বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। আগামী ২৬ অক্টোবর বাফুফে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আজ নমিনেশন জমা দেওয়ার শেষ দিনে তিনি নিশ্চিত করেছেন নির্বাচনে লড়াই করার বিষয়ে। ক্রীড়াঙ্গনে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সমাদৃত এই ব্যক্তির নিকট বেশ কিছু ফেডারেশন এবং আয়োজকরা প্রতিশ্রুত অর্থ পাওনা আছেন বলে জানিয়েছেন।
শুরুতে সভাপতি পদে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তরফদার। বাফুফের বর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন নির্বাচন না করার ঘোষণা দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ওই পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। তবে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল সভাপতি পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ার পর নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তরফদার। সিদ্ধান্ত নেন সিনিয়র সহসভাপতি পদে নির্বাচন করার।
এর আগে ২০২০ সালেও সভাপতি পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন তরফদার রুহুল আমিন। এবারও সভাপতি পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। এর ব্যাখ্যায় তরফদার বলেন, ‘ফুটবলের জন্য কাজ করতে চেয়ারে বসতে হবে এমন কোনও কথা নেই। বাইরে থেকেও ফুটবলের জন্য কাজ করা যায়। ’
তবে ফুটবলের মসনদে বসার ইচ্ছা তার শুরু থেকেই। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের খুশি করে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের এই কর্ণধার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রায় তিন বছর কাড়ি কাড়ি টাকা বিলিয়েছিলেন ফুটবল অঙ্গনের মানুষদের কাছে টানতে। সেটা ২০২০ বাফুফে নির্বাচনের আগের ঘটনা। তবে কাজী সালাউদ্দিন তাকে নির্বাচনের মাঠেই নামতে দেননি।
এবার অবশ্য সেই চাপ নেই বলে সন্তুষ্ট তরফদার। তিনি বলেন, ‘কাজী সালাউদ্দিন নির্বাচন করছেন না এটা একটা ভালো খবর। আমরা আগের কমিটির কাউকেই চাই না। আমরা নতুনদের নিয়ে ভালো কাজ করে এগিয়ে যেতে চাই। ’
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর পতন হয় ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকারের। আওয়ামী আমলে নেতাদের ম্যানেজ করে ব্যবসার বিস্তার ঘটান তরফদার। দেশের তিন সামুদ্রিক বন্দরে একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়ে প্রচুর টাকার মালিক বনে যান তিনি। তার প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড চট্টগ্রাম বন্দরে ঢুকেছিল কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে নিয়োজিত যন্ত্রপাতি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সেই প্রতিষ্ঠানটিই চট্টগ্রাম ছাড়াও আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবসার বিস্তার ঘটায়।
চলতি বছর জুনে তিনটি বন্দরে বড় কাজ পেয়ে যান তরফদার রুহুল আমিন। শেখ হাসিনাকে খুশি করতে জাতীয় শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদে প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বেশ কয়েক বছর। শেখ পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছেন তিনি। শেখ হাসিনার প্রতিপাদ্য 'স্মার্ট বাংলাদেশ'-কে সামনে রেখে ক্রীড়াঙ্গনের মিলনমেলা আয়োজন করেন প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয় করে।
অথচ সেই তরফদার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভোল পাল্টে ফেলে চাইছেন ফুটবলের মোড়ল হতে। কেবল তাই নয়, দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থনও পাচ্ছেন তিনি। অনেক বিএনপি নেতাই সমর্থন দিচ্ছেন তাকে। সভাপতি পদপ্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার দিন তার পাশে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ক্রীড়া সম্পাদক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক। উপস্থিত ছিলেন সাবেক ডাকসাইটে ছাত্রনেতা ও ডাকসুর ভিপি খাইরুল কবির খোকনসহ অনেকেই। আজ যখন মনোনয়নপত্র জমা দিলেন, তার পাশে ছিলেন কাজী মহিউদ্দিন আহমেদ বুলবুল, অ্যাডভোকেট আলী ইমাম তপনের মতো বিএনপি নেতারা।
বাফুফে নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক অর্থ খরচ করছেন তরফদার, এমনটা গুঞ্জন আছে। যে কোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই অর্থিক বিষয় জড়িত থাকে। তবে ক্রীড়াঙ্গনের অনেকের পাওনাই পরিশোধ করেননি তরফদার। এরমধ্যে মোটা অঙ্কের টাকা পাওনা আছে ফ্রাঞ্চাইজি হকি লিগের আয়োজক প্রতিষ্ঠান।
