ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুটবল

রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে...

গল্পটা দি মারিয়ার স্বপ্নপূরণের, গল্পটা দি মারিয়ার স্বপ্নভঙ্গেরও

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২২
গল্পটা দি মারিয়ার স্বপ্নপূরণের, গল্পটা দি মারিয়ার স্বপ্নভঙ্গেরও

‘আনহেল দি মারিয়া যদি থাকতেন!’ এমন আফসোস আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মুখে শোনা যায় প্রায়ই। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা হয়নি তার।

কেন? আদতে ‘ব্যবসার কারণে’। ওই গল্প চার বছর পরে প্লেয়ার্স ট্রিবিউনকে শুনিয়েছিলেন মারিয়া, বলেছেন নিজের বেড়ে উঠার কথাও; মাহমুদুল হাসান বাপ্পি সেটির অনুবাদ করেছেন বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য...

আপনারা আমার গল্প শুনতে এসেছেন। আপনাদের শুরুতে একটা স্বপ্ন ভাঙার গল্প বলি। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, রিয়াল মাদ্রিদের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম- খোলার আগেই কান্না শুরু করেছিলাম, পড়িওনি।  

দিনটি ছিল ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের। সময়টাও মনে আছে, ঠিক সকাল ১১টা বাজে তখন। আমি ট্রেনারের টেবিলে বসে আছি, একটু পর পায়ে ইঞ্জেকশন নেবো। কোয়ার্টার ফাইনালের সময় থাই মাসেল বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পেইন কিলার খাওয়ার পর কোনো ব্যথা ছাড়াই দৌড়াতে পারতাম। আমি ট্রেনারকে ঠিক এই কথাগুলো বলেছিলাম তখন, ‘দেখো, যদি পা ভেঙে ফেলি, তাহলে ভাঙতে দাও। আমার কিছু যায়-আসে না। আমি শুধু খেলতে চাই। ’

এমন ভাবনা নিয়ে পায়ে বরফ দিচ্ছি, এমন সময় আমাদের দলের ডাক্তার দানিয়েল মার্তিনেস এলো। তার হাতে একটা চিঠি, আমাকে বললো, ‘দেখো আনহেল, এই চিঠি রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এসেছে। ’

মার্তিনেসকে বললাম, ‘তুমি কীসের কথা বলছো? বুঝতে পারছি না। ’

ও জবাব দিলো, ‘দেখো, রিয়াল মাদ্রিদ বলছে তুমি খেলার মতো অবস্থায় নেই। তারা আমাদের জোর করছে তোমাকে যেন না খেলাই।

দ্রুতই বুঝতে পারলাম কী হচ্ছে। চারদিকে তখন গুঞ্জন, বিশ্বকাপের পরই রিয়াল হামেস রদ্রিগেসকে সাইন করাবে। জায়গা করার জন্য আমাকে বিক্রি করবে, এটাও জানতাম। তারা তাই তাদের সম্পদ মানে আমার ক্ষতি হোক এটা চাচ্ছিলো না। ফুটবলের এই ব্যবসা সবসময় মানুষ দেখে না।

আমি দানিয়েলকে বললাম চিঠিটা দিতে। খুলেও দেখলাম না, টুকরো টুকরো করলাম। এরপর বললাম, ‘এগুলো দূরে ফেলে আসো। এখানে সিদ্ধান্ত একমাত্র আমি নেবো। ’

রাতে ভালো ঘুম হয়নি। একটা কারণ ছিল- ব্রাজিলের সমর্থকরা আমাদের হোটেলের সামনে পুরো রাতভর আগুন জ্বালিয়েছে। কিন্তু যদি সবকিছু পুরোপুরি শান্তও থাকতো। আমার মনে হয় না ঘুমাতে পারতাম। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের রাতের অনুভূতি বোঝানো অসম্ভব। সারাজীবন ধরে যা কিছু স্বপ্ন দেখেছেন, সব আপনার চোখের সামনে।

