গত বছর চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে দেওয়া অখ্যাত এক ক্লাবের কোচ ইউরি ভার্নিডুব এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা। কিয়েভের বিরুদ্ধে মস্কোর সামরিক অভিযানের নবম দিনে তার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ঠিক ছয় মাস আগে চ্যাম্পিয়নস লিগের এক ম্যাচে এই ইউরি ভার্নিডুবের ক্লাব শেরিফ তিরাসপোল স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদকে ২-১ গোলে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছিল। রিয়ালের ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে স্বাগতিকদের হারানোর পর বুনো উল্লাসে মেতেছিলেন ক্লাবটির কোচ ভার্নিডুব। তিনি নিজে একজন ইউক্রেনীয়। তার জন্মভূমি ট্রান্সনিস্ট্রিয়া মলডোভার অংশ হলেও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই অংশটি রাশিয়ার সেনাবাহিনীর আস্তানা রয়েছে। জায়গাটি বর্তমানে রুশ-পন্থী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
১৩ বারের চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী রিয়ালকে শেরিফের মতো দল কি করে হারিয়ে দিল, তা ফুটবলবিশ্বের কাছে আজও এক বিস্ময় হয়ে আছে। কারণ গ্রুপ পর্বে পা রাখার আগে দলটিকে চারটি বাছাইপর্ব পেরিয়ে আসতে হয়েছে। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো দলটির বার্ষিক বাজেট মাত্র ৫ মিলিয়ন পাউন্ড! দলটি চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বে তৃতীয় হওয়ায় ইউরোপা লিগের নক আউট পর্বে জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাগার বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগে খেলতে নেমেছিল। দুই লেগ মিলিয়ে হেরেছে দলটি।
২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে যখন ব্রাগা ম্যাচের কথা ভেবে বিছানায় গিয়েছিলেন ভার্নিডুব, তিনি হয়ত ভাবতেই পারেননি পরদিন সকালে তার জীবন পুরোপুরি বদলে যাবে। ৫৬ বছর বয়সী এই কোচ জানিয়েছেন, স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে চারটায় তার ছেলে রুশ হামলার খবর জানায়। ঠিক য়ই সময়ই তিনি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এরপর রোমানিয়া থেকে শুক্রবার তিরাসপোল হয়ে ১১ ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে শনিবার সকালে ইউক্রেনে নিজের ঠিকানায় পৌঁছান তিনি।
এক সাক্ষাৎকারে ভার্নিডুব জানিয়েছেন, তিনি যখন নিজ এলাকায় ফিরে এলেন; দেখলেন অনেক শক্তপোক্ত মানুষ দেশ ছেড়ে ভাগছে। তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি কিছুতেই পালিয়ে যাবেন না। যদিও তার পরিবার যুদ্ধে যেতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তিনি কারো কথায় কর্ণপাত করেননি। তবে তার স্ত্রী তার পাশে দাঁড়ান এবং সমর্থন দেন। এমনকি তার পরিবারের বাকি সদস্য মলডোভায় যেতে চাইলেও তার স্ত্রী তার সঙ্গেই ইউক্রেনে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার বাড়ি থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরেই রাশিয়া-ইউক্রেন বাহিনীর মধ্যে জোর লড়াই চলছে। তার গন্তব্য সেখানেই।
ভার্নিডুব একসময় আর্মিতে ছিলেন। একসময় ইউক্রেনের যুবকদের দুই বছর বাধ্যতামূলক আর্মি ট্রেনিং নিতে হতো। কিন্তু ওই ট্রেনিং ছিল ক্রীড়াবিদদের জন্য। দুই মাস পরে অবশ্য তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। সেসব অনেক আগের ঘটনা, তবে এখনও অস্ত্র চালনায় কোনো অসুবিধা নেই তার। ফলে যুদ্ধে যেতেও ভয় পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। যুদ্ধের ময়দানে হাজির হওয়ার পর তাকে ঘিরে ইউক্রেন সেনাদের উৎসাহ নাকি চোখে পড়ার মতো। অনেকে তার সঙ্গে ছবি তুলতে আসছে।
