ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

অটিস্টিক শিশুর তথ্য নেই রাষ্ট্রে!

আদিত্য আরাফাত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১২
অটিস্টিক শিশুর তথ্য নেই রাষ্ট্রে!

ঢাকা: অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে বর্তমানে সরকারের পাঁচটি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে। তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার আইনের খসড়া।

অটিজমের ওপর সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও রয়েছে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুর তালিকা নেই রাষ্ট্রের কাছে।

অটিজম বিষয়ক কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকছে সভা-সেমিনারে। গ্রাম পর্যায়ে অটিজম বিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেই। সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না থাকায় অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করতে নানা সমস্যা হচ্ছে।

বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুদের ওপর তথ্য-উপাত্ত না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্বয়ং বাংলাদেশ অটিজমবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা হোসেন।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিনি বলেন, ‘অটিস্টিক শিশুদের সম্পর্কে তথ্যের অভাব আছে। তথ্য না থাকায় কাজ করতে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ’

পরিসংখ্যান না থাকলেও সচেতনতা বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘দেশে অটিজমে আক্রান্তের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও ধীরে ধীরে এই বিষয়ে সচেতনতা গড়ে উঠছে। ’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে অটিস্টিক শিশুদের তালিকা না থাকায় ইতোপূর্বে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা ও বিশ্বের অটিজম বিশেষজ্ঞরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

অর্টিস্টিক শিশুদের প্রতিষ্ঠান স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেনের পরিচালক মারুফা হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘অটিজমের ওপর সচেতনতা বাড়লেও অটিস্টিক শিশুদের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করবে। ’

অটিজম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে অটিস্টিক শিশু কত আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বাড়িয়েও লাভ হবে না।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী; যাদের অধিকাংশই অটিস্টিক শিশু।

অটিজম সম্পর্কে জানতে হবে; জানাতে হবে

অটিজমে আক্রান্তদেরকে অটিস্টিক বলা হয়। অটিজমকে সাধারণভাবে শিশুর মনোবিকাশগত জটিলতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অটিজম শিশুর এমন একটি সমস্যা, যাতে শিশু পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার পদ্ধতি, যেমন—কথায় অসংলগ্নতা, ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে না পারা।      

অটিজমে আক্রান্ত শিশু নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকে, সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না, আচরণে সমস্যা দেখা দেয় এবং একই কাজ বারবার করতে থাকে বা হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অটিজম কোন সাধারণ রোগ নয়। এটি শিশুদের একটি মনোবিকাশগত জটিলতা যার ফলে সাধারণত ৩টি সমস্যা দেখা দেয়া। যেগুলো হচ্ছে- প্রথমতঃ মৌখিক কিংবা অন্য কোনো প্রকার যোগাযোগ সমস্যা, দ্বিতীয়তঃ সমাজিক বিকাশগত সমস্যা, তৃতীয়তঃ খুব সীমাবদ্ধ ও গণ্ডিবদ্ধ জীবন-যাপন ও চিন্তা-ভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ এছাড়া অতি চাঞ্চল্য (Hiper Activity), জেদী ও আক্রমণাত্মক আচরণ (Aggressiveness), অহেতুক ভয়ভীতি, খিচুনী ইত্যাদি ও থাকতে পারে।

অটিজম প্রতিষ্ঠান স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেনের পরিচালক মারুফা হোসেন জানান, বিশেষ পদ্ধতিতে শিক্ষা এবং অকুপেশনাল থেরাপির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুরা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারে।

অটিজম বিশ্বে এতই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে জাতিসংঘ প্রতিবছর ২ এপ্রিলকে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করছে। সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যই ২০০৮ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও প্রতিবছরের মতো এবছরও সরকারি ও বেসরকারিভাবে পঞ্চম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন চলছে।

পঞ্চম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে সোমবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে অটিজমের অগ্রগতি তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘অটিজম বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। গত বছর ২৫ ও ২৬ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত অটিজম বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন দেশের অটিজম আন্দোলনে নুতন মাত্রা এনে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, “আমার কন্যা সায়মা হোসেন অটিজমের ওপর গবেষণা করেছে। বিভিন্ন দেশে অটিজম সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে। দেশে অটিজম আক্রান্ত জনগণের কল্যাণে কাজ করছে। ’

অটিজম কার্যক্রম শুধুই শহর কেন্দ্রিক
ফেনীর মালীপুর গ্রামের মশিউর রহমানের পুত্র মিসবাহ উর রহমান আড়াই বছর বয়স থেকেই অটিজমে আক্রান্ত। অস্বাভাবিক আচরণ বাড়তে থাকলে সন্তানের সাত বছর বয়সে মশিউর রহমান তার সন্তানকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারেন তার ছেলে অটিজমে আক্রান্ত।

মশিউর বাংলানিউজকে বলেন, ‘আড়াই বছর বয়স থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ দেখি মাঝে মাঝে। গ্রামের লোকজন বলতো, আলগা বাতাস (জীনের হাওয়া) লেগেছে তাই এমন করছে। গ্রামের হুজুরের পানি পড়া ও তাবিজ নিলেও কোনো উপকার না পেয়ে অবশেষে ডাক্তারের কাছে এসে জানতে পারি এ রোগে আক্রান্ত। ’

সরেজমিনে কয়েকটি গ্রামে পরিদর্শন করে দেখা যায়, অনেক অটিস্টিক শিশু থাকলেও গ্রাম পর্যায়ে এখনও সচেতনতা তৈরি হয়নি। গ্রামের অনেকেই জানে না অটিজম কি।

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অটিজমের ওপর কাজ করা হলেও তা শহর ও সভা-সেমিনার কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। গ্র্রামের অনেকেই জানে না অটিজম কি। অটিজম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে যথাসময়ে গ্রামের অটিস্টিক শিশুগুলো স্বাভাবিক জীবন ফিরে যেতে পারে না।

সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ বাংলানিউজকে বলেন, অভিভাবকেরা অটিস্টিক শিশুদের সামনে আনতে চান না বলে তাদের চিহ্নিত করা কঠিন। তবে আগে থেকে মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে।
 
তবে সমাজকল্যাণমন্ত্রী মনে করেন, তৃণমূল পর্যায়েও বিস্তৃত হচ্ছে অটিজম বিষয়ক সচেতনতা। অটিস্টিক শিশুদের এ বিষয়ে জরিপ কাজও চলছে বলে তিনি জানান।

অটিজম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাঁচটি মন্ত্রণালয় অটিজমের ওপর কাজ করলেও গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা না থাকায় এবং অটিস্টিক শিশুদের সঠিক সংখ্যা সরকারের কাছে না থাকলে একদিকে যেমন জাতীয় অর্থনীতির ওপর বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে। তেমনি মেধাবী মানুষের পরিমাণও কমবে দেশে।

বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো জরিপ না হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, কেবল ঢাকা বিভাগের শিশুদের মধ্যে অটিজমের হার প্রায় শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, সে দেশে অটিজমের হার শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমন্বিত সেবা দিয়ে অটিজম-আক্রান্ত শিশুদের যথাসম্ভব স্বাভাবিক কর্মক্ষম করে গড়ে তুলে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন অটিজম নিয়ে সচেতনতা এবং কোনো বিভ্রান্তি থাকলে তা নিরসন করা।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১২

এডিএ/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।