সচেতনভাবেই সেদিন খেলতে চেয়েছিলাম। ক্যারিয়ার যদি শেষও হয়ে যেত, সমস্যা ছিল না। কিন্তু একই সঙ্গে আমি দলের জন্য বিষয়গুলো জটিলও করতে চাচ্ছিলাম না। ভোরের দিকেই ঘুম থেকে উঠলাম আর ম্যানেজার মিস্টার সাভেয়ার কাছে গেলাম। আমাদের  সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। যদি আমি তাকে বলতাম, শুরুর একাদশে থাকতে চাই- আমি জানতাম উনি চাপ অনুভব করতেন। বুকে হাত রেখে তাকে বললাম, তোমার হৃদয় যাকে বলে তাকে খেলাও।

আমি বলেছিলাম, ‘যদি এটা আমি হই, তাহলে আমিই। যদি এটা অন্য কেউ হয়, তাহলে অন্য কেউ। আমি শুধু বিশ্বকাপ জিততে চাই। যদি তুমি আমাকে ডাকো, সবকিছু ভেঙে যাওয়ার আগে অবধি আমি খেলবো। ’

কথাগুলো বলেই কাঁদতে শুরু করলাম। কিছুতেই আর থামতে পারছিলাম না।  

ম্যাচের আগে যখন আমাদের মিটিং শুরু হলো। সাভেয়া ঘোষণা করলো, এঞ্জো প্যারেজ খেলবে কারণ সে শতভাগ সুস্থ। আমি ওই সিদ্ধান্তে খুশি ছিলাম। ম্যাচের আগে একটা ইঞ্জেকশন নিলাম, দ্বিতীয়ার্ধের সময়ও। যেন যখনই বেঞ্চ থেকে ডাক আসে খেলতে পারি।  

কিন্তু ওই ডাক এলো না। আমরা বিশ্বকাপ ফাইনাল হারলাম, আমি কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমার জীবনে সবচেয়ে কঠিন ছিল সেদিন। ম্যাচের পর, মিডিয়া উদ্ভট সব কথা বলা শুরু করলো কেন আমি খেলিনি। আমি আপনাদের যা কিছু বলছি, পুরোপুরি সত্যি এটাই।

সাভেয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া এখনও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কারণ আমার শুধু মনে হয় কান্না দেখে সে আমাকে নার্ভাস ভেবেছে কি না!

সত্যি তো হচ্ছে, কোনো নার্ভাসনেস ছিল না। আমি আবেগাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম কারণ মুহূর্তটা দামী ছিল অনেক। অসম্ভব স্বপ্ন সত্যি করার খুব কাছে ছিলাম আমরা।

আমাদের ঘরের দেয়ালগুলো সাদা থাকার কথা ছিল। কিন্তু মনে পড়ে না তেমন দেখেছি কখনো। শুরুর দিকে এরা ধূসর থাকতো, এরপর কয়লার ময়লাতে কালো হয়ে যেতো। আমার বাবা ছিলেন একজন কয়লা শ্রমিক, কিন্তু খনিতে না। উনি আসলে আমাদের বাড়ির পেছনে কয়লা বানাতেন।  

আপনারা কি কখনো কয়লা বানাতে দেখেছেন? বারবিকিউয়ের জন্য দোকান থেকে যে ছোট ব্যাগ কেনেন, এই কয়লাগুলো কিন্তু কোনো এক জায়গা থেকে আসে। সত্যি বলতে এটা খুব নোংরা ব্যবসা। বাবা ছোট একটা টিনের চালের নিচে বসে কয়লা বানাতেন, এরপর এগুলো নিয়ে বাজারে বিক্রি করতেন। কেবল উনিই না, তার ছোট্ট সাহায্যকারীরাও ছিল।  

স্কুলে যাওয়ার আগে আমি ও আমার বোন বাবাকে সাহায্য করতাম। আমাদের বয়স তখন নয় অথবা দশ হবে, ময়লা ব্যাগে ঢুকানোর জন্য এটা একদম ঠিকঠাক বয়স। যখন কয়লার ট্রাক আসতো, ঘরের ভেতর দিয়ে এগুলো নিয়ে আমাদের সামনের দরজায় রাখতে হতো। সময়ের সঙ্গে এজন্য এমনিতেই ঘরের দেয়াল কালো হয়ে যেতো।

