ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফ্রান্স

প্যারিসে বাংলাদেশ

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৬
প্যারিসে বাংলাদেশ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্যারিস: কাজী এনায়েতুল্লা। ফ্রান্স-বাংলা চেম্বার সভাপতি।

সেই সঙ্গে অল ইউরোপ বাংলাদেশি কমিউনিটিরও নেতা। প্রায় শূন্যহাতেই উচ্চ শিক্ষার জন্য প্যারিসে এসেছিলেন তিনি। সেটা ১৯৭৮ সালের ২ সেপ্টেম্বরের গল্প। ১৮ বছর বয়সে দেশ ত্যাগ করে পরিবারের সান্নিধ্য ভুলতে বেশ যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে।

এরপর পিঠার দোকানে পার্টটাইম চাকরি, লোড-আনলোডের কাজ থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করেছেন টিকে থাকার তাগিদে। কিন্তু এখন তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে ফরাসীদের কাছে এক নামে পরিচিত। আর বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে বিপদে-আপদে আশ্রয়ের নাম ‘ইনু ভাই’।

কেবল কঠোর পরিশ্রম, উচ্চাকাঙ্খা, আর কিছু করে দেখানোর প্রত্যয়ে তিনি প্যারিসের উল্লেখযোগ্য রেস্টুরেন্ট, রিয়েল এস্টেট ও সেবাখাতের বড় ব্যবসায়ী। ১৯৮৫ সালে জন্মস্থান ঢাকার বনানী’র নামকরণে প্যারিসে প্রথম রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখন তার ৬টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। রয়েছে তিনটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। ২০০২ সালে শুরু করেছিলেন ট্রাভেল এজেন্টর ব্যবসা। বনানী ট্রাভেলস এখন ইউরোপ মহাদেশসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের উজবেক এয়ারের জেনারেল সেলস এজেন্ট।   

ফ্রান্সের বাংলাদেশ কমিউনিটি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্ভাবনা, উৎকণ্ঠা নিয়ে তিনি বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেছেন তার অভিমত।

এক কথায় বলা যায়, একটি নতুন কমি‌উনিটি নতুন জেনারেশন ২০ বছর ধরে গড়ে উঠছে। ২৩ থেকে ৩০ হাজার বাংলাদেশি ফ্রান্সে রেসিডেন্স পারমিট পেয়েছে বলে অনুমান করা হয়। তবে বাংলাদেশিদের মোট সংখ্যা এখানে ৫০ হাজার পেরিয়েছে বলে বিভিন্নজন বলে থাকেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব চেষ্টায় ভাগ্যান্বেষণে এসে নানা ধরনের কাজ করে তারা এখানে টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছেন।

প্যারিসের মূল সমাজের সঙ্গে মেশা খুব কঠিন। এরা খুব রক্ষণশীল জাতি। এদের সঙ্গে মিশতে যে যোগ্যতা লাগে, বাংলাদেশিদের সে যোগ্যতা নেই বললেই চলে। মূল সমসা হলো ভাষা। কিন্তু ফরাসী ভাষা যে কোন ভাষার চেয়েই কঠিন। ভাষা জানলে ভালো চাকরি এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে উন্নতি করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশিদের মধ্যে সেই মানের ভাষা জানা মানুষের সংখ্যা কম।

ফ্রান্সে এসেই বাংলাদেশিরা বাস্তবতার কারণেই কাজের সন্ধানে নেমে পড়ে। তাদের ভাষাটা আর শেখা হয় না। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এতে সারা জীবনই তাদের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হয়। কেবল যারা ভাষাটা শুরু থেকেই আয়ত্বে আনতে পেরেছে, তারাই ব্যবসায় প্রবেশ করতে পারছে। তুলনামূলক ভালো চাকরিও তাদের জন্য সহজ হয়েছে।

