ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফ্রান্স

অনন্য এক মুক্তিযোদ্ধা, তিনি বাঘা যতীনের নাতি

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৬
অনন্য এক মুক্তিযোদ্ধা, তিনি বাঘা যতীনের নাতি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্যারিস থেকে ফিরে: নাম তার পৃথীন্দ্রনাথ মুখার্জি। থাকেন প্যারিসে।

বয়স ৯০ ছুঁইছুঁই। বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের তিনি এক সাহসী যোদ্ধা। বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তবে অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি বাংলাদেশে। সেই সময়ে তার হয়ে পদক গ্রহণ করেছিলেন ঢাকাস্থ ফরাসি রাষ্ট্রদূত।
 
প্যারিসের বাঙালি কমিউনিটির সবার প্রিয় ‘পৃথীনদা’ তিনি। তবে বাংলাদেশি বা ভারতীয় বাঙালিরা তার পরিচয় দিতে অবশ্য ‘বাঘা যতীনের নাতি’ বলতেও সমান গর্ববোধ করেন । জন্মস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হলেও তার পূর্ব পুরুষের জন্মভিটা বাংলাদেশের ঝিনাইদহে। ফরাসি দর্শন, সাহিত্য, ভারতীয় দর্শন ও ইতিহাসের গবেষক হিসেবে তিনি পেয়েছেন ফরাসী সরকারের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, পদক ও ফরাসি একাডেমি খেতাব।

তবে সেইসব ভুলে কেবল ‘বাঘা যতীনের নাতি’ পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন পৃথীন্দ্রনাথ নাথ মুখার্জি নিজেও।
 
প্যারিসে বসবাসরত অনেকেই জানে না তার পরিচয় ও জীবন কর্মের গল্প। তার সব আড্ডা ছিল ফরাসি মূল স্রোতের গুনীজনদের সঙ্গে। তবে শেষ বয়সে এসে তিনি ধরা দিয়েছেন ‘বাঙাল’ বা বাঙালিদের কাছে। প্যারিস প্রবাসী চলচিত্র পরিচালক প্রকাশ রায় ও কন্ঠ শিল্পী আরিফ রানার সাথে বেশ ভাব আছে পৃথীন্দ্র নাথের। তাই তাদের সঙ্গী করেই ডিসেম্বরের শেষদিকে হিমাঙ্কের কাছাকাছি শীতের এক বিকেলে হাজির হলাম তার ফ্লাটে। সরকারি ফ্লাট ছেড়ে নিজের ফ্লাটে এসে উঠেছেন সবে। বাসার সবকিছু গোছানো না হওয়ায় একটু বাঙালিসুলভ লজ্জ্বাবোধের প্রকাশ থাকলেও একটু পরেই সব হয়ে উঠলো স্বাভাবিক।
 
প্যারালাইজড শরীরটাকে হুইল চেয়ারে নিজেই ঠেলে ঠেলে এনে বসালেন টেবিলের এক পাশে। নব্বই ডাকপাড়া শরীরে ব্রেইন স্ট্রোকের চিহ্ন স্পষ্ট থাকায় স্পষ্ট কথা বলতে পারেন না। তবে এক সময় ঠিকই কন্ঠে জোর আসে... জোন আসে। সে জোস যুদ্ধের গৌরবের। সেই জোরালে কন্ঠে জড়ানো শব্দমালা আর অবোধগম্য মনে হয় না। পিতামহের বীরত্বের কথা বলে চলেন একটানা। বলে চলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজের জড়িয়ে পড়ার গল্প।
 
তার (বাঘা যতীন) নানাবাড়ী কুষ্টিয়া আর নিজেদের আদি বাড়ি সেকালের যশোরে। যা বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলার অংশ। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঘা যতীন’র সেই বাড়ি-সম্পত্তিতে জাদুঘর ও ক্যান্টনমেন্ট করার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলেই জানালেন তিনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর তার সব সম্ভাবনাই গেছে তিমিরে তলিয়ে। বাকি সব সম্পত্তিসহ ‘বাঘা যতীন’র ভিটেবাড়িও হয়েছে বেদখল।
 
পৃথীন্দ্রনাথ বলেন, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন তার রক্তেও যুদ্ধে যাওয়ার নেশা ধরেছিল। তিনি তখন প্যারিস সরকারের ফেলো হিসেবে গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন। একই সঙ্গে ব্যস্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, ফ্রান্স রেডিও এবং টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে। কিন্তু তার মনে হচ্ছিলো, সবই মিছে। বার বার মনে হচ্ছিলো বাপ-ঠাকুরদা’র ভিটে রক্ষায় অংশ নেওয়া উচিত এই যুদ্ধে।
 
‘করণীয় ঠিক করতে না পেরে একদিন গেলাম প্যারিসের ভারতীয় দূতাবাসে। ভারতের রাষ্ট্রদূত আমাকে জানালেন, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি প্যারিসে থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার পরামর্শ দিলেন। কষ্ট হলেও আমি সেই পরামর্শ মেনে নিলাম। কারণ মন পড়েছিলো, বর্ষাস্নাত তাল হিজলের দেশের সবুজ গ্রামে। যেখান দিয়ে হলিউডি সিনেমার দৃশ্যের মতো বৃষ্টিতেও ধোঁয়া ওড়ে (!)’ একটানা সাহিত্যের পাতার মতো স্মৃতির দেয়াল থেকে যেনো তুলে ধরছিলেন তিনি।
 