ফ্রাঞ্চাইজি হকি লিগে তরফদার রুহুল আমিনের প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক দল গঠন করে। সেখানে তার দলের নাম ছিল সাইফ পাওয়ারটেক খুলনা। সেখানে আয়োজক প্রতিষ্ঠান এখনো সাইফ পাওয়ারের কাছে এক কোটি টাকা পায় বলে জানা যায়।
হকি লিগের আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, ‘আমাদের ফ্রাঞ্চাইজি মানি ছিল এক কোটি বিশ লাখ টাকা। সাইফ পাওয়ার আমাদের বিশ লাখ টাকা দিয়েছিল। তবে বাকি এক কোটি টাকা এখনো দেয়নি। তার দলের সকল ব্যয়ভার আমরা বহন করেছিলাম। খেলোয়াড়দের পাঁচ তারকা হোটেলে রাখা, খাওয়া থেকে শুরু করে আমরাই সব খরচ বহন করেছি। তবে প্রতিষ্ঠানটি থেকে আমাদের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। এই বিষয়ে তরফদার রুহুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। ’
বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনেও বিভিন্ন টুর্নামেন্টে প্রতিশ্রুত অর্থ দেননি তরফদার, সূত্রমতে এমনটাই জানা যায়। দাবা ফেডারেশনেও প্রায় অর্ধকোটি টাকার কাছাকাছি বকেয়া রেখেছেন তিনি। বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনেও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তরফদার। ২০২১ সালে নড়াইলের চিত্রা নদীতে সাইফ পাওয়ারটেকের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হয়েছিল শেখ রাসেল দুরপাল্লার সাতার। এছাড়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনজরে থাকতে বিভিন্ন সময় শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করেছিলেন তিনি। সুইমিং ফেডারেশন সূত্রে জানা যায়, প্রায় বিশ লাখ টাকা পাওনা আছে তরফদারের কাছে। যদিও দ্রুত সময়ের মধ্যে তা পরিশোধের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি, এমনটাও সূত্র মতে জানা গেছে।
এছাড়া ২০২২ সালে ২৬ আগষ্ট ক্রীড়াঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত থেকে ‘মাদার তেরেসা’ আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হন তরফদার রুহুল আমিন। ক্রীড়াঙ্গনে এমন বিরল সম্মাননা স্মারকটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালকে উৎসর্গ করেন তিনি। পুরস্কারপ্রাপ্তির ২০ দিনের মাথায় জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন ফোরামের ব্যানারে শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী জাতীয় হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তরফদার রুহুল আমিনকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সেখানেই নিজের সম্মাননা শেখ কামালকে উৎসর্গ করেন তরফদার রুহুল আমিন।
চট্টগ্রাম আবাহনীর হাত ধরেই ফুটবলে প্রবেশ করেছিলেন তরফদার রুহুল আমিন। তবে গত মাসে যখন বাফুফে নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখনও পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, তিনি চট্টগ্রাম আবাহনীর কেউ নন। এর আগে ক্লাবটির চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। যখন প্রিমিয়ার লিগে চট্টগ্রাম আবাহনীর দল গঠন নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা, তখন তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে দূরে সরে যান রুহুল আমিন। আবার যখন প্রয়োজন পড়ে, তখন আবার গেলেন তাদের কাছেই। চট্টগ্রাম আবাহনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তাদের নাকি রুহুল আমিন নিজেই বলেছেন, ‘আমাকে বাফুফে নির্বাচনের জন্য কাউন্সিলর করে দাও, আমি তোমাদের ৫০ লাখ টাকা দেব। ’
যখনই তিনি কাউন্সিলর হয়ে গেলেন, বদলে গেল তার চেহারা! এখন চট্টগ্রাম আবাহনী হন্যে হয়ে তাকে খুঁজছে। নিয়মিত ফোন, মেসেজ দিচ্ছেন ক্লাবটির দুর্দিনের নাবিক হওয়া তিন ফুটবলার জাহিদ হাসান এমিলি, মামুনুল ইসলাম মামুন ও রেজাউল করিম রেজা। কিন্তু রুহুল আমিনের কাছ থেকে তারা কোনো সাড়া পাননি।
বাফুফে নির্বাচনে সিনিয়র সহসভাপতি পদে তরফদার রুহুল আমিনের নির্বাচন করবেন। তার প্রতিপক্ষ বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট ইমরুল হাসান। ক্রীড়াঙ্গনে ‘ক্লিন ইমেজে’র জন্য সর্বজন সমাদৃত তিনি। এখন সময়ই বলে দেবে পরবর্তী ফলাফল কী হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২৪
এআর/এমএইচএম