’৯০ সালের পর থেকেই আস্তে আস্তে বাংলাদেশিরা এখানকার ব্যবসায় আসতে শুরু করেছে। বর্তমানে অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর কোনটি শুরু হচ্ছে কোন প্রস্তুতি ছাড়াই, আবার কোনটা প্রস্তুতি নিয়ে। শুরুতেই অনেকে বাধা বিপত্তির মুখে পড়ছেন, আবার কেউবা বাধা ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছেন। তবে প্রস্তুতি ছাড়া এখানে ব্যবসা করা সত্যিই কঠিন। বর্তমানে পূর্ব ও উত্তর প্যারিসে বাংলাদেশিদের বসবাসের সংখ্যা বেশি। প্রতিদিনই এখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

বর্তমানে এখানে শ’দুয়েক উদ্যোগী বাংলাদেশি উদ্যোক্তা আছেন, যারা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় জড়িত- যারা ভালোভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। আবার কেউ আছেন যারা শুরুতেই অভিজ্ঞতার অভাবে কলাপস হয়ে যাচ্ছেন।

এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির কিছু সামাজিক, আর্থিক কার্যক্রম আছে। তবে এখানকার এই কমিউনিটি তো কেবল গড়ে উঠছে, তাই সবাই নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তারা নিজেদের কাজ ও সংসার নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সামাজিক কাজে তাদের মনোযোগের অভাব রয়েছে।

ফ্রান্সের নতুন এই জেনারেশনের কিন্তু দেশ প্রেমের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু তাদের দেশের প্রডাক্ট নিয়ে ব্যবসার কোন আগ্রহ নেই। এখানে বাংলাদেশ থেকে যে পণ্য বেশি আমদানি হয় তার সিংহ ভাগই গার্মেন্ট পণ্য। কিন্তু এই ব্যবসার পুরোটাই বিদেশিদের দখলে। বাংলাদেশিরা এই ব্যবসার উদ্যোগও নেয় না। গ্রোসারি কিছু প্রোডাক্ট এখানে আসে। তাও উল্লেখযোগ্য নয়। কবে সবাই বাংলাদেশি প্রডাক্ট আমদানির উদ্যোগ নেবে তাও বলা যায় না।

এখানকার বাজারও লিমিটেড। বাজার দখলের জন্য অন্যান্য কমিউনিটির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকার কথা এক্ষেত্রে বলতে হয়। তারা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশি পণ্যের চেয়ে এসব দেশের পণ্যের মান ও সুবিধা ভালো। কেবল বাংলাদেশি কমিউনিটি দিয়ে যেহেতু ব্যবসা হয় না, তাই ওদের পণ্যই এখানে বেশি চলে।

এখানে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বাংলাদেশি উৎপাদকদের কার্যকরি উদ্যোগের অভাব। এক্ষেত্রে তারা প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন, মার্কেটিং ও বিপণন কৌশলে কোন দক্ষতা দেখাতে পারেনি। তাই আমাদের সব ক্ষেত্রেই বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু বিদেশিরা তো তাদের স্বার্থের বাইরে যাবে না। তাই এক্ষেত্রে ইউরোপে নিজেদের বাজার তৈরি করতে নিজেদেরই উদ্যোগ নিতে হবে।

আমরা যতো দিন নিজেরা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকাসহ অন্যবাজারে নিজেদের বাজার নিজেরা তৈরির উদ্যোগ না নেবো, ততদিন পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তবে সবার আগে বাংলাদেশি পণ্যের ব্র্যান্ডিং নিজেদেরই করতে হবে। বিদেশিদের ওপর এ বিষয়ে এখনকার মতো নির্ভরশীল থাকলে, তারা আমাদের জন্য সামান্যই করবে, এতে আমাদের রপ্তানি প্রত্যাশা কোনদিনই পূরণ হবে না।

এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা উচিত, বিশ্ব বাজার অর্থনীতিতে আবেগের কোন স্থান নেই। এখানে প্রয়োজন কেবল লক্ষস্থির করা কার্যক্রম। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কার্যকর ভূমিকা পালনের মাধ্যমেই কেবল একদিন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বহি:বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিক্রমায় তার উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে।

প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসের ব্যবসা সম্প্রসারণসহ নানা কার্যক্রমে ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, তাদের সব বিষয়ে উদ্যোগ অতি সামান্য। এ চিত্র কেবল এখানে নয়, সবখানে। রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ও কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত জীবিকার মাধ্যম হিসেবে কর্মকর্তারা জীবন নির্বাহ করছেন। ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিদেশের মাটিতে যতটুকু অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে তার পুরোটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফসল।

