ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফ্রান্স

নিঃশব্দের কবি বা ভীম থেকে পার্থ প্রতীম হওয়ার গল্প

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
নিঃশব্দের কবি বা ভীম থেকে পার্থ প্রতীম হওয়ার গল্প ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্যারিস থেকে ফিরে: প্রথমে পাত্তাই দিলেন না তিনি। ফোন কেটে দেওয়ার আগে বললেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বিব্রত বোধ করেন।

এবার প্যারিসপ্রবাসী আলোকচিত্রী ও উদীচী কর্মী বন্ধু শওকতের সহায়তা নিতে হলো। শওকতকে তিনি জানালেন, জাস্ট কিছুক্ষণের জন্য আড্ডা হতে পারে। কোনো সাক্ষাৎকার নয়।

দিনক্ষণ ঠিক হলো। বন্ধুকে নিয়ে প্যারিসের গার্দু নর্দ সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে এনসিএফএ’র টিকিট কেটে চলে গেলাম তার বাসায়। তিনি বাসাতেই ছিলেন, সারাক্ষণ ফোনে খোঁজ নিয়েছেন। তবে যোগাযোগটা আমার সঙ্গে নয়, শওকতের সঙ্গে।
 
ঘরে ঢুকেই অভ্যাসবশত সালাম দিয়েই খেলাম হালকা ধমক। মজা করে বললেন, আমি হিন্দু, দেখো ঘরভরা ঠাকুর-দেবতা। আদাব দেবে, বুঝেছো! তা না হলে কিন্তু ঠাকুর ক্ষেপে যাবেন। স্মিত হেসে এগুতেই হাত বাড়িয়ে জ্যাকেট চেয়ে নিয়ে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে দিলেন। বসালেন বৈঠকখানায়।

এ ঘরটিকে ঘর না বলে কোনো জাদুঘরের স্টুডিও বা গ্যালারি বলাই ভালো। অবশ্য পুরো বাড়িরই এ অবস্থা। বৈঠকখানার সঙ্গেই তার শোবার ঘর। সেখানকার অবস্থাও এমনই।

যদিও তার কথায়, শোওয়ার ঘরে শোয়া হয় কমই! কারণ, সবসময় এতো অতিথি তার বাসায় থাকেন যে, তাদের শয়নকক্ষ অতিথিদের বরাদ্দ দিয়ে তিনি ও তার স্ত্রী প্রায়ই ছেলে-মেয়ের ঘরে ঘুমুতে যান।
 
মিনিট পাঁচেক আলাপের পরই বললেন, শওকত ওর সঙ্গে কথা বলে বোধহয় মজা পাওয়া যাবে। যতো সাংবাদিক বাংলাদেশ থেকে আসে, প্রায় সবাই মুর্খ (!), কথা এগিয়ে নিয়ে আড্ডা জমাতে পারে না। পড়াশোনা না থাকলে যা হয় আর কী!

কিছুটা বিব্রত ও সংশয়ে পড়ি এবার। এতোক্ষণ যার কথা পাঠক পড়ছেন, তিনি প্যারিসপ্রবাসী আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মাইম শিল্পী স্যার পার্থ প্রতীম মজুমদার। যাকে সারা পৃথিবীতে বোবা শিল্পের বা নিঃশব্দের কবি হিসেবে ডাকা হয়।
 
পার্থ দা হিসেবেই তিনি প্যারিসের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে পরিচিত। তার উপর নির্মিত এক আর্ন্তজাতিক প্রামাণ্যচিত্র চালু করে দিয়ে তিনি চলে গেলেন রান্নাঘরে। ১৫ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র শেষ হলে দেখি ‘নিঃশব্দের কবি’ শীতের দেশে বেড়াতে সাংবাদিকের জন্য ভাজছেন বেগুনি।

তার রান্নাঘরের প্রতিটি কোণাও যেনো শিল্পের ক্যানভাস। কেউ দেখিযে না দিলে হয়তো আপনি খুঁজে পাবেন না কোথায় ফ্রিজ, কোথায় ওভেন। অথচ তিনি অনায়াসেই কারুকার্যময় কাঠের কপাট খুললে বেরিয়ে আসছে সব। তার বারান্দায় রয়েছে নানা গাছের সমারোহ। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া এসব গাছ বাঁচিয়ে রাখতে তাকে সারাক্ষণ যত্নআত্তি করতে হয়।
 
বেগুনি খেতে খেতেই গল্প হয় তার সঙ্গে। পার্থদা বলে যান তার শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প ও প্রবাস জীবনের অর্জনের কথা। কীভাবে ভীম বা অন্য নাম থেকে তিনি আজকের পার্থ প্রতীম হয়েছেন, সেই গল্প। তারই সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো পাঠকের জন্য।
 
ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মানুষ হয়েছেন তিনি। প্রায় তিন যুগ ধরে রয়েছেন শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির আঁতুড়ঘরখ্যাত প্যারিসে। বর্তমানে মাইম শিল্পে সারা বিশ্বে তার উপরে রয়েছেন কেবল একজন। তাও অন্য কেউ নন, তারই গুরু মারসেল মার্সো। বিশ্বের যেখানেই যান তুলে ধরেন বাংলাদেশের পতাকা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান 'একুশে পদক-২০১০' এবং ফ্রান্স সরকারের সংস্কৃতির সর্বোচ্চ সম্মান 'শেভালিয়ের আর্ট ও লিটারেচার নাইট' উপাধি লাভ করা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু আন্তর্জাতিক সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। মাইম ও পৃথিবীর বুকে তার ছোট্ট দেশটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন অসম্ভব আবেগী এ মানুষটি। সাধারণ জীবনযাপন আর শিল্পী জীবনের একটাই মাত্র স্বপ্ন তার। বাংলাদেশের বুকে একটি পূর্ণাঙ্গ মাইম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা। বড় অভিমানী এ মানুষটি সবসময়ই যেনো পরে থাকেন কোনো রাগী মানুষের খোলস, অথচ তার ভেতরটা সত্যিই নরম ও কোমল।
 
১৯৫৪ সালের ১৮ জানুয়ারি পাবনার কালাচাঁদপাড়ায় পার্থ প্রতীম মজুমদারের জন্ম। চার ভাইবোনের মধ্যে বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। তার মায়ের নাম সুশ্রিকা বিশ্বাস আর বাবা প্রেস ফটোগ্রাফার হিমাংশু কুমার বিশ্বাস।

পার্থদা বলে যান তার শৈশবের কথা। সে সময়ের বিড়ম্বনার কথা বলতে গিয়ে হেসে ওঠেন তিনি। তারপর বলতে থাকেন, ছেলে একটা জন্মালো বটে কিন্তু একেবারেই লিকলিকে। তালপাতার সেপাই। ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। ছেলের দিকে তাকালেই মায়ের মন মায়ায় ভরে যায়। আহা বেচারা, মানুষের স্বাস্থ্য এতো খারাপ হয়! অনেকেই ধারণা করেছিলেন, যদি দু’টো ডানা নিয়ে এ ছেলে জন্মাতো তাহলে উড়ে বেড়াতে এর কোনো অসুবিধাই হতো না। ঠাম্মার ধারণাও এর কিছু ব্যতিক্রম নয়। তাই তিনি পার্থকে ডাকেন ফুরফুরি বলে। ফুরফুরি হচ্ছে ফড়িং। এ ঘাস থেকে ও ঘাসে উড়ে বেড়ায় যে, পার্থ হলেন ঠাম্মার সেই ফড়িং।

‘বাবার চিন্তা ছিলো অন্যরকম। চিন্তাটা কোনো অংশে দুশ্চিন্তার কিছু কম নয়। এই তালপাতার সেপাইটার গায়ে গতরে কী কোনোদিন মাংস লাগবে? এর উপর ঠাম্মা যদি তাকে ফুরফুরি ডাকেন তাহলে তো আর আশাই নেই। একদিন সাহস করে ঠাম্মাকে তিনি বলেও ফেললেন সেই কথা। তার মা, ফুরফুরির ঠাম্মা, বললেন, তুই তবে নাম ঠিক করে দে। নাম ঠিক হলো। মহাভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্রের নামে নাম, ভীম। বিষয়টা অনেকটা কানা ছেলের নাম পদ্মলোচনের মতোই। তারপরও বাবার আশা নামের কারণে যদি ছেলের গায়ে একটু মাংস লাগে। সেই থেকে আমি ভীম। পাবনার কালাচাঁদপাড়ার সবাই এই নামেই আমাকে ডাকে। বাবা-মা, ঠাম্মা আর বন্ধুরা সব্বাই। আরও একটা নাম কিন্তু আমার ছিলো, প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস। ’
 
কিন্তু সে নামও টিকলো না বেশিদিন। শেষ পর্যন্ত তাকে পার্থ নামেই সেটেল হতে হয়েছে। সেটাও ১৯৭২ সালের কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। যুদ্ধের সময়টাতে রিফিউজি হয়ে তাদের পরিবার চলে গিয়েছিলো ইন্ডিয়াতে। সেই যুদ্ধ শেষ হলো। পার্থরা ফিরে এলেন পাবনার বাড়িতে। সেই বাড়িতে আসতেন বারীণ মজুমদার। বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদ। বাংলাদেশের মিউজিক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা।

বারীণ মজুমদার ছিলেন সম্পর্কে হিমাংশু কুমারের দূর-আত্মীয়। হিমাংশু কুমার তাকে মামা ডাকতেন। বারীণ মজুমদার প্রায়ই আসতেন পার্থদের বাড়িতে। যুদ্ধের পরেও সেই আসা থামেনি। ইতোমধ্যে তিনি তার একমাত্র মেয়েকে হারিয়েছেন। সেও সেই স্বাধীনতার যুদ্ধে।

