কিছুই দেখছি না, পুনম বেডরুম থেকে বের হচ্ছে না, বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে পুনমকে অনেক ডাকাডাকি করলাম, পুনম অগ্নিমূর্তি নিয়ে সামনে এসে যা ইচ্ছে বলে আবার বেডরুমে চলে যাচ্ছে...

রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে অফিসে চলে যেতাম খুব সকালে, নিজেকে সময় দিতে চাইলাম, বাস্তবের পৃথিবী কী, কেমন বুঝতে চাইলাম। এমনকি সুতপাকে ভুলে থাকার জন্য কাজলের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। কাজলের সঙ্গে দেখা করলাম অফিসের পাশে এক রেস্তোরায়। কাজল কেমন বদলে গেছে। ওর চৌকস মেধাবী বোহেমিয়ান রূপটি আর নেই, কেমন যেন বদলে গেছে, খুব অচেনা লাগছিল, চেহারায় চোখে-মুখে একটা বিলাসিতার ছাপ, পোশাক-আশাক বদলে গেছে, অনেক অলংকৃত । কাজল বললো, বিপ্লব তোমার ওয়াইফকেতো আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে না। আমি বললাম তাতে কী তোমার ভালো লাগতো?

-কেন লাগবে না। তোমার পার্টনারকে আমি খুব কাছ থেকে দেখতে চাই, সে তোমাকে কেমন ভালো রেখেছে বুঝতে চাই। আমিতো ভেবেছিলাম আমার জন্য তুমি আজীবন ব্যাচেলর হয়ে থাকবে, হা হা হা... এই তোমার প্রেম? আমি না হয় নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছি, তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি, কিন্তু তুমিতো দেবদাস হয়ে বসে থাকোনি... হা হা হা...
- এসব কথা থাক তুমি কেমন আছো বলো?
- আমি খুব ভালো আছি, আমার হাসবেন্ড আমাকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। আগে ভাবতাম টাকা-পয়সার কোনো মূল্য নেই, কিন্তু এখন বুঝতে পারি ওটাই আসল, আমার সব কমফোর্টের ব্যবস্থা করেছে জামিল। ওই সময় মায়ের চাপে তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার ডিসিশনটা ভুল ছিল না...
- হুম তোমার চাকরি কেমন চলছে?
- ভালো, গত মাসে থাইল্যান্ডে গেলাম অফিসের কাজে।
- বাহ্, শুনে খুব ভালো লাগলো, আমি চাই তুমি তোমার মতো করে বাঁচো, তোমার যে একটা চমৎকার মন ছিল, ক্রিয়েটিভ একটা জগৎ ছিল তাকে তুমি যত্ন করো....
- ধুর ওসব এখন আর পোষায় না, মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে, সংসার সামলে, বাচ্চাকে সময় দিয়ে এখন আর অন্য কোনো বিষয়ে আমার মনোযোগ নেই, ইনফ্যাক্ট সাহিত্য -টাহিত্য এখন আর আমার ভালোও লাগে না, সস্তা প্যানপ্যানানি মনে হয়। ট্রাশ মাল।
- সে কী, কেন?
- কেন আবার আই হেট মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট, সাহিত্য, আর্ট-কালচার এসব ওরাই করে বেশি। এরচেয়ে শপিংমলে ঘুরে বেড়াতে, শপিং করতে ভালো লাগে, কোনো রিসোর্টে গিয়ে সময় কাটাতে ভালো লাগে, ইফ ইউ হ্যাভ মানি ইউ ক্যান বাই এনিথিং, ইভেন লাভ, পুরো দুনিয়া তোমার পেছন পেছন ঘুরবে, ইউ ডোন্ট নিড টু রিড পোয়েট্রি ফর ইমাজিনেশন, দে কাম ইজিলি...
- হুম বুঝলাম, তুমি অনেক চেঞ্জ করেছো। কিন্তু এই তুমিটাই কী আসল তুমি?
- আসল তুমি? সেটা আবার কী? এমন কিছু আছে না-কি? এসবতো গত শতকের চিন্তা-ভাবনা, তোমার এসব এখনও আছে? আজব বায়িং হাউসে চাকরি করে আর ওয়াইফের পায়ে তেল মালিশ করে মাথায় সব বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট গিজগিজ করছে ... রিডিকুলাস...
- হুম করছে, তাতে তোমার কী?
- আমার আবার কী, আই ডোন্ট লাইক ইট এট অল...

কাজলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মন বেশ অস্থির হয়ে উঠলো, যাকে ভালোবাসতাম, চাইতাম, কামনা করতাম, সে যেন আর নেই, কোথাও নেই। সে অনুভূতিও নেই, তীব্র একটা অর্থহীনতা গ্রাস করলো, আর কোনোদিন কাজলের সঙ্গে দেখা হোক চাই না... ও ভালো থাকুক, অথবা খারাপ থাকুক, যা ইচ্ছা তাই হোক আর জানতে চাই না। মস্তিষ্ক থেকে ইরেজার দিয়ে ঘষে তুলে ফেলতে চাই সব স্মৃতি। ভালো লাগা, খারাপ লাগা... না তার হয়তো দরকার হবে না, সময়ই তা নিজের মতো করে বদলে দেবে...

অফিস করতেও ভালো লাগছিল না, অসহনীয় এক অবস্থা, ঠিক করলাম রাঙামাটি যাবো। পুনমকে বললাম অফিসের কাজে চিটাগং যাচ্ছি। সে এখন আর আমাকে একবিন্দুও বিশ্বাস করে না, বললো যাও প্রেমিকাকে নিয়ে কক্সেস বাজারে গিয়ে হানিমুন করে আসো...

সুতপা হাজার বার আমাকে ফোন করেছে। মেসেজ দিয়েছে, কোনো উত্তর দিইনি। নিজেকে স্টুপিড মনে হচ্ছে, কী করছি এসব? ওকে এমন কষ্ট দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না, নিজের সঙ্গে ওকে জড়িয়ে এখন এড়াতে চাইছি কিন্তু কেমন যেন জড়ভড়ত লাগছে। পুনমের আর্তচিৎকার, সুতপার প্রেম সব আমাকে ভারসাম্যহীন করে দিয়েছে, নিজের মতো করে কিছু ভাবতে পারছি না, আমার মধ্যে দৈত্ব সত্ত্বা কাজ করছে। চাইছি পুনমের জায়গায় পুনম থাকুক, সুতপার জায়গায় সুতপা, সবাই আলাদা। দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক আলাদা, কিন্তু এটা সত্য পুনমের সঙ্গে আমার জীবন ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে, হাঁপিয়ে উঠেছি, এখন মনে হচ্ছে চিন্তা-ভাবনা না করে পুনমেরে সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। ওই সময় কাজলের জন্য ভয়ঙ্কর মনোবেদনা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য হঠাৎই কলিগের বোনকে বিয়ে করে ফেললাম, তেমন ভালো করে কথাও বলিনি দুজন। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই দুজনের মধ্যে এতবেশি ভিন্নতা আর টেস্টের পার্থক্য, একসঙ্গে থাকাটা দায় হয়ে উঠেছে। পুনম নিজেও সেটা বোঝে, কিন্তু আমি ছাড়া আর কিছু ভাবার মতো অবস্থায় সে নেই।

সুতপা আমার সেই শূন্যতাটা পূরণ করছে। কাজলকে না পাওয়ার হাহাকার সুতপার মধ্যে দিয়ে কিছুটা রিপ্লেসমেন্ট হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে হুটহাট সব সিদ্ধান্ত
নেওয়াটা কাল হয়ে উঠেছে, পুনমকে না জেনেই ওর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছি, এখন তাল মেলাতে পারছি না। আর সুতপার বিষয়টা সমস্ত শরীর-মনকে আচ্ছন্ন করেছে। ওকে হারাতে চাই না। এতদিন যোগাযোগ না করায় নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছে। সুতপার জন্য একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে বুকে। তবু ওকে ফোন করলাম না। রাঙামাটি পৌঁছে দো-চোয়ানি কিনে আনলাম চাকমাদের এক আস্তানা থেকে। টানা সাত দিন ওখানে থাকলাম, মোবাইল, মেসেঞ্জার সব বন্ধ। অফিসে জানিয়ে দিয়েছি ব্যক্তিগত প্রয়াজনে সাত দিনের লিভ। বস একটা কড়া মেইল দিয়েছেন, তার উত্তর দিইনি। এই কদিন সব বন্ধ করে রেখেছি। এই চাকরিটাও ভালো লাগছে না চেঞ্জ করবো, জীবনে কখনও কখনও সব বদলে ফেলার প্রয়াজন হয়, নিজেকেও পরিবর্তন করা দরকার হয়ে পড়ে। যদিও তা সম্ভব হয় খুব কম।

