গত কয়েকমাস ধরে বিশ্ব ফুটবলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বার্সেলোনা। চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের হাতে বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে একের পর এক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে কাতালান জায়ান্টরা।
সেই ধাক্কার পর কিকে সেতিয়েনকে বরখাস্ত করে প্রধান কোচ হিসেবে রোনাল্ড কোম্যানকে নিয়োগ দেয় বার্সা। ডাচ কোচ ক্যাম্প ন্যুয়ে পা রেখেই জানিয়ে দেন, লুইস সুয়ারেস, ইভান রাকিতিচ, আর্তুরো ভিদালদের নতুন ঠিকানা খুঁজে নিতে।
এদিকে বিশ্ব ফুটবলকে অবাক করে বার্সার সঙ্গে ২০ বছরের সম্পর্ক ত্যাগের ঘোষণা দেন লিওনেল মেসি। তবে শেষ পযর্ন্ত নানা আলোচনার পর আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড আরেক মৌসুম ক্যাম্প ন্যুয়ে থাকার কথা জানান।
কিন্তু তার পাশে আর সতীর্থ হিসেবে থাকবেন না দীর্ঘদিনের বন্ধু সুয়ারেস, রাকিতিচ, ভিদালরা। ইতোমধ্যে রাকিতিচ ফিরে গেছেন পুরনো ঠিকানা সেভিয়ায়। ভিদাল চুক্তি করেছেন ইন্টার মিলানের সঙ্গে আর শেষজন হিসেবে বার্সার সঙ্গে ৬ বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদে যোগ দিয়েছেন সুয়ারেস।
উরুগুইয়ান ফরোয়ার্ড লিভারপুল ছেড়ে ক্যাম্প ন্যুয়ে যোগ দেন ২০১৪ সালে। ততদিনে অবশ্য বিশ্ব ফুটবলে নিজের চরিত্রের পাশে ‘নেগেটিভ’ তকমা সেঁটে গেছে তার। সে বছর বিশ্বকাপে ইতালিয়ান ডিফেন্ডার গিয়র্গিও চিয়েলিনিকে কামড় দিয়ে নিষিদ্ধ হোন সুয়ারেস। বার্সায় যোগ দেওয়ার পর আরও ৪ মাস নিষিদ্ধ ছিলেন তিনি।
অবশেষে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে এল ক্লাসিকো দিয়ে বার্সার জার্সিতে অভিষেক হয় সুয়ারেসের। কিন্তু ম্যাচটিতে ৩-১ গোলের অম্ল স্বাদের পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় কাতালানদের। তবে স্কোয়াডে জায়গা পাকাপোক্ত করতে বেশিদিন সময় লাগেনি তার। মেসির সঙ্গে জোট বেঁধে দ্রুতই হয়ে ওঠেন ক্যাম্প ন্যুয়ের অন্যতম অস্ত্র।
দ্য এমএসএন বুম
মেসি, সুয়ারেস ও নেইমার। সংক্ষেপে এমএসএন। ক্যাম্প ন্যুয়ে আগে থেকে ছিলেন মেসি-নেইমার। সুয়ারেস যোগ দেওয়ার পর এই জুটি ত্রাস হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের জন্য। ২০১৭ সালে নেইমারের পিএসজিতে যাওয়ার আগ পযর্ন্ত বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জুটি ছিল এমএসএন।
কোচ লুইস এনরিখের অধীনে এই তিন লাতিন ফরোয়ার্ডের দাপটে ২০১৪/১৫ মৌসুমে ট্রেবল (চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা ও কোপা দেল রে) জেতার স্বাদ পায় বার্সা। সেই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৫ গোল করেন সুয়ারেস। যার মধ্যে জুভেন্টাসের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে করেন এক গোল। এছাড়া সেবার ২৪ গোলে অ্যাসিস্ট করেন তিনি।
৪ শিরোপা এবং গোল্ডেন বুট
পরের মৌসুমে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন সুয়ারেস। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫৯ গোলের পাশাপাশি আরও ২২ গোলে সহায়তা করেন তিনি। উরুগুইয়ান ফরোয়ার্ডের দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্সের সুবাদে বার্সা মৌসুম শেষ করে ৪ শিরোপা সুপারকোপা, ক্লাব বিশ্বকাপ, কোপা দেল রে এবং লা লিগা জিতে। ইউরোপের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার গোল্ডেন বুটও ওঠে তার হাতে।
পিএসজির বিপক্ষে কামব্যাকের গল্প
২০১৬/১৭ মৌসুমে ডাবল শিরোপা লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস ঘরে তুলে রিয়াল মাদ্রিদ। তবে মৌসুমটি বার্সার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে দু’টি কারণে। চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসজির বিপক্ষ প্রথম লেগে ৪-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও নিজেদের মাঠে ফিরতি লেগে ৬-১ ব্যবধানে জিতে অবিস্মরণীয় কামব্যাকের গল্প লিখে কাতালানরা।