পৃথীন বলেন, এরপরই শামসুর রাহমান, জসীমউদ্দীন, জীবনান্দ দাস, কাজী নজরুল ইসলামসহ বাংলাভাষার কবিদের দেশপ্রেমী কবিতাগুলো দ্রুত ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে ফেলি আমি। প্রতিদিনই ফ্রান্স রেডিওতে সেই কবিতাগুলো জনপ্রিয় আবৃত্তিকারদের দিয়ে আবৃতি করাতাম । টেলিভিশনের জন্য সে সময়ে ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের দিয়ে সেইসব কবিতা আবৃত্তি করাতাম। টেলিভিশনে তা প্রচার করা হতো। রেকর্ডগুলো বিক্রি করে ফান্ড জোগাড় হতো মুজিবনগর সরকারের জন্য।

কেবল তাই নয়, প্রতিদিনের যুদ্ধের আপডেট নিয়ে ফ্রান্সের সবগুলো ফরাসি ও ইংরেজি পত্রিকায় প্রতিদিনই কলাম লিখতেন পৃথীন্দ্রনাথ। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল ও পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত ছাপছিলেন যুদ্ধের ভায়বহতা আর নিষ্ঠুরতার কথা। এভাবেই ফরাসি দেশে বাংলাদেশের পক্ষে মতামত গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।
 
তিনি বলেন, হয়তো সরাসরি ময়দানেও যুদ্ধ করা যেতো। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের পক্ষে সে সময় বর্হিবিশ্বে মতামত তৈরি করাও ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। আমি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম।

দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে ১৯৭৩ সালে এসেছিলেন ঢাকায়। সেই স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে আনন্দে চিকচিক করে ওঠে তার চোখ। বঙ্গবন্ধুর নাম বলে করজোড় কপালে ছুঁয়ে বলে ওঠলেন, ‘যে আগুন আমাদের এতো দূর এগিয়ে এনেছে, তাকে প্রণাম। আমার দাদুর শিষ্যরা কলকাতায় তার গুরু ছিলেন। ’
 
তিনি বলেন, ৭৩ এ যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তখন তিনি বলেছিলেন, বাঘা যতীনের বাড়ি তিনি জাদুঘর বানাবেন, ক্যান্টনমেন্ট বানাবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর আমাদের সব কিছুই মানুষের দখলে গেছে।
 
পৃথীন্দ্রনাথ নিজের পাণ্ডিত্য, পরিচয় ও অর্জনকে পেছনে ফেলে ভালোবাসেন কেবল বিপ্লবী দাদুর পরিচয় দিতে, গল্প করতে। তিনি বিশ্বাস করেন বাঘা যতীনকে হত্যার মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা কমপক্ষে ৩০ বছর পিছিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে তার তৈরি করা ক্ষেত্রে এসেই মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছেন।
 
এনিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কিছুটা অভিযোগও রয়েছে পৃথীন্দ্রনাথের। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই কংগ্রেস বাঘা যতীনের বীরত্বকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এ বিষয়ে গবেষণা করতে আমি পঞ্চাশ বছর পরিশ্রম করেছি। ভারতের নতুন ইতিহাস লেখা হবে। যাতে আমার দাদুই হবে ভারতের আসল হিরো। সারা পৃথিবী ঘুরে আমি তার দলিলপত্র জোগাড় করেছি।
 
জীবনের অর্জন কি? এর উত্তরে একটু হেসে তিনি বলেন, ভারত সরকার আমাকে কোনও পুরস্কার দেয়নি। আমি একটাই পুরস্কার পেয়েছি বলে মনে করি। সেটা বাংলাদেশ সরকার আমাকে দিয়েছে। সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি আমার বাসায় এসে সে পুরস্কারের দাওয়াত দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি অসুস্থ থাকায় ঢাকায় যেতে পারিনি। ফরাসি রাষ্ট্রদূত আমার হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন।
 
পৃথীন্দ্রনাথ জানান, তিনি কেবল তার দাদার পরিচয়ই বহন করেন না। শরীরেও বহন করেন সেই রক্ত ও উত্তেজনা। আর সেই উত্তেজনা ও বিপ্লবী চেতনাতেই ৭১’এ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাত সাগর তেরো নদীর ওপার থেকেই যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পুর্ব পুরুষের স্বাধীনতার জন্য বিদেশিদের মাটিতে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। জ্যাঁ পল সার্ত্র, আন্দ্রে মালরোর মতো মহান ফরাসি দার্শনিকদের তিনি বাংলাদেশের সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন। মালরো বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধের জন্য একটি আর্ন্তজাতিক ব্রিগেডও গঠন করেছিলেন। তিনি নিক্সনকেও চিঠি লিখেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত সেই কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে।

এবার আবার যেনো দার্শনিক হয়ে উঠলেন, বাঘা যতীনের নাতি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘ভারত সরকার আমাকে কোনো পুরস্কার বা স্বীকৃতি না দিলেও ফরাসি সরকার বা ফরাসি একাডেমি কয়েকবার আমাকে পুরস্কৃত করেছে। যা পেলে সবাই সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বলে চিল্লাচিল্লি করে। আমার কাছে কাজই বড়। সম্মান বা স্বীকৃতি পাওয়া আমার কাছে মুখ্য বিষয় নয়। সম্মান পাওয়ার বিষয়েও আমার আগ্রহও নেই। এটা হলো শ্যাম্পেনের মতো। কিছু সময়ের জন্য স্বাদ দিয়ে হারিয়ে যায়। আমার থিসিস পড়ে জ্যাঁক আতাঁলির মতো পণ্ডিত মন্তব্য করেছিলেন, এটা মানুষের চোখ ঘুরিয়ে দেবে। পাল্টে দেবে মানুষের ইতিহাস ও দর্শন সম্পর্কে সকল ধারনা। আর ওটাই আমার পুরস্কার।
 
বাংলাদেশ সময় ১২১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৬
আরএম/আরএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।