কিন্তু এভাবেই আমাদের খাবার যোগাতে হতো। বাবা ঘরটাকে টিকিয়ে রাখতেন। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার বাবা-মা ভালোই দিন কাটাতেন। এরপর বাবা একজনের উপকার করতে গেলেন, আমাদের জীবন বদলে গেলো এক নিমিষে। উনার এক বন্ধু বলেছিল, তার বাড়ির গ্যারান্টার হতে, বাবা তাকে বিশ্বাস করেছিল। এরপর ওই লোক টাকা দিতে পারলো না, একদিন হুট করে হারিয়ে গেলো। ব্যাংক সোজা এসে বাবাকে ধরলো। দুই বাড়ির ঋণ ও এক পরিবারকে খাওয়াতে উনি হিমশিম খেতে থাকলেন!

উনার প্রথম ব্যবসা কয়লার ছিল না। আমাদের বাড়ির সামনের রুমে দোকান বানিয়েছিলেন। ব্লিচিং, ক্লোরিন, সাবান ও ধুয়ামোছার জিনিসপত্র বড় ড্রামে নিয়ে আসতেন এরপর ছোট বোতলে ঢুকাতেন। আমাদের শহরের মানুষেরা এসবের জন্য বড় দোকানে যেতো না। কারণ অনেক দাম ছিল। তারা দি মারিয়ার দোকানে আসতো আর আমার মা কম দামে একটা বোতল দিতেন।

সবকিছুই ভালোই চলছিল। এরপর একদিন তাদের ছোট বাচ্চা মানে আমি সব শেষ করে দিলাম।  

হ্যাঁ, এটা সত্যিই। আমি ছোটবেলায় খুব বদ ছিলাম!

আসলে খুব একটা খারাপ ছিলাম, তেমনও না; কেবল এনার্জি ছিল বেশি। প্রচুর ছুটাছুটি করতাম। একদিন আমার মা দোকানে ছিল, পাশেই আমি খেলছিলাম। সামনের দরজা খোলা ছিল যেন ক্রেতারা আসতে পারে। এরপর আমার মা চোখ সরিয়ে নিলো আর আমি হাঁটা শুরু করলাম...আমাকে এক্সপ্লোর করতে হবে!

হাঁটতে হাঁটতে একেবারে রাস্তার মাঝখানে চলে গেলাম। আমার মা দৌড়ে এসে গাড়ির ধাক্কা খাওয়া থেকে বাঁচালেন। বাস্তবে এটা আরও অনেক নাটকীয় ছিল, মানে মা আমাকে যেমন বলেছেন আর কী। ‘দি মারিয়া’স ক্লিনিং শপের’ সেটাই ছিল শেষ দিন। বাবাকে গিয়ে মা বললেন, এটা খুব ভয়ঙ্কর, আমাদের অন্য কিছু করতে হবে।

এরপরই বাবা সান্তিয়াগো দেল এসতারো থেকে কয়লা নিয়ে আসা লোকের খোঁজ পেলো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমাদের কাছে কয়লা কেনার মতো টাকাও ছিল না! ওই লোককে বাবা বুঝিয়ে প্রথম কয়েক ট্রাক কয়লা এনেছিলেন। এরপর যখনই আমি ও বোন বাবার কাছে কেন্ডি অথবা কিছু চাইতাম- বাবা তখন বলতেন, ‘আমি দুইটা বাড়ি আর এক ট্রাক কয়লার দাম শোধ করছি!’

মনে আছে একদিন বাবার সঙ্গে কয়লা ব্যাগে ঢুকাচ্ছিলাম। প্রচুর ঠাণ্ডার মধ্যে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আমাদের মাথার ওপর কেবল টিনের চালই ছিল। এটা খুব কঠিন। কয়েক ঘণ্টা পরে আমি স্কুলে গেলাম, যেখানে কিছুটা গরম আছে। আমার বাবার পুরো দিন কাজ করতে হলো এই আবহারওয়ার ভেতরই। কারণ উনি যদি সেদিন বিক্রি না করেন, হয়তো আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমার মনে আছে নিজে নিজে ভাবতাম ও বিশ্বাস করতাম- কোনো একদিন, সবকিছু ভালোর দিকে বদলাবে।

এই কারণে আমি সবকিছুর জন্য ফুটবলের কাছে ঋণী।

কখনও কখনও ছোটখাটো বদ বাচ্চা হওয়া কাজে আসে! ফুটবল আমি খুব অল্প বয়সে শুরু করেছিলাম। মাকে অনেক দৌড় করাতাম। চার বছর বয়সে উনি সত্যিই আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন আর বললেন, ‘ডাক্তার, ও কখনও দৌড় থামায় না। কী করবো?’