রাঙামাটিতে পর্যটনের মোটেলে দুজন সুদানিজের সঙ্গে পরিচয় হলো, ওদের সঙ্গে কাপ্তাই লেক ঘুরলাম। চাকমা রাজাদের বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে, শুধু পানির মধ্যে একটা উঁচু থামের মতো দেখা যাচ্ছে। এখানে একদিন জনপদ ছিল, রাজ্য ছিল, রাজা ছিল, রানি ছিল আজ সব কালের গর্ভে। মানুষের জীবনেও এমন সব জমজমাট থাকে, প্রাণ থাকে, প্রাণের স্পন্দন থাকে, হাসি-আনন্দ-বেদনা... একসময় সব কোথায় হারিয়ে যায়, আবার নতুন করে তাকে সব তৈরি করে নিতে হয়, খুঁজে নিতে হয়।

সুদানিজ ছেলে দুটো চরস খেয়ে ওদের ভাষায় গান শোনালো, এর অর্থ হচ্ছে-

সময় তুমি বয়ে যাও
কখনও ফিরে আসো না
আমি ঠিক তোমার মতো
কখনও পেছনে ফিরি না
সময় তুমি বয়ে যাও
কখনও ফিরে আসো না
আমি ঠিক তোমার মতো...
পরিব্রাজক
আমি…

বেশ ভালো লাগলো ওদের গান, ওদের চিন্তা-ভাবনা। একসঙ্গে ঢাকায় ফিরলাম। যাত্রাবাড়ী এসে মোবাইলের সুইচ অন করলাম। টিং টিং শব্দ এলার্ট, মেসেঞ্জার একসঙ্গে সব বাজতে শুরু করলো, সুতপা একটা লম্বা চিঠি লিখেছে...

বিপ্লব
কেমন আছো তুমি? গত কয়দিন তোমাকে হাজার বার ফোন করেছি, মেসেজ দিয়েছি, এমনকি তোমার অফিসে গিয়েছিলাম। তুমি ঢাকায় নেই, চিটাগংয়ে। কিন্তু আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করলে কেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তোমাকে অনেক মিস করছি, যন্ত্রনা হচ্ছে, ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে বাট আই থিঙ্ক ইউ আর ডুইং দিস থিং উইশিংলি, সো ডোন্ট ওয়ান্ট তো বদার ইউ, নিশ্চয় এর কোনো কারণ আছে, তোমার নিজের মতো সময় কাটাও, জানি এই অল্প সময়ে আমরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি। হয়তো এই বিষয়টা তোমার জন্য অনেক অন্যরকম, আমি নিজেও খুব অদ্ভুত সময় কাটাচ্ছি। এত বছর পর হঠাৎ করেই জীবন যেন গিরগিটির মতো রং বদল করলো। একটা কেমন সবুজ আর কালোর মিশ্রণ, জলরঙে আঁকা, জল ঢেলে দিলে মিলিয়ে যাবে। ওয়াশ আউট। আমি একে কোনো ভাষা দিয়ে বুঝতে পারছি না। ভাষার অতীত, এটাইতো অনুভূতি। হয়তো লিখতে পারলে দারুণ কিছু লিখতাম। কিছুদিনের জন্য টরেন্টো যাচ্ছি, ছোটবোনের ওখানে। তুমি ভালো থেকো, তোমাকে ভালোবাসি, তাই হারাবার কিছু নেই। তোমাকে আমার নিজের মধ্যে পেয়েছি, আমার ভালো বন্ধু, সহযাত্রী... দেখা হবে ফিরে আসার পর, আদর।
সুতপা

সুতপার চিঠিটা পড়ার পর মনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো এক মুহূর্তে, তাইতো আমি কেন এত অস্থির হচ্ছি? নিজে যা অনুভব করছি, তাতো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, তা একান্তই নিজের। নিজের মধ্যেইতো বেঁচে থাকার অর্থ প্রোথিত, আর চারপাশের সবাই তার অনুষঙ্গ।

বাস থেকে নেমে উবার নিয়ে বাসায় আসলাম। পুনম ঘুমিয়েছিল, এত রাতে আমাকে দেখে অবাক হলো, ওভেনে খাবার গরম করে দিলো, ভাত খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলাম। যেন কতকাল ঘুমাইনি, সব ক্লান্তি চেপে ধরেছে। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমালাম, জানালা খুলে দিতেই হঠাৎ একরাশ কড়া রোদ এসে চোখে পড়ছে। যেন অনেকগুলো সার্চলাইট একসঙ্গে খুঁজছে আমাকে...

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৯
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