‘তিনিই বললেন বাবাকে। 'হিমাংশু, তোর তো চার ছেলেমেয়ে আর আমার আর তোর মামীমার তো বড় ছেলে ছাড়া কেউ নেই। তুই মেজ ছেলেটিকে আমাকে দে। ওর শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা। আমার কাছ থেকে কিছু শিখুক। ’

হিমাংশু রাজী হলেন। রাজী হলেন সুশ্রিকা বিশ্বাসও। ফলে ভীমকে দত্তক নিতে বারীণ মজুমদারের কোনো অসুবিধাই হলো না। পালক পুত্রকে নিয়ে তিনি ঢাকাতে তার বাসগৃহে ফিরে আসেন। নাম বদলালেন। নিজের পরিবারের সঙ্গে মিলিয়ে প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস থেকে বদলে দিলেন পার্থ প্রতীম মজুমদার নামে। তারপরের যে জীবনের শুরু হলো সেও এক ইতিহাস। শিল্পী হয়ে ওঠার অন্য এক গল্প।
 
২৮ সেগুন বাগিচার মিউজিক কলেজে বারীণ মজুমদারের বাড়িতে এসেই পার্থ পাল্টাতে থাকেন। পরিচিত হয়ে ওঠেন তৎকালীন শিল্প-সংস্কৃতির সবার সঙ্গে। একদিন পাবনার বাড়িতে ভিক্ষুকের ভিক্ষা করা দৃশ্য আয়ত্তে নিয়ে যে মাইমের চর্চা শুরু করেছিলেন না জেনে, না বুঝে- একদিন এখান থেকেই তা সবার সামনে প্রদর্শনের সুযোগ পান। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি প্রথম মাইম প্রদর্শন করেন। ১৯৮১ সালে ফ্রান্স সরকারের ফেলোশিপ নিয়ে প্যারিসের যান তিনি।
 
প্যারিসে গিয়ে পার্থর পরিচয় হয় বিশ্বখ্যাত মাইম আর্টিস্ট মারসেল মার্সো’র সঙ্গে। মার্সোর ওস্তাদ ছিলেন এতিয়েন দু ক্রু। এতিয়েন নিজে কর্পোরাল মাইমের জন্মদাতা ও প্রখ্যাত মাইম শিল্পী ছাড়াও একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা। তিনি 'চিলড্রেন অব প্যারাডাইস' নামে একটি বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন। পার্থ প্রতীম মজুমদার ফ্রান্সে গিয়ে সর্বপ্রথম এতিয়েন দু ক্রুর কাছে মাইমের উপর শিক্ষা নেন। এর শেষ দিকে তার সঙ্গে পরিচয় হয় জগত‍বিখ্যাত মাইম পণ্ডিত ও শিল্পী মারসেল মার্সোর সঙ্গে।

পার্থ প্রতীম গিয়েছিলেন মার্সোর একটি অনুষ্ঠান দেখতে। সেখানে অনুষ্ঠান শেষে তিনি বাংলাদেশ থেকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া শিল্পকলা একাডমির একটি ব্রুশিয়ার মার্সোকে দেখান। ব্রুশিয়ারটি ছিলো পার্থর নিজের উপর।

মার্সো অবাক হন। বলেন, ছবির এই শিল্পীটি আসলে কে? পার্থ তখন বললেন নিজের কথা। মার্সো আরও অবাক হলেন৷ বললেন, তোমাদের দেশে তাহলে মাইম আছে। পার্থ বললেন, আছে। মার্সো বললেন, তুমি আমার কোম্পানিতে জয়েন করো। এখন তো মার্সা তাকে সন্তান বলেই জানেন।
 
পৃথিবীর প্রায় সব বড় আর্টিস্টদের সঙ্গেই টিভি ও চলচ্চিত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে পার্থ প্রতীমের। বিশ্বকাঁপানো টিভিগুলো তার উপর তৈরি করেছে প্রামাণ্য চিত্র। জাতিসংঘ, ইউনেস্কো, অ্যাপল, মাইক্রোসফটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দূত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহরে সারা বছরই চলে তার মূকাভিনয়। বর্তমানে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেই ব্যস্ত সময় কাটছে তার।
 
এতোটুকু আড্ডার পরই উঠতে হয় আমাদের। পার্থদার শো থাকায় আমরা দ্রুত রওনা হই প্যারিস সেন্টারের দিকে। কিন্তু আবারও যাওয়ার জন্য কথা দিয়ে আসতে হয়। একদিন পরই ফোন করেন তিনি। জানান, সারপ্রাইজ রয়েছে। আবারও গেলাম তার বাসায়। এদিন নিজেই রান্না করলেন মুরগির মাংস আর ফুলকপির সবজি। তবে সত্যিকারের সারপ্রাইজ ছিল, ৭১’র নৌ কমান্ডো এনামুল হক। তার সাক্ষাৎকার এরইমধ্যে বাংলানিউজে ছাপা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
আরএম/এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।