একটা কথা অবশ্যই বলা যায়, ইউরোপে বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। তবে এটাও সত্য, সব সম্ভাবনা জাস্টিফাই হয়, সফলতার ওপর। আমরা যদি নিজেরা নিজেদের বাজার তৈরি করতে পারি, নেতৃত্বে যেতে পারি তখনই কেবল সফল হবো। এখানে বাংলাদেশের ব্যবসা এখন মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে। ফলে দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কম। আবার এখানে বেশি। ফলে দেশের শ্রমিকরা সেখানে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছে না। আর এখানকার ভোক্তারা আসল দামে পণ্য পাচ্ছে না।

ফ্রান্সে বাংলাদেশি কমিউনিটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, একটি কমিউনিটি ওয়ার্ক তখনই সবার পক্ষ্যে সার্থকভাবে করা সম্ভব হয়, যখন অর্থনৈতিকভাবে মানুষ স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পায়। সামাজিক কার্যক্রমগুলোর একটি সীমাবদ্ধতা আছে। তাই গরীব কমিউনিটি হিসেবে বাংলাদেশিরা সামান্যই কার্যক্রম এখানে চালাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে দূতাবাসের ভূমিকা বলতে গেলে তাদের সীমাবদ্ধতার কথাই বলতে হয়। কয়েকটি জাতীয় দিবস পালনের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। তাদের প্রশাসনিক কাজ সম্পর্কেও মানুষের মধ্যে ভালোমন্দ অভিমত আছে। মন্দ আবদার যেমন তাদের পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব হয় না, তেমনি যৌক্তিক ও সঠিক দাবিও তারা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দেন।

বিদেশি ও প্রবাসীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্পর্কে বলতে গেলে সবার আগে বলতে হয়, যে কোন অর্থনৈতিক কার্যক্রম মূলত নির্ধারিত হয় একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ভিত্তিতে। অনেক ক্ষেত্রেই ফরাসী বা প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের অস্থীতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। তার মানে বাংলাদেশে বিনিয়োগকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। এটা অনেকটাই পরিষ্কার, পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন সাপেক্ষে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। এতে ইউরোপীয়ান বা প্রবাসীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আর কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।

এক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশ কিছুদিন হরতাল অবরোধ না থাকায় দেশের অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। জ্বালানি সংকট মোকাবেলায়ও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। ব্যবসাবান্ধব সরকারি নীতিমালায় বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এগুলো ইতিবাচক দিক। আবার নেতিবাচক দিক হলো, বিদেশিদের চোখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্র এখনো  অমীমাংশিত রয়ে গেছে। তাই বর্তমান স্থীতিশীলতা কতোদিন স্থায়ী হবে তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। ভবিষ্যত দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে এটা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রধান শর্ত হলো, গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক স্থীতিশীলতার নিশ্চয়তা বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের সামনে উপস্থাপন করা। যা সবাইকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিশ্চিন্ত করবে। তখনই সম্ভব হবে প্রিয় বাংলাদেশের সত্যিকারের অর্থনৈতিক মুক্তি। ৭১’র রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর আজকের এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধে আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। সমস্ত আবেগকে মনের মধ্যে রেখে এই অর্থনৈতিক যুদ্ধে জয়ী হওয়ার মাধ্যমে আমরা বিশ্বকে আবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে পারি, আমরা কতোটা দেশপ্রেমিক। আমরা বলতে পারি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৫
আরএম/জেডএম

** আমাদের কথা কেউ বলে না!
** ট্যাক্সি চালক থেকে মেয়র প্রার্থী
** হাঁটা পথে ইউরোপে
** প্যালেস ডি সালভাদর দালি
** প্যা‌রিসে ম‌লিন আবহে বড়‌দিন
** গির্জাভিত্তিক পর্যটন
** এনভার্সে জাকিরের দেখা
** বাস্তিল ঘিরে পর্যটন
** প্যারিসের গণতন্ত্র ময়দান
** বাতাক্লঁয়ে প্রতিদিনই আসছে মানুষ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।