ডাক্তার খুব ভালো ছিল। উনি বললো, ‘কী করবেন? ফুটবল খেলতে দেন। ’ শুরু হলো আমার ফুটবল ক্যারিয়ার।  

খেলার প্রতি মগ্ন হয়ে গেলাম। মনে আছে এত বেশি ফুটবল খেলতাম, দু মাস পরপর জুতা ভেঙে যেতো একদিকে। এরপর মা সেগুলো জুড়ে দিতেন কারণ নতুন কেনার মতো সামর্থ্য ছিল না। যখন আমার সাত বছর বয়স, খুব ভালো খেলতাম তখনও। প্রতিবেশী একটি দলের হয়ে ৬৪ গোল করেছিলাম। এরপর একদিন মা আমার রুমে এসে বললো, ‘রেডিও স্টেশন থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ’ আমরা স্টেশনে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিলাম। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম কারণ তখন কম কথা বলতাম।

ওই বছরই আমার বাবা একটা ফোন পায় রোজারিও সেন্ট্রালের যুব দলের কোচের কাছ থেকে। আমি যেন তাদের হয়ে খেলি, এমন চাওয়া ছিল। মুহূর্তটা ছিল খুব মজার কারণ আমার বাবা নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজের অনেক বড় ভক্ত ছিলেন। মায়ের সমর্থন আবার ছিল সেন্ট্রালের জন্য। আপনাদের রোজারিওতে জন্ম না হলে প্রতিদ্বন্দ্বীতাটা বুঝতে পারবেন না। বলা যায় জীবন-মরন ব্যাপার একেবারে। ক্লাসিকোর পর যে হারতো, এক মাস ধরে তাকে পঁচাতো।

আশা করি কল্পনা করতে পারছেন মা কতটা রোমাঞ্চিত ছিল সেন্ট্রাল থেকে ডাকার পর।  বাবা বললো, ‘এটা অনেক দূরে হয়ে যায়। আমি কিছু জানি না। নয় কিলোমিটার যেতে হবে! আমাদের গাড়িও নেই! কীভাবে ওকে নিয়ে যাবে?’

তখন মা বলেছিল, ‘না, না! কোনো চিন্তা করবে না। আমি ওকে নিয়ে যাবো! কোনো সমস্যা নেই!’

ওই সময় জন্ম নিলো গ্রাসিয়েলা। কোনো মানুষ নয়- এটা ছিল পুরোনো হলুদ রঙের সাইকেল। মা আমাকে এটাতে করে প্রতিদিন অনুশীলনে নিয়ে যেতেন। ছোট একটা ঝুড়ি ছিল সামনে, আর পেছনে একজনের বসার মতো জায়গা। কিন্তু সমস্যাটা এখানেই। কারণ আমার বোনকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হতো। বাবা কাঠের একটা জায়গা বানালেন পাশে, বোন সেখানে বসতো।  

একবার কল্পনা করে দেখুন- একজন নারী শহরের ভেতর দিয়ে একটা ছেলেকে পেছনে, মেয়েকে পাশে ও সামনের ঝুঁড়িতে জুতা-নাস্তাসহ কিটব্যাগ নিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। উঁচু পাহাড়, নিচু পাহাড়। ভয়ঙ্কর প্রতিবেশীদের সামনে। বৃষ্টির দিন, ঠাণ্ডার মধ্যে, অন্ধকারের ভেতর- এগুলো কিছুই যায়-আসে না। আমার মা শুধু প্যাডেল চাপতে থাকতেন। গ্রাসিয়েলা আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতো।
কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, সেন্ট্রালেও আমার দিনগুলো সহজ ছিল না। এমনকি মা না থাকলে আমি অন্তত দুবার ফুটবলই ছেড়ে দিতাম। যখন ১৫ বছর বয়স, তখনও বেড়ে উঠছিলাম না। একজন খারাপ কোচ ছিল- উনি শারিরীকভাবে শক্ত ও আক্রমণাত্মক ফুটবলার পছন্দ করতেন। ওই ধরনটা আমার ভেতর ছিল না।
 