তবে যুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে কিছুই জানাননি ভার্নিডুব । তবে নিজ দেশের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। তিনি বলেন, 'জেলেনস্কির (ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট) প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। তাকে নিয়ে যে যা ইচ্ছা বলুক না কেন, আমি তাকে ভোট দিয়েছি। তাকে অনেকে ক্লাউন বা কমেডিয়ান বলে উপহাস করে। কিন্তু আমি জানি তিনি ভালো মানুষ। তিনি দেখিয়েছেন যে তিনি সত্যিকারের নেতা। আমাদের প্রেসিডেন্ট সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। তিনি সৎ, তবে ভুলের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু ভুল সবারই হয়। একটা দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া কতটা কঠিন তা আমি অনুভব করতে পারি। '
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়ে ভার্নিডুব বলেন, 'আমি পুতিন ও তার সহযোগীদের ঠিক বুঝতে পারি না। রুশদের মধ্যে যারা তার পক্ষে তাদেরও আমি বুঝতে পারি না। তবে আমি জানি রাশিয়ার অনেকে বুঝতে পারছেন না কি হচ্ছে। রাশিয়াতে বিষয়গুলো অন্যভাবে দেখানো হচ্ছে। তারা নাকি আমাদের মুক্ত করছে, কিন্তু কার কাছ থেকে? তারা আমাদের স্বৈরাচার, নাৎসি বলছে। তারা কি করছে তা আসলে বলে বোঝানোর ভাষা নেই আমার কাছে। তারা সাধারণ মানুষদের আক্রমণ করছে, কিন্তু তারা বলে বেড়াচ্ছে শুধু সামরিক স্থাপনায় হামলা করছে। তারা মিথ্যা বলছে। '
ভার্নিডুবের বিশ্বাস, এই যুদ্ধে ইউক্রেনের জয় হবে। তিনি বলেন, 'আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই যে, আমরাই যুদ্ধে জিতবো। এছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারছি না। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আমি দেখতে পাচ্ছি এই যুদ্ধ আমাদের জাতি হিসেবে একত্রিত করেছে। আমি মনে করি, একমাত্র আমাদের জয়ই পারে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। রাশিয়ার চাহিদা মেনে নেওয়া অসম্ভব। আমরা হার মানবো না। আলোচনার দরকার আছে, কিন্তু তাদের আল্টিমেটাম আমাদের সন্তুষ্ট করবে না। আমি আশা করি, আলোচনার টেবিলে বসে তারা মাথা খাটাবে এবং যুদ্ধ থামাবে। আমি আশা করি, আর কোনো নারী ও শিশুর মৃত্যু হবে না। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। '
যুদ্ধের ময়দানেও ফুটবলের কথা ভাবেন ভার্নিডুব, 'আমি সবসময় ফুটবল নিয়ে ভাবি। ফুটবল আমার জীবন। সেই শৈশব থেকেই ফুটবলের সঙ্গে সখ্য আমার। আমি পেশাদার ফুটবলার ছিলাম, পরে কোচ হয়েছি। আমি নিশ্চিত আমি কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাব এবং শিরোপা জিতবো। যখন রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে দিলাম, আজকের মতো পরিস্থিতির কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। কিন্তু গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দুশ্চিন্তা ভর করতে শুরু করে। খেলোয়াড়রাও প্রশ্ন করত, কেন এত চিন্তা করছি? আমি তাদের বলতাম, কিছুই হয়নি; কিন্তু শিগগিরই হবে। তারা বলতো কিছুই হবে না, কিন্তু আমি অনুভব করতাম। আমি আশা করি, যুদ্ধ দ্রুতই শেষ হবে এবং আমরা জিতবো। এরপর আমি আমার পছন্দের কাজে ফিরে যাব। '
বিবিসি অবলম্বনে
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০২২
এমএইচএম