সেবার এনরিখের শিষ্যরা মৌসুম শেষ করে কোপা দেল রে ও সুপারকোপা জিতে। তখনও নিজের সেরা ফর্মে সুয়ারেস। ‘এল পিস্তোলেরো’ ৪২ গোলের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করেন ১৬ গোলে।
বিখ্যাত এমএসএন’র ভাঙন, বার্সার ভরাডুবি
২০১৭ সালে মেসি-সুয়ারেসকে ছেড়ে রেকর্ড ট্রান্সফারের ঝড় তুলে পিএসজিতে যোগ দেন নেইমার। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের বিদায় ঢেউয়ের ধাক্কাটা ঠিকই লাগে বার্সার দেয়ালে। কোচ এরনেস্তো ভালভার্দের অধীনে চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা দুই মৌসুম ভরাডুবি হয় হয় কাতালানদের। প্রথম লেগে এগিয়ে থাকার পরও রোমা ও লিভারপুলের বিপক্ষে আশা বিসর্জন দিয়ে ঘরে ফিরেন মেসি-সুয়ারেসরা।
তবে তখনও গোলে ভাটা পড়েনি সুয়ারেসের। ২০১৭/১৮ মৌসুমে ৩৬ এবং ২০১৮/১৯ মৌসুমে ৩৩ গোল করেন তিনি। যার মধ্যে ক্যাম্প ন্যুয়ে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে করেন হ্যাটট্রিক।
যুগের সমাপ্তি
সুয়ারেস বার্সার হয়ে শেষ ম্যাচ খেলেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ৮-২ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া ম্যাচে। সেই ম্যাচে অবশ্য একটি গোলও করেন তিনি। কাতালানদের জার্সিতে নিজের শেষ মৌসুমে ৩৩ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড করেন ২১ গোল ও ১১ অ্যাসিস্ট। বার্সার হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তার গোল ১৯৮।
রেকর্ড
পরিসংখ্যান অনুসারে, সুয়ারেস বার্সা ছেড়েছেন ক্লাবটির ইতিহাসের সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে। সাবেক লিভারপুল ফরোয়ার্ড কাতালানদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় আছেন তৃতীয় স্থানে। অফিসিয়ালি, তার উপরে আছেন কেবল মেসি ও সিজার রদ্রিগেজ।
বার্সার ইতিহাসে মেসির পর সুয়ারেসই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট জিতেছেন। যেখানে লা লিগায় বিদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় তিনি আছেন সাতে এবং স্পেনের শীর্ষ ফুটবল লিগে উরুগুইয়ানদের মধ্যে তিনিই সর্বোচ্চ গোলস্কোরার।
মেসির সেরা সঙ্গী
মাঠে জুটি বেধে বার্সাকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন মেসি-সুয়ারেস। মাঠের বাইরেও এই দুই লাতিন ফরোয়ার্ডের রয়েছে দারুণ বন্ধুত্ব। একসঙ্গে বার্সায় থাকাকালীন সুয়ারেসকে দিয়ে ৩৯টি গোল করিয়েছেন মেসি। যা অন্যান্য খেলোয়াড়দের চেয়ে অনেক বেশি।
বার্সায় আর্জেন্টাইন তারকার পাস থেকে ২০ গোল করে দ্বিতীয় স্থানে আছেন নেইমার। এরপরে আছেন পেদ্রো রদ্রিগেজ (১৭), ডেভিড ভিয়া (১২) এবং স্যামুয়েল ইতো (১২)।
অন্যদিকে সুয়ারেসের পাস থেকে মেসি করেছেন ৪৭ গোল। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার পাস থেকে সমান গোল করেছেন মেসি। আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের গোলে ৪২ অ্যাসিস্ট করে দ্বিতীয় স্থানে আছেন নেইমার। দানি আলভেজ অবদান রেখেছেন ৪১ গোলে এবং জাভির অ্যাসিস্ট থেকে ৩২ গোল করেছেন মেসি।
কিংবদন্তিতুল্য নাম্বার-৯
ক্যাম্প ন্যুয়ে সুয়ারেসের জার্সি নাম্বার ছিল ‘৯’। কেবল দু’জন একই নাম্বার জার্সির স্ট্রাইকার বার্সেলোনার হয়ে তার ১৯৮-এর চেয়ে বেশি গোল করেছেন। পাওলিনহো আলকান্তারা, যার গোলের সংখ্যা ৩৬৯। তবে তার অধিকাংশ গোল অনুল্লেখযোগ্য টুর্নামেন্টে ও ম্যাচে। অন্যদিকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিজার রদ্রিগেজের গোলের সংখ্যা ২২২।
পরিসংখ্যান বলছে, গোলের দিক দিয়ে অনেক নাম্বার-৯ জার্সিধারী বার্সা কিংবদন্তিকে ছাড়িয়ে গেছেন সুয়ারেস। যার মধ্যে গোল সংখ্যায় তার পেছনে আছেন তার সাবেক সতীর্থ ইতো (১৩০), প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট (১২২), থিয়েরি অঁরি (৪৯), ভিয়া (৪৮), রোনালদো নাজারিও (৪৭)।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০
ইউবি