একদিন আমি বক্সের ভেতর হেড দিতে লাফাইনি, উনি তখন সব ফুটবলারদের একসঙ্গে ডাকলেন। এরপর বললেন, ‘তোমার কোনো মান-সম্মান নেই। কোনোদিন কিছু হতে পারবে না। তুমি হবে আস্ত একটা ব্যর্থ মানুষ। ’

একদম ভেঙে পড়েছিলাম তখন। কথাগুলো শুনে শেষও করিনি, সব সতীর্থদের সামনে কান্না শুরু করেছিলাম। এরপর দৌড়ে মাঠ ছেড়েছি।
 
বাড়ি ফিরে এসে সোজা আমার রুমে গিয়ে একা একা কান্না শুরু করলাম। মা বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। কারণ প্রতিদিন অনুশীলন থেকে ফিরে আবার রাস্তায় খেলতে যেতাম। মা আমার রুমে এসে জানতে চাইলেন কী হয়েছে, আমি সচেতনভাবেই বলতে চাচ্ছিলাম না। কারণ বললে হয়তো সাইকেল চালিয়ে গিয়ে উনি আবার কোচকে ঘুষি মেরে বসবেন। মা খুব শান্ত মানুষ, কিন্তু আপনি যদি তার সন্তানদের কিছু করেন...ভাই, দয়া করে আগে দৌড়ে পালান!

আমি বললাম মারামারিতে জড়িয়ে গিয়েছিলাম, তাই কাঁদছি। মা জানতেন মিথ্যা বলছি। উনি তাই করলেন যা সব মায়েরা করে- এক বন্ধুর মাকে কল দিলেন সত্যিটা জানতে।  

এরপর রুমে ফিরে এলেন, তখনও আমি কাঁদছি। মাকে বললাম ফুটবল ছেড়ে দিতে চাই। পরেরদিন এমনকি বাসার বাইরেও যাইনি, স্কুলেও যেতে চাচ্ছিলাম না, খুব অপমানিত বোধ করছিলাম। মা তখন আমার বিছানায় বসলেন আর বললেন, ‘তোমাকে ফিরে যেতে হবে আনহেল। আজকেই তুমি ফিরে যাবে। তার কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। ’

আমি সেদিন অনুশীলনে ফিরে গেলাম আর তখন অসাধারণ একটা ব্যাপার ঘটলো। সতীর্থরা আমাকে নিয়ে মজা নেয়নি। তারা আসলে আমাকে সাহায্যই করেছে। দেখা গেল, বল বাতাসে ভেসে আসছে তখন ডিফেন্ডাররা আমাকে বলটা জিততে দিচ্ছে। তারা নিশ্চিত করেছে যেন আমি ভালো বোধ করি, সেদিন সত্যিই অনেক যত্ম নিয়েছে। ফুটবল অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ খেলা, বিশেষত দক্ষিণ আমেরিকায়। সবাই আরেকটু ভালো জীবনের খুঁজে থাকে! কিন্তু সবসময় ওই দিনটা মনে থাকবে, কারণ তারা আমাকে ভুগতে দেখেছে আর সাহায্য করেছে।  

তবুও, আমি খুব ছোট ও হাড্ডিসার ছিলাম। ১৬ বছর বয়সেও মূল দলের হয়ে খেলতে পারিনি। বাবা চিন্তিত হয়ে গেলেন। এক রাতে আমরা রান্না ঘরের টেবিলে বসলাম আর উনি বললো, ‘তোমার হাতে তিনটা বিকল্প আছে। আমার সঙ্গে গিয়ে কাজে নামতে পারো। স্কুল শেষ করতে পারো। অথবা আর এক বছর ফুটবলে চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু যদি এটা না পারো, তাহলে সোজা আমার সঙ্গে কাজে নামতে হবে।

আমি কিছুই বলিনি। পরিস্থিতি জটিল ছিল। আমাদের টাকা দরকার তখন।

মা উঠে বললো, ‘আরেক বছর ফুটবল খেলবে। ’ তখন ছিল জানুয়ারি মাস। বছরের একেবারে শেষ মাস ডিসেম্বর গিয়ে...প্রিমিয়ার ডিভিশনে সেন্ট্রালের হয়ে অভিষেক হয় আমার।

ওইদিন থেকে শুরু হলো স্পোর্টসের জীবন। কিন্তু সত্যি বলতে লড়াই আরম্ভ হয়েছে অনেক আগে। আমার মা যখন জুতা আঠা দিয়ে জুড়তেন তখন, বৃষ্টির দিনে তার সঙ্গে গ্রাসিয়েলায় চড়ার সময়। এমনকি যখন আমি আর্জেন্টিনায় পেশাদার ফুটবল খেলি, তখনও লড়াই শেষ হলো না। আমার মনে হয় দক্ষিণ আমেরিকার বাইরের মানুষ বুঝবে না এসব কেমন। আপনাকে কিছু অভিজ্ঞতা দরকার হবে এগুলো বিশ্বাস করতে।

লিভার্তোদোরেসে নাকিওনালের বিপক্ষে খেলতে কলম্বিয়া যাওয়ার ঘটনা কখনো ভুলবো না। কারণ এখানে বিমানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লা লিগা বা প্রিমিয়ার লিগের মতো না। এমনকি তখন বুইন্স এইরেসেও অনেক সহজ ছিল। ওই সময় রোজারিওতে কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই ছিল না। আপনার ছোট্ট বিমানবন্দরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, প্লেন আসলে চড়ে বসতে হবে। কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ নেই।

তো কলম্বিয়া যাওয়ার পথে আমরা পেলাম বড় এক কার্গো বিমান। গাড়ি বা এমন সব জিনিস পাড়াপাড় করতো তারা। হ্যাঁ, এটাই ছিল আমাদের বিমান। মনে আছে এর নাম ছিল, ‘হারকিউলিস’। শ্রমিকরা সবকিছু বিমানে তুললো। সব ফুটবলাররা একজন- আরেকজনের চেহারার দিকে তাকালো আর ভাবটা এমন ছিল, ‘কী হচ্ছে এসব?’

আমরা বিমানে চেপে বসলাম, কিন্তু শ্রমিকরা বললো, ‘না ভাইয়েরা, তোমাদের পেছনে বসতে হবে। এই হেডফোনগুলো সঙ্গে নাও। ’
বড় ওই সামরিক হেডফোনগুলো দিয়েছিল যেন আওয়াজ কানে না আসে। প্ল্যাটফর্মে উঠে দেখি অল্প কয়েকটা সিট আর বাকি সব মালামাল। আট ঘণ্টা ধরে, লিভারতোদেরেসের ম্যাচের জন্য ওখানেই কাটালাম। তারা দরজা বন্ধ করে দিলো আর সবকিছু অন্ধকারে ডুবে গেলো। আমরা কেবল হেডফোন কানে দিয়ে ওই মালগুলোর ওপর শুয়ে পড়েছিলাম। একজন-অন্যজনকে শুনতেও পাচ্ছিলাম খুব কম।

আমরা যারা শুয়ে পড়েছিলাম, তারা পিছলে যেতে থাকলাম। এর মধ্যে একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘কেউ বড় লাল বাতিতে চাপবে না। যদি ওই দরজা খুলে যায়- আমরা সবাই শেষ!’

এটা অবিশ্বাস্য। আপনি যদি এমন কিছুর অভিজ্ঞতা না নেন, আমাকে বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু আপনি আমার সতীর্থদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। এমন সত্যিই হয়েছে। এটাই ছিল আমাদের ব্যক্তিগত বিমান। হারকিউলিস!

এখন যখন স্মৃতিটা ফিরে দেখি আনন্দই লাগে। যখন আপনি আর্জেন্টিনাতে ফুটবল খেলবেন, যাই হোক খেলবেনই। ওইদিন বিমানে যাই দেখেন, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই উঠে যাবেন।

যখন আপনি সুযোগগুলো পাবেন, ওয়ান ওয়ে টিকিট আসবে আপনার জন্য। আমার জন্য সেটা ছিল পর্তুগালের বেনফিকায়। কেউ কেউ হয়তো আমার ক্যারিয়ারের দিকে তাকায় আর ভাবে, ‘ওয়াও! সে বেনফিকা থেকে রিয়াল মাদ্রিদে গেছে। এরপর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, পিএসজি। ’ ব্যাপারটা খুব সাধারণ মনে হয়। কিন্তু আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না এগুলোর মধ্যে কত কিছু হয়েছে।

১৯ বছর বয়সে যখন বেনফিকাতে যাই, দুই মৌসুম খুব কমই খেলতে পেরেছি। আমার বাবাকে চাকরি ছেড়ে আমার কাছে আসতো হলো, মায়ের চেয়ে এক সমুদ্র দূরে চলে এলেন তিনি। কোনো কোনো রাতে আমি বাবাকে ফোনে কান্না করতে করতে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখতাম, কারণ উনি অনেক বেশি মিস করতেন তাকে।  একসময় মনে হচ্ছিলো অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। শুরুর একাদশে জায়গা পাচ্ছিলাম না আর আমি সব ছেড়ে ঘরে ফিরতে চাইছিলাম।

এরপর ২০০৮ সালের অলিম্পিক আমার পুরো জীবন বদলে দিলো। বেনফিকাতে শুরুর একাদশে না থাকলেও আর্জেন্টিনা আমাকে ডেকেছিল। কখনো এটা ভুলবো না। ওই টুর্নামেন্ট আমাকে বুদ্ধিমান এলিয়েন, জিনিয়াস লিওনেল মেসির সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দিলো। সেটা ছিল ফুটবলে আমার সবচেয়ে মজার সময়। আমাকে কেবল ফাঁকা জায়গায় দৌড়াতে হতো। বল আমার পায়ে এমনিতেই চলে আসতো, জাদুর মতো।  

লিওর চোখ আপনার বা আমার মতো করে কাজ করে না। হয়তো এদিকে-ওদিকে মানুষের মতোই তাকায়। কিন্তু তার পাখির মতো পৃথিবীকে উপর থেকে দেখারও ক্ষমতা আছে। আমি বুঝতে পারি না কীভাবে এটা সম্ভব।

আমরা ফাইনালে নাইজেরিয়াকে হারালাম, সম্ভবত সেটাই আমার জীবনের সেরা দিন। গোল করে আর্জেন্টিনাকে স্বর্ণ জেতানো...আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না এই অনুভূতি।

আপনাকে বুঝতে হবে আমার বয়স ২০ বছর আর আমি বেনফিকার হয়ে শুরুর একাদশে থাকি না। আমার পরিবার বিচ্ছিন্ন। এই টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা ডাকার আগে আমি ছিলাম আশাহীন এক মানুষ। দুই বছরের মধ্যে স্বর্ণ জিতলাম, বেনফিকার শুরুর একাদশের হয়ে নিয়মিত খেললাম এরপর রিয়াল মাদ্রিঅমাদে আসলাম।

এসব কেবল আমার জন্যই না, পুরো পরিবার, বন্ধু, বছরের পর বছর ধরে সাহায্য করে আসা সতীর্থ; সবার জন্যই ছিল গর্বের মুহূর্ত। আমি শুনেছি, বাবা নাকি আমার চেয়ে ভালো ফুটবলার ছিলেন; কিন্তু ছোটবেলায় হাঁটু ভেঙে ফেলেছিলেন। আমার দাদা দুজনের চেয়েই ভালো ছিলেন, কিন্তু ট্রেনের দুর্ঘটনায় বেচারা পা-ই হারিয়ে ফেলেছিলেন, তার স্বপ্নরা তখন মরে গেছে।

আমার স্বপ্নও এক সময় মরে যাওয়ার কাছাকাছি ছিল। কিন্তু আমার বাবা টিনের চালের নিচে কাজ করে গেছেন...মা সাইকেলের প্যাডেল চাপা থামাননি...আমি ফাঁকা জায়গায় দৌড়ে গেছি...।

জানি না আপনারা ভাগ্যে বিশ্বাস করেন কি না। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে আমি প্রথম যেদিন গোল করলাম, প্রতিপক্ষ দলের নাম কী ছিল জানেন? ‘হারকিউলিস সিএফ!’

আমরা অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এনেছি আপনাদের। হয়তো এখন বুঝতে পারছেন কেন বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে সাভেয়ার সামনে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। আমি নার্ভাস ছিলাম না। ক্যারিয়ারের ব্যাপারে চিন্তিতও না। এমনকি একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়ে ভাবনাও ছিল না।  

বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমি শুধু আমাদের স্বপ্নপূরণ করতে চেয়েছি। দেশের মানুষের কাছে কিংবদন্তি হিসেবে মনে থাকার ইচ্ছে ছিল। খুব কাছাকাছিও পৌঁছেও গিয়েছিলাম আমরা...।

এজন্য আর্জেন্টিনার সংবাদ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া দেখে কষ্ট পেয়েছি। একসময় নেতিবাচকতা ও সমালোচনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। এটা স্বাস্থ্যকর কিছু ছিল না। আমরা সবাই মানুষ, জীবনে এমন কিছু ঘটে যেটা মানুষ দেখে না।

এমনকি কোয়ালিফাইং ম্যাচের ঠিক আগে আমি একজন মনোবিদ দেখিয়েছি। আমার মাথা তখন অনেক কঠিন সময় পাড় করছিল। সাধারণত এমন সময় থেকে বের হতে পরিবারের ওপর ভরসা করি। কিন্তু এবার জাতীয় দলের চাপ অনেক বেশি ছিল, তাই মনোবিদের সাহায্য নিয়েছি। শেষ দুই ম্যাচে আমি অনেকটাই শান্ত ছিলাম।

আমি নিজেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা দলের একজন হিসেবে দেখি। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছি, যে স্বপ্ন ছোটবেলা থেকে লালন করেছি। পেশাদার ফুটবলার হিসেবে সাধারণ কিছু বিষয় আমরা ভুলে যেতে পারি। খেলাটা শুধুই খেলা হয়ে থাকে।

আমার মনে হয় এখন লোকজন ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউবে শুধু ফলটাই দেখে। কিন্তু তারা মূল্যটা বুঝে না। পথচলাটাও জানে না। তারা আমাকে দেখেছে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুলছি। হয়তো ভাবছে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। কিন্তু কেউ জানে না এক বছর আগেই এ মেয়ে সময়ের চেয়ে আগে জন্মে গিয়েছিল, এরপর দুই মাস হাসপাতালে থেকেছে। পুরো শরীরে নানা যন্ত্র-টিউব লাগানো ছিল।

সবাই হয়তো দেখে ট্রফির সঙ্গে কাঁদছি আর ভাবছে ফুটবলের কারণে। কিন্তু বাস্তবতা হলো কাঁদছি কারণ আমার মেয়ে বাহুতে আছে ওই মুহূর্তে।  

মানুষজন বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখেছে, ফলটা জেনেছে।  

আর্জেন্টিনা ০-১ জার্মানি।

কিন্তু তারা জানে না কত কঠিন লড়াই আমরা করেছি ওই মুহূর্তে পৌঁছাতে।
 
মানুষ জানে না আমার থাকার ঘরের দেয়াল সাদা থেকে কালো হয়ে গিয়েছিল।

সবাই জানে না আমার বাবার ছোট টিনের চালের নিচের কাজের ব্যাপারে।

বৃষ্টিতে, ঠাণ্ডায় আমার মায়ের সাইকেল চালানোর ব্যাপারেও কেউ জানে না।

জানে না হারকিউলিসকেও।

বাংলাদেশ সময় : ১৪৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২২ 
এমএইচবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।