ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের সবুজ মিয়া (৫৫)। সহায় সম্বল বলতে কেবলমাত্র বসত-বাড়ি, নেই জমি-জিরাত।
সংসারের চাকা ঘোরাতে দোকান করেন কাঁচামালের। সাত সদস্যের সংসার একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু নিজের কিশোরী মেয়ে তাসলিমার কল্যাণে সবুজের চারপাশে এখন আনন্দের হিল্লোল।
এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক তাসলিমাই অভাবি বাবার মুখে ফুটিয়েছে হাসি।
সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) জমকালো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবার মতো কলসিন্দুরের তাসলিমাও পেয়েছে নগদ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সেই টাকার পুরোটাই তুলে দিয়েছে বাবার হাতে।
মেয়ের ভবিষ্যত গড়তে এ টাকায় ভূমিহীন সবুজ এখন জায়গা-জমি কেনার স্বপ্ন দেখছেন।
রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠেছে নাজমা। বাবা আবুল কালাম (৫৫) চা দোকানি। কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর মা বকুল বেগম (৪৫) মেয়েকে মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
আর মেয়ের ইচ্ছা ছিল, মার্জিয়া-সানজিদাদের সঙ্গে ফুটবল চালিয়ে যাওয়ার। ইচ্ছাশক্তির জোরের কাছে থামাতে পারেননি মা।
আর থেমে যাননি বলেই হয়তো সানজিদা-তহুরাদের মতো নাজমার নামও ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। হয়েছেন নারী ফুটবলের মহাকাব্যের পাতায় অদম্য এক ফুটবলার।
নাজমার বাবা আবুল কালাম মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাতে বাংলানিউজকে বলেন, ‘কষ্টে কষ্টে জীবন গেছে। মেয়েটার ভবিষ্যত নিয়ে আর চিন্তা নেই। শিক্ষা খরচ থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যয় বহন করবে ফেডারেশন। তারা আমার মেয়েকেও ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দিয়েছে। এ টাকা দিয়েই মেয়ের নামে জমি বন্ধক রাখবো’।
তাসলিমা কিংবা নাজমার মতোই কলসিন্দুরের অন্য ফুটবল কন্যারাও পেয়েছে সুখের ঠিকানা। অভাবের সংসারে তাদের নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তারও অবসান হয়েছে।
দারিদ্র্য জয় করে আশার আলো জ্বালিয়ে দেশসেরা ফুটবলারের গৌরব অর্জন করেছে তারা। প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রমে তাদের কাছে ধরা দিয়েছে সাফল্য।
নারী ফুটবলের অনন্য প্রতিভার অধিকারী এ ফুটবলারদের সঙ্গে বাফুফে’র চুক্তিতে উচ্ছ্বসিত কলসিন্দুর গ্রামের বাসিন্দারাও। আলোর রোশনাই হয়ে গ্রামের গৌরব বাড়ানো লাল-সবুজের কিশোরী ফুটবলারদের কৃতিত্ব আর সাফল্যে গর্বিত তারাও।
‘কখনো ভাবতে পারিনি সোনারগাঁওয়ের মতো হোটেলে যাবার সুযোগ হবে। আমরা এক মাইক্রোবাসে সেদিন আনন্দ-ফূর্তি করতে করতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। ফিরেছিও আনন্দ সঙ্গী করে। ফেডারেশনের লোকজন আমাদের অনেক যত্ন-আত্তি করেছেন। নামি-দামী লোকেরা হাত মিলাইছেন। অনেক সম্মানও দিয়েছেন’- উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বলছিলেন নারী ফুটবলের অন্যতম সেরা মার্জিয়ার বাবা আব্দুল মোতালেব।
অভাবের সংসারের বোঝাও যেন এখন কাঁধ থেকে নেমে গেছে রিকশাচালক মোতালেবের।
তিনি বলছিলেন, ‘আমার মা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমাদেরও সম্মান বাড়াইয়া দিছে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে পাওয়া টেকায় ভাবতাছি মেয়েডার লেইগ্যা জমি রাখমু। ভবিষ্যতে তো ওর বিয়ে দিতে অইবো’।
২০১১ সাল থেকে স্থানীয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শরীরচর্চা শিক্ষক মফিজ উদ্দিনের হাতে গড়ে ওঠে ফুটবল মানচিত্রে বাংলাদেশকে নতুন করে চেনানো বাঘিনী মারিয়া-সানজিদা-শামসুন্নাহাররা।
স্মৃতির ভেলায় নিজেকে ভাসিয়ে ওই শিক্ষক বাংলানিউজকে বলছিলেন, ‘শুরুর দিকে ওদের বলতাম, নিজের সেরাটা খেলো। তাহলে একদিন তোমরাও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্লাবে খেলতে পারবে। তোমাদের নাম ছড়িয়ে যাবে। টাকা-পয়সা ইনকাম করতে পারবে’।
‘হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েগুলো কথাগুলো বিশ্বাস করতো। আজ আমাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরের পর্যায় শুরু হয়েছে। বাফুফে ওদের নগদ অর্থ পুরস্কার দিয়েছে। জাতীয়ভাবে চুক্তিও করেছে। এ খুশিতে কলসিন্দুরের ঘরে ঘরে উচ্ছ্বাস-আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে’- যোগ করেন সানজিদাদের প্রথম গুরু।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৬
এমএএএম